কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ শিবনাথ শাস্ত্রী প্রসঙ্গত যে মন্তব্য করেছিলেন এই আলোচনার শুরুতেই সেটাকে সামনে রেখে এগলে মূল আলোচ্যটিকে ছুঁতে আমাদের কিছুটা সুবিধা হতে পারে— ‘ইহা বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না যে বঙ্গদেশ যে আজিও ভারত সাম্রাজ্যের মধ্যে বিদ্যা বুদ্ধি রসিকতা প্রভৃতির জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিতেছে, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা তাহার পত্তনভূমি স্বরূপ ছিল।’
বলাই বাহুল্য কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা এই বঙ্গদেশের যে নগরের কেন্দ্রে অবস্থিত তার নাম নদীয়া রাজ্যের রাজধানী কৃষ্ণনগর। আঠারো শতকের মধ্যভাগে এই ‘নদীয়া রাজ্য’ (চুরাশি পরগনা, ৩ হাজার ১৫১ বর্গমাইল বিস্তৃত) অচিরেই হয়ে উঠেছিল বাংলার সংস্কৃতির মূল ভরকেন্দ্র এবং কৃষ্ণনগর হয়ে উঠেছিল বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘The Court of Raja Krishnachandra of krishnagar: A centre of culture in the 18th century Bengal’ প্রবন্ধে যা লিখছেন তার তর্জমা করলে কতকটা এমন দাঁড়ায় যে, জলঙ্গি ও ভৈরব জলসিঞ্চিত উর্বর নিম্ন বঙ্গভূমির মধ্যবর্তী এই শহর অবস্থানগত ভাবেও ছিল একই সঙ্গে বাংলার হৃদয় ও মস্তিষ্ক।
রাজনৈতিকভাবে সেই সময়ের অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ শহর যদিও মুর্শিদাবাদ, কিন্তু সেখানকার সংস্কৃতি মধ্যপ্রাচ্য প্রভাবান্বিত আর উনিশ শতক থেকে বাংলার সংস্কৃতির প্রধান ভিত্তিভূমি আজকের যে কলকাতা শহর, তা গড়ে উঠেছিল মূলত ব্রিটিশ প্রভাবে। কিন্তু সুনীতিকুমারের কথায় ‘বাইরের জাঁকজমক ও উত্তরভারতের মুঘল ও রাজপুতদের থেকে ধার করে অনেকটা আত্মস্থ করলেও কৃষ্ণনগরের আদি সাংস্কৃতিক রূপটি পুরোপুরি বাঙালি এবং একধরনের গ্রামীণ সংস্কৃতির, যা এই রাজ্যের বৈশিষ্ট্য কৃষ্ণনগর বাস্তবিকই বাঙালিত্ব না হারিয়ে সর্বভারতীয় ও শহুরে হয়ে উঠেছিল এবং তার মূলভিত্তি ছিল বাংলার গ্রামীণ জীবনচর্চায়।’ বাংলা সাহিত্যের যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব ও প্রথম নাগরিক কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের কাব্য থেকেও ওই রাজধানী শহরের যে নাগরিক পরিশীলন ও রুচির আভাস পাওয়া যায়, তা কোনও অর্থেই বিদেশ থেকে আমদানি করা নয়, তা একান্তই দেশীয়। এই দেশীয় নাগরিকতা নিঃসন্দেহে সেই সময়ের ওই জনপদের সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য একটি অর্জন।
নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নবরত্নসভা (প্রাথমিকভাবে পঞ্চরত্ন) ছিল। সেই সভা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে সব গুণীজন অলঙ্কৃত করে গিয়েছেন, তাঁরা সমসময়ের দিকপাল। সেই সময়ের তিন শ্রেষ্ঠ কাব্যপ্রতিভা বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, রামপ্রসাদ সেন ও রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র ছাড়াও নর্তক শের মামুদ, কলাবৎ গায়ক বিরাম খাঁ, মৃদঙ্গ বাদক সমজখেল সহ সভায় ছিলেন গদাধর তর্কালঙ্কার, কালিদাস সিদ্ধান্ত, কন্দর্প সিদ্ধান্ত, অনুকূল বাচষ্পতি, রামরুদ্র বিদ্যানিধি প্রমুখ জ্যোতিষ্ক। সমসময়ের বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত (প্রধান নৈয়ায়িক), শঙ্কর তর্কবাগীশ, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার, রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত (বুনো রামনাথ), গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সকলেই নদীয়ারাজের অনুদান ও আনুকূল্য পেতেন। আর এই নদীয়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই নব্যন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মভূমি নবদ্বীপ হয়েছিল বাংলা তথা পূর্ব ভারতের শ্রেষ্ঠ সারস্বতক্ষেত্র, পরিচিত হয়ে উঠেছিল ‘বাংলার অক্সফোর্ড’ নামে।
