কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা বড় অস্থির এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যা ঘটছে, তার চেয়েও দ্রুত কিছু রটছে। বাঁধহীন নদীর মতো বল্গাহীন হরিণের মতো ধেয়ে আসছে একের পর এক হুজুগ, ভিত্তিহীন কিছু তথ্য। রবিবার সকালে এত কথা কেন বলছি? যে সকাল বাঙালির শুরু হয় লুচি আর সাদা আলুর তরকারি দিয়ে, নিদেনপক্ষে কচুরি-জিলিপির সঙ্গতে, সেই সকালে খবর-গুজব-অস্থির সময় দিয়ে এত প্রগলভ হয়ে আমার কী লাভ?
লাভ একটিই। একখানা সত্য বলে অনেক রটনা ও মিথ্যাকে অস্বীকার করা। দাগিয়ে দেওয়া। সম্প্রতি একটি খবর নিয়ে বেশ হইচই চলছে। বিশেষ করে ‘স্পাইডার ম্যান: অ্যাক্রস দ্য স্পাইডার ভার্স’-এর ট্রেলার প্রকাশ্যে আসার পর। সৌজন্যে বেশ কিছু ভারতীয় ও বিদেশি মিডিয়া। খবরটির সারমর্ম এই যে—আমার বাবা, সত্যজিৎ রায় কোনও এক সময় নাকি নিউ ইয়র্কে গিয়ে মার্ভেল কমিকসের প্রধান স্ট্যান লি’র সঙ্গে দেখা করেন। স্পাইডারম্যানের ভারতীয় সংস্করণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়। আইডিয়াটা নাকি বাবারই ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা তাঁর জীবদ্দশায় আর বাস্তবায়িত হয়নি। পরে সেই ভারতীয় স্পাইডারম্যানের কমিকস প্রকাশিত হয়। সেই চরিত্রটি এবার পর্দায় আসতে চলেছে। বাংলার বেশ কিছু নামজাদা নিউজ ওয়েবসাইটেও নাকি লিখেছে, এই স্পাইডারম্যান চরিত্রটির সঙ্গে বাবারও যোগসূত্র রয়েছে। এমন একটি তথ্য জেনে আমি তো অবাক! স্তম্ভিত হয়ে ভাবছি, প্রযুক্তিগতভাবে আমরা এত এগিয়েছি, ভুল তথ্য, ভুয়ো খবর যাচাই করার প্রযুক্তি হাতের মধ্যে, অথচ এই একটি মিথ্যে দিনের পর দিন প্রচার করছি! কেউ একবার আসল তথ্যটি জানতেও চাইছি না! সম্প্রতি ‘বর্তমান’-এর তরফ থেকে আমার কাছে এই তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এইটুকু সচেতনতাই তো আমরা মিডিয়ার কাছে আশা করি! সেদিনই ঠিক করি, এই বিষয়ে কয়েকটি কথা জানাতে হবে। নইলে এই ভুল তথ্যের প্রবাহ কমবে না।
আসলে কী জানেন, খ্যাতনামা পরিবার মানুষকে যেমন পরিচিতি দেয়, তেমন আলগা একটা দায়ও থাকে। দায়, রটনা সরিয়ে সত্য তুলে ধরার। দায়, যা নয়, তাকে অস্বীকার করে, যা হয়, তাকে প্রতিষ্ঠা করার। সেই দায় থেকেই বলতে পারেন রবিবার সকালে কলমচির কাজটুকু সারতে হচ্ছে। হ্যাঁ, আমার বাবা সত্যজিৎ রায় হলিউড গিয়েছিলেন ঠিকই, একটি ছবির কথা আলোচনা করতেই গিয়েছিলেন, তাও সত্যি। তবে তা মোটেই স্পাইডারম্যান নয়। সেই ছবির নাম ‘দি এলিয়েন’। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি বাবা একটি চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন। সেটি নিয়েই তিনি হলিউডে পাড়ি দিয়েছিলেন। প্রযোজনা সংস্থা ‘কলম্বিয়া পিকচার্স’ এই ছবি করার সিদ্ধান্তও নেয়। কিন্তু পরে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। ঘটনা এইটুকুই। স্পাইডারম্যান নিয়ে বাবা কোনওদিন কিছু ভাবেননি। কোনও আগ্রহ ছিল বলেও মনে হয়নি। মার্ভেল কমিকসের প্রধান স্ট্যান লি-র সঙ্গে এনিয়ে কোনও কথা হয়নি তাঁর। কখনও এনিয়ে বিশেষ খোঁজখবর করতেও দেখিনি। বরং বাবার যাবতীয় আগ্রহ ছিল এলিয়েন চরিত্রটি নিয়ে। খুব যত্ন করে চিত্রনাট্যটি লিখেছিলেন বাবা। ইচ্ছে ছিল, এটা নিয়ে হলিউডে কাজ করবেন। কিন্তু নানা কারণে আর হয়ে ওঠেনি।
ঘটনাটি খুব গোপনীয় কিছু নয়! বরং সকলেই জানেন। তারপরেও ‘স্পাইডারম্যান’ কোথা থেকে এসে হাজির হল, কোন গবেষক এমন তথ্য দিলেন, তা আমার জানা নেই। আমি অনুরোধ করছি, এমন ভুল তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না। এতে উষ্মা বা আপত্তির চেয়েও তীব্র এক অস্বস্তি কাজ করছে। সত্যজিৎ রায় সিনেমা জগতে এমন একটি নাম, যাঁর যাবতীয় কাজ, লেখা, ছবি আদতে গবেষণার বিষয়। সেখানে দাঁড়িয়ে এমন এক যশস্বীকে নিয়ে তথ্যবিকৃতি কেবল নিজেদের অজ্ঞানতাকেই প্রমাণ করে। সত্যজিৎ রায়ের উত্তরসূরী হিসেবে নয়, আজ একজন সত্যজিৎভক্ত হিসেবে আমার বিনীত অনুরোধ, স্পাইডারম্যন, স্ট্যান লি ও সত্যজিৎ রায়— এই তিনজনের মধ্যে আর জোর করে কোনও যোগসূত্র খুঁজে বের করবেন না। এটা সম্পূর্ণ গুজব ও মিথ্যা। প্লিজ!