কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
সেদিন ছিল ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২। নার্সিংহোমের আইসিসিইউ কেবিনে শুয়ে আছেন তিনি। কেবিন নম্বর ৫০৯। সতর্ক দৃষ্টিতে ডাক্তাররা তাকিয়ে রয়েছেন কার্ডিয়াক মনিটরে। বেলা ১২টা থেকে ক্রমশ অবস্থার অবনতি হতে থাকল। হৃদযন্ত্রের রেখচিত্রের কম্পন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসতেই কম্পনের তীব্রতা ঠেকল তলানিতে। অবশেষে ৫টা বেজে ৩২ মিনিটে চিরদিনের জন্য মনিটর থেকে মুছে গেল হৃদযন্ত্রের কম্পন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তাররা শুরু করে দিলেন ‘হার্ট ম্যাসাজ’। কিন্তু চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে বিফল করে বিকেল ৫ টা বেজে ৪৫ মিনিটে ঘোষিত হল তাঁর মৃত্যু সংবাদ।
২ মে, ১৯৯১। সত্যজিৎ ৭০ পূর্ণ করেন। সেই উপলক্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সারা বিশ্ব মুখিয়ে উঠেছিল। ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর টোকিও চলচ্চিত্র উৎসব কমিটি থেকে তাঁকে দেওয়া হয় ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ সম্মান। ব্রিটিশ টেলিভিশন ‘চ্যানেল ফোর’-এ দেখানো হয় তাঁর ১২ টি ছবি এবং তাঁর উপর তোলা একটি তথ্যচিত্র। কান চলচ্চিত্র উৎসবে আয়োজন করা হয় তাঁর নামে বিশেষ প্রদর্শনী। আর বেলজিয়াম থেকে প্রকাশিত হয় ‘Satyajit Ray at 70’।
এই বছরেই মুক্তি পেয়েছিল তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’। ভারত-সহ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছবিটি দেখানো হয়েছিল। জার্মানির বার্লিনে, ‘ভারত উৎসব’-এর সূচনাই হয়েছিল ‘আগন্তুক’ দেখানোর মাধ্যমে। কিন্তু তখন তো অসুস্থতার কারণে সত্যজিৎ গৃহবন্দি। তবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এই বন্দিদশা থেকে তিনি অচিরেই মুক্তি পাবেন। তাই শারদীয়া ‘সন্দেশ’ (১৯৯১) পত্রিকার প্রথম পাতায় সন্দেশীদের উদ্দেশে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সন্দেশী বন্ধুরা, আমার খুব খারাপ লাগছে যে অসুস্থতার জন্য এবার আমি পূজা সংখ্যা সন্দেশে কিছু লিখতে পারলাম না। আমি একটু ভালো হয়ে গেলেই আবার লেখা আরম্ভ করব। ভবিষ্যতে আমার কাছ থেকে গল্প-প্রবন্ধ সবই পাবে এটা কথা দিচ্ছি তোমাদের। তোমরা সবাই আমার শুভেচ্ছা নিও।’ এরপর সম্পূর্ণভাবে তাঁর শরীর আর কখনও ভালো হয়নি। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই একটা নতুন ছবির ভাবনা এসেছিল তাঁর মাথায়। ডাঃ কান্তিভূষণ বক্সির লেখা পড়ে ছবির প্লটটি পেয়েছিলেন তিনি। বিষয়—এক চিকিৎসকের জীবনের একটি দিন। ছবির নাম দিয়েছিলেন ‘জাগরণ’। পরে অবশ্য নতুন নামকরণ হয়েছিল ‘উত্তরণ’। ঠিক করেছিলেন এই ছবির ইন্ডোর শ্যুটিং হবে স্টুডিয়োতে, নিজেই শ্যুট করবেন। আউটডোরে সন্দীপ রায়। ‘উত্তরণ’ তৈরির মশগুলে থাকাকালীনই হলিউড থেকে বার্তা পেলেন, বিশ্ব-চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বিশেষ লাইফ-টাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কার পাচ্ছেন তিনি। ভারত থেকে তিনিই প্রথম এই পুরস্কারে সম্মানিত হবেন, এশিয়াতে দ্বিতীয়। তাঁর আগে এশিয়া থেকে একমাত্র অস্কার বিজয়ী পরিচালক ছিলেন জাপানের আকিরা কুরোসাওয়া। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ অস্কার নেওয়ার সময় অর্ধশায়িত সত্যজিৎ রায়ের ধন্যবাদসূচক ভাষণটা ছিল এইরকম: ‘Well, it’s an extraordinary experience for me to be here tonight to receive this magnificent award; certainly the best achievement of my movie-making career. When I was a small, small school boy, I was terribly interested in the cinema. Became a film fan, wrote to Deanna Durbin. Got a reply, was delighted...’