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের হাতে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের শুরু। বঙ্কিম তাঁর অভ্রান্ত মূল্যায়নে ভারতচন্দ্রকে বলেছেন ‘ফাদার অব দ্য মডার্ন বেঙ্গলি’। দীর্ঘদিনের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে ভারতচন্দ্র বাংলা ভাষাকে একধাক্কায় যতটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, ততটা বোধহয় আর পারেননি কেউই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যকৃতিকে বলেছিলেন, ‘রাজকণ্ঠের মণিমালা’। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, হিন্দুস্তানি ভাষা মেলানো মেশানো অভিনব এক বাকভঙ্গি ও প্রাচীন সংস্কৃত ছন্দের অনুকৃতিতে বাংলা কবিতায় এক নিপুণ ছন্দপ্রয়োগ তাঁর বিশেষ কৃতিত্বময় অবদান।
সেই নাগরিক পরিসর থেকেই উঠে এসেছিল বাংলা কথ্যভাষার একটি মান্যরূপ সুনীতিকুমারের মতে ‘ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর কয়েকটি প্রজন্ম ধরে নদীয়ার শান্তিপুরের বাচনভঙ্গিকে বাংলাভাষার বাচন সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসাবে ধরা হয়।’ দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর নাটকে নদীয়ার ভাষা ব্যবহারের কৈফিয়ত হিসাবে আরও দু-কাঠি উপরে চড়ে কিছুটা যেন সদর্পেই বলেছিলেন ‘কৃষ্ণনগর (নদীয়া)-ই পূর্বে বাঙ্গালার রাজধানী ছিল। সুতরাং কৃষ্ণনগরের ভাষাকেই সর্ববাদীসম্মত ভাষা বলিয়া সকলের মানিয়া লওয়া উচিৎ- কলিকাতার ভাষা নহে।’ বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পীদের মধ্যে একজন তথা গদ্যে চলিত ভাষা ব্যবহারের অন্যতম প্রবক্তা প্রমথ চৌধুরীও সর্বান্তকরণে স্বীকার করেছেন তাঁর জীবনে কৃষ্ণনগরবাসের প্রভাবের কথা, ‘কৃষ্ণনগর আসার আগে আমি ছিলাম আধো-আধোভাষী বাঙাল আর কৃষ্ণনগর থেকে যখন গেলাম, হলাম স্পষ্টভাষী বাঙালি।’ এই সব নানা কথা মাথায় রেখে তাই একথা বলা হয়তো খুব একটা ভুল হবে না যে, নদীয়া বাঙালির মুখে ভাষা দিয়েছে।
মননশীল বা শিক্ষিত মানুষের কথাবার্তাতেই শুধু না— এই জনপদের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক কথোপকথনে বাকপটুত্বের সহজ ও সাবলীল উৎসার এতদ অঞ্চলের আত্মিক সমৃদ্ধির লক্ষণ তো বটেই। অবস্থানগত ভাবেই হোক বা নানা সংস্কৃতির মিশ্রণস্থল হিসাবে এই নগর যে উৎকৃষ্ট কথ্য-বাংলাভাষার পীঠস্থান, সে কথা নতুন করে কী আর বলার আছে? আর সেই যুক্তিতে বলাই যেতে পারে বাককুশলতার জন্য প্রসিদ্ধ এই অঞ্চল প্রভাবিত করেছিল ভারতচন্দ্রের রচনাশৈলীকে তাঁর প্রবাদোপম সব চরণ ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়’, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’, ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ / ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ’, ‘জন্মভূমি জননী স্বর্গের গরীয়সী’, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’ ইত্যাদি সৃজনের নেপথ্যে যে এই অঞ্চলের ভাষা আবাদের কোনও অবদান নেই, এমন তো হতেই পারে না।
কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বিদূষক হিসাবে মুক্তারাম মুখোপাধ্যায়, হাস্যার্ণব, রামকেল, শংকর তরঙ্গ প্রমুখের নাম পাওয়া গেলেও গোপালভাঁড় নামক চরিত্রের ঐতিহাসিকভাবে কