বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
আলিপুরের বেলভেডিয়ারের বাড়ির গায়ে জড়িয়ে আছে অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা। এটি ছিল লাটসাহেবেব পুরনো বাড়ি, বর্তমানে এখানেই গড়ে উঠেছে আমাদের ন্যাশনাল লাইব্রেরি। এই বাড়িতেই একসময় বসবাস করতেন বহু সুকৃতী ও দুষ্কৃতীর নায়ক বাংলার প্রথম গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁর আমলেই মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। শুধু তাই নয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের রেশ তখনও দেশজুড়ে বহাল ছিল।
১৭৭২ থেকে ১৭৮৫— এই তেরো বছরের রাজত্বকালে ওয়ারেন হেস্টিংস শুধু আলিপুরের এই বিলাসগৃহ নয়, তিনি মোট তেরোটি বাড়িতে বসবাস করেছেন। তাঁর এই গৃহ-প্রীতি নিয়ে সেইসময় বিস্তর আলোচনাও হতো। ডব্লু কে ফার্মিংজারের ‘থ্যাকারস ক্যালকাটা ডিরেকটরি’-তে আছে, ‘হি হ্যাড এ লুক্রেটিভ ম্যানিয়া ফর হাউস বিল্ডিং অ্যান্ড সেলিং।’
হেস্টিংস মানুষটা ছিলেন চঞ্চল, ছটফটে, উচ্ছৃঙ্খল, প্রবল খামখেয়ালি এবং বেপরোয়া প্রকৃতির। একদিন তাঁর বেলভেডিয়ারের বাড়ির পশ্চিমদিকের বাগানে দ্বন্দ্বযুদ্ধ বা ডুয়েলে মেতে উঠেছিলেন দুই যোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বাংলার দন্ডমুণ্ডের কর্তা বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস এবং অপরজন তাঁরই লাটসভার বিশিষ্ট সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস। এই দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা প্রথম থেকেই মোটেও মধুর ছিল না।
সেইসময় ইংরেজদের সঙ্গে মারাঠাদের প্রবল ঝগড়া চলছিল। কেউ কেউ মনে করেন মারাঠা যুদ্ধের নীতি নিয়েই তাঁদের দু’জনের মধ্যে মন কষাকষি শুরু হয়েছিল, যা তাঁদের দু’জনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল দ্বন্দ্বযুদ্ধের ময়দানে। অবশ্য নিন্দুকেরা বলতেন, ওসব নীতি-ফীতি ফালতু কথা। দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল এক ফরাসি সুন্দরী, নীলনয়না, শ্বেতাঙ্গিনীকে কেন্দ্র করে। তাঁর নাম ছিল মাদাম গ্র্যান্ড। শ্বেতাঙ্গিনী, নীলনয়নাই যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের মূল কারণ তার কিছুটা আভাস এইচ ই বাস্তিদ তাঁর ‘ইকোজ ফ্রম ওল্ড ক্যালকাটা’ বইতে দিয়েছেন—‘Nearly opposite Alipore Bridge stood two trees. called ‘ The trees of Destruction.’notorious for duels fought under their shade; here Hastings and Francis exchanged shots in the days when European women were few: Jealousy often gave rise to these affairs of honour.’
১৭ আগস্ট ১৭৮০, সকাল ছ’টায় হেস্টিংসের সহকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিয়ার্স এবং ফ্রান্সিসের বন্ধু কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ওয়াটসনের উপস্থিতিতে শুরু হয় ডুয়েল। এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে ফিলিপ ফ্রান্সিস পরাস্ত হন। বড়লাটের বন্দুক থেকে ছুটে আসা গুলি গিয়ে বেঁধে তাঁর ডানদিকের ঘাড়ে। তিনি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। ফ্রান্সিসকে পড়ে যেতে দেখে হেস্টিংস সহ সবাই ছুটে আসেন।
হেস্টিংস তাঁকে বলেন, আপনার আঘাত তেমন গুরুতর নয় আপনি আমার বাড়িতে চলুন। ফ্রান্সিস ঘৃণাভরে সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন। তখন ঠিক হল প্রাথমিক শুশ্রূষা করে তাঁকে পালকি করে শহরে পাঠানো হবে। সেইমতো ব্যান্ডেজ বেঁধে তাঁকে তোলা হল পালকিতে। কিন্তু জোয়ারের কারণে বাহকরা পালকি নিয়ে আদি গঙ্গা পার হতে পারল না। তারা আবার ফিরে এল বেলভেডিয়ারের বাড়িতে।
এরপর কেটে গেছে প্রায় দুশো উনচল্লিশ বছর, আদি গঙ্গা দিয়েও প্রবাহিত হয়েছে অনেক জল। লাটসাহেবের বাড়ির নর্থ গেটটাই নাকি ছিল ওই বাড়ির সদর দেউড়ি। এখনও বহু মানুষ গভীর রাতে লাইব্রেরির বাড়ির দিক থেকে উত্তরদিকের গেটে আহত, রক্তাক্ত ফিলিপ ফ্রান্সিসসহ ওই পালকি বাহকদের এগিয়ে আসতে দেখেছেন।
লেখক সুভাষ সমাজদার সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী বীরবাহাদুরের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতটা পর্যন্ত ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। সেদিন ওই দিকের গেট-পাহারার দায়িত্বে ছিলেন বীরবাহাদুর। হঠাৎই তাঁর কানে ভেসে এল ‘হিপ্পোলো হুকুম্মা’, ‘হিপ্পোলো হুকুম্মা’ শব্দটি। অচেনা শব্দ শুনে তিনি বেশ চমকে উঠেছিলেন। শব্দটা ক্রমশ আরও কাছে চলে এল।
একসময় বীরবাহাদুর দেখলেন, কয়েকজন বাহক একটা পালকি নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। আরও কাছে আসার পর তিনি দেখতে পেলেন, পালকির দরজাটা হাট করে খোলা। আর পালকির ভেতরে লম্বা, ঢ্যাঙা চেহারার এক সাহেব দারুণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাঁর সারা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাঁর বাঁদিকের ঘাড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা।
এই দৃশ্য দেখে বীরবাহাদুর খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। একটু ধাতস্থ হয়ে তিনি পুবদিকের(জেলখানার দিকে) গেটের পাহারাদার জামিল শেখের নাম ধরে চিৎকার করতে শুরু করলেন। অমনি, চোখের পলকে বাতাসে মিলিয়ে গেল জখমি সাহেবের পালকি।
ইংরেজরা আমাদের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিয়ে বহুকাল আগেই ভারতছাড়া হয়েছে। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস-এর অতৃপ্ত আত্মা আজও নিজের ‘গ্রেভ’ থেকে উঠে চলে আসেন জাজেস কোর্টের পাশের হেস্টিংস হাউসে। এই বাড়িতে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি টানা সাতবছর কাটিয়েছিলেন। তারপর ফিরে যান নিজের দেশে এবং সেখানেই পরিণত বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাহলে কীসের টানে তিনি তাঁর মাতৃভূমির ‘গ্রেভ’ ছেড়ে এতবছর বাদেও ছুটে আসেন তাঁর ছেড়ে যাওয়া আবাসস্থলে? একটা কালো কাঠের বাক্স। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় যে কোনও কারণে ওই বাক্সটি খোয়া যায়। বিদেশে ফিরেও তিনি তার সন্ধানে লোক লাগিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি মিঃ নেসবিট টমসনকে দুঃখ করে একটা চিঠিও লেখেন— ‘তোমরা আমার সেই হারিয়ে-যাওয়া জিনিসগুলো আজও উদ্ধার করতে পারলে না। আমার সেই কালো কাঠের বাক্সের — গোপনীয় কাগজপ্রত্রগুলোর জন্য কী মানসিক যন্ত্রণাতেই যে কাটাচ্ছি।’
মিঃ টমসন চেষ্টা করেছিলেন সেই জিনিসগুলোর হদিশ করতে। ১৭৮৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি ক্যালকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন—
‘এতদ্দ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে যে প্রাক্তন বড়লাট বাহাদুর ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলাদেশ হইতে চলিয়া আসার সময় তাঁর চৌরঙ্গীর বাড়ি কিংবা আলিপুরে তাঁর নূতন বাড়ি হইতে একটা কালো কাঠের বাক্স হয় চুরি না হয় ভুলক্রমে নিলামে বিক্রয় হইয়া যায়। যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি এই জিনিসগুলির সন্ধান দিতে পারেন তাহা হইলে তাঁহাকে মিঃ লারকিনস(হেস্টিংসের বন্ধু) এবং মিঃ টমসন দুই হাজার সিক্কা টাকা দিয়া পুরস্কৃত করিবেন।’ কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। পাওয়া যায়নি হেস্টিংসের সেই কালো বাক্সটি।
তাই তিনি নিজেই রাত গভীরে চার ঘোড়ায় টানা ব্রুহাম গাড়িতে চেপে হেস্টিংস হাউসের বাগান, দোতলার ঘর ও স্নানঘরে খুঁজে বেড়ান তাঁর সেই অতি গোপনীয় কালো কাঠের বাক্সটি। কিন্তু প্রতিরাতেই তাঁকে ফিরতে হয় শূন্য হাতে।
কিন্ত তিনিই যে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস তা কী করে জানা গেল। ঐতিহাসিক হেনরি কটন এই ব্যাপারে আলোকপাত করে লিখেছিলেন,‘ যে প্রেতমূর্তি গভীর নিশীথে আকুল হয়ে কিছু খুঁজে বেড়ান তিনি আর কেউ নন— স্বয়ং বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস।’ কী ছিল সেই কালো কাঠের বাক্সটিতে, যার টানে হেস্টিংসকে বারে বারে ফিরে আসতে হয়েছে আমাদের দেশে। সেই বাক্সে ছিল দুটো ছবি এবং হেস্টিংসের ব্যক্তিগত কিছু জরুরি কাগজপত্র ও চিঠি। (চলবে)