এত সম্মান, এত শ্রদ্ধা, এত প্রাপ্তির মধ্যেই তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছেন মৃত্যুর দিকে। এক সময় তাঁর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতাও লোপ পেয়েছিল। বিকল্প শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ করে দিতে মৃত্যুর আগের দিন শ্বাসনালীতে ট্রাকিওস্টোমি অপারেশন করেছিলেন ডা. বক্সির নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। একটি প্রশ্ন আজও সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞদের মুখে মুখে ঘোরে, সেটা হল অস্কার কমিটিকে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্যই নাকি তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। বিষয়টা সম্পর্কে সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় জানালেন, ‘ক্যামেরা ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে অস্কার কমিটির লোকজন সেইসময় চলে এসেছে আমেরিকা থেকে। বাবার তখন খুবই শরীর খারাপ। আমরা খুবই চিন্তায় ছিলাম যে কী করব। ওদের ফেরত পাঠিয়ে দেব নাকি ইন্টারভিউ দেওয়ার ব্যবস্থা করব? একটা অদ্ভুত সময় গিয়েছে তখন আমাদের। একদিন হঠাৎ ফোন এল ডাঃ বক্সির। বললেন, ‘আজকে উনি বেশ ভালো আছেন। আমরা ওঁর শরীর থেকে সব ডাক্তারি সরঞ্জাম খুলে ফেলেছি। এখন রেসপন্স করছেন, কথা বলছেন, সজাগ আছেন। তুমি এই বেলা ইন্টারভিউটা সেরে নাও। কারণ পরে আবার কী যে হবে আমরা বলতে পারব না।’ তখন আমরা অস্কার কমিটির লোকজনকে ফোন করে জানালাম, ‘তোমরা রেডি থাকলে ইমিডিয়েটলি ইন্টারভিউটা করে নাও।’ উনি এরপর এক-দু’দিন ভালো ছিলেন। তারপর আবার শরীর খারাপ বাড়তে থাকে।’
জানা গিয়েছে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথা ভেবে ডাঃ বক্সি কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের জন্য ইন্টারভিউ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। অস্কার কমিটির একজন সত্যজিতের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘Shall we start a camera?’ প্রত্যুত্তরে সত্যজিৎ তাঁদের জানিয়েছিলেন, ‘You are the director. I am not the director. If you want, you can start the camera.’ তারপর তিনি অল্প সময়ের জন্য কথা বলেছিলেন। রায় বাড়ির ঘনিষ্ঠ হীরক সেন জানিয়েছেন, ‘হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সন্দীপ(বাবু) এবং ললিতা(বুনি) দু’জনের কেউই ঘরে নেই। খুঁজতে খুঁজতে নার্সিংহোমের একটা জায়গায় গিয়ে অবশেষে দেখলাম দু’জনের চোখেই জল। সত্যজিৎ রায় পৃথিবীতে একটাই। এইরকম মানুষ আর জন্মাবেন না।’
সত্যজিতের ছবিতে আমরা প্রথম মৃত্যুর মুখোমুখি হই ইন্দির ঠাকরুণ প্রসঙ্গে। ইন্দিরের একমাত্র সম্বল পেতলের ঘটিটার সশব্দে পুকুরের জলে গড়িয়ে পড়া নিয়ে ইরানের চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিওরোস্তামির মনে হয়েছিল, এটা জীবন এবং মৃত্যুর এক মেটাফর। তিনি চমকে গিয়েছিলেন ইন্দিরের মাথাটি ‘ঠক্’ করে মাটিতে পড়ে যাওয়ায়। রাস্তার পাশে গাছের গোড়ায় বসে থাকা ঘুমন্ত বৃদ্ধাকে নাড়া দিয়ে অপু-দুর্গা প্রথম বুঝতে পেরেছিল মৃত্যু আসলে কী? আব্বাস বলেছিলেন, ‘ওই ‘ঠক্’ সাউন্ডটি আমার কাছে ভয়ানক শকিং!’ সত্যজিৎ এই বিষয়ে জাপানের ‘কিনেমা জুনপাও’-কে ১৯৭০ সালের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘ছবিতে বৃদ্ধা মৃত বৃক্ষের মতো ধসে পড়ে মারা যান। মরণের পূর্ব মুহূর্তে বৃদ্ধার গীত গানটি তীব্র বেগে আমার হৃদয়ে এসে দাগ কাটে, অশ্রু সংবরণে অক্ষম হয়ে পড়ি।’
অপু ট্রিলজিতে এরপর একে একে দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়া, অপর্ণার মৃত্যু হয়েছে। বেনারসের ঘাটে হরিহরের মৃত্যু-দৃশ্য দেখেও কিওরোস্তামি এক অন্তর্লীন বিয়োগব্যথা অনুভব করেছিলেন। অপুর হাত থেকে এক ফোঁটা জল নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। পরের দৃশ্যে কয়েক-শো পায়রার ঝটপটিয়ে উড়ে যাওয়ার যে ছবি, আসলে তা অনন্ত আকাশে হরিহরের আত্মার পাড়ি দেওয়া।
‘গণশত্রু’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ বেশ অসুস্থ ছিলেন। কারণ ১৯৮৪’র ১৯ জুন আমেরিকার হিউস্টনে তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়। চার সপ্তাহ পরে প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডে আরও একটি অপারেশন। অনেকের মতে, অসুস্থতার জন্য সেইসময় তাঁর ইচ্ছাশক্তি অনেকটা কমে গিয়েছিল। তবে একদিন বিজয়া রায়কে বলেছিলেন, ‘ছবি না করলে বাঁচব না।’ ‘আগন্তুক’ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে মনোমোহন বেরিয়ে পড়েছে লক্ষ্যহীন বিশ্বভ্রমণে, জীবনের খোঁজে। এই ছবির শ্যুটিং শেষে সত্যজিৎ উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ব্যস! আমার আর বলার কিছু বাকি রইল না।’ তিনি কি জেনে গিয়েছিলেন, এটাই তাঁর শেষ ছবি? নয়তো এমন অমোঘ উচ্চারণ কেনই বা তিনি করলেন? ‘এরকম একজন ক্রিয়েটিভ লোকের বলা তো শেষ হতে পারে না। আমাদের তখন খারাপ লেগেছিল। পরে আমি আর কিছু বলিনি বাবাকে। শরীরটা খারাপ, তিনি বুঝতেই পেরেছিলেন যে আর বেশিদিন হয়তো কাজ করা যাবে না। তবে সেটা অতটা প্রোফাউন্ড নয়। তারপরেও তিনি নতুন উদ্যোগ নিয়ে লিখেছেন ‘উত্তরণ’। ক্রিয়েটিভিটি যে শেষ হয় না সেটা বোঝাই যাচ্ছে তাঁর নতুন ছবির চিত্রনাট্য লেখা দেখে। তিনি চলে যাবেন সেটা বুঝতে পারেননি, তবে কাজ যে করতে পারবেন না সেটা বুঝতে পেরেছিলেন।’ জানালেন সন্দীপ রায়।
সত্যজিতের শেষ ছবির নায়িকা মমতাশঙ্কর যেমন একটি বিষয়ে নিশ্চিত, ‘আগন্তুক এমন একটা ছবি, যেখানে মানিককাকা বোধহয় সারা জীবনে যা বলতে চেয়েছেন, মানে শেষে যা কিছু বলে যেতে চেয়েছেন, সেগুলোই বলে গিয়েছেন।’ কী সেই কথাগুলো? অভিনেত্রী জানিয়েছেন, সভ্যতা কী, সভ্য কারা, অসভ্য কারা, ধর্ম কী, মানে কোনও কিছুই বাদ দেননি। সবচেয়ে বড়ো কথা, তখন অনেকে সমালোচনা করেছিল যে গানটা (অন্ধজনে দেহ আলো/ মৃতজনে দেহ প্রাণ) কেন উনি নিজের গলায় গাইতে গেলেন? আমার মনে হয়, সেটাও তিনি একটা স্মৃতি হিসেবে আমাদের দিয়ে গিয়েছেন।... বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজের কণ্ঠেরও ছাপ রেখে দিলেন।’
সন্দীপ জানালেন, ‘বাবা ভীষণ পজিটিভ ছিলেন। খুবই অপটিমাইজ। নেগেটিভ ব্যাপারগুলো নিয়ে একদম চিন্তা করতেন না। তিনি অনেককেই বলেছেন, ‘আমি শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই।’ একটা ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি একশো বছর বাঁচি তবে নব্বই বছর পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই।’ যখন শারীরিকভাবে অবনতি হচ্ছিল তখন ভিতরে ভিতরে একটা ভয় হয়তো ছিল। মাঝে যখন চোখে ছানি পড়েছিল— কিছু দেখতে পারছিলেন না, কিছু লিখতে পারছিলেন না। তখন তিনি কেমন যেন ডিপ্রেসড্ হয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেটা তিনি এক্সপ্রেস করতেন না।’
জাপানি সাংবাদিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরেকবার অপুর গ্রামের জগতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল নগরায়ণ এবং জনসংখ্যার এককেন্দ্রিকতা অপুর গ্রামকে ক্রমশ বহুদূরে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু আমার জীবনে প্রাকৃতিকভাবেই আসবে বলে মনে করি। জোরের সঙ্গে বললে সেটাই আমার জীবন-মৃত্যুর পর্যবেক্ষণ।’ ‘চারুলতা’-র মাধবী মুখোপাধ্যায় জানালেন, ‘১৯২১ সালের ২ মে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর মৃত্যু নেই। সত্যজিতে রায়ের জন্ম আছে, মৃত্যু নেই। আমার কাছে তিনি চিরন্তন।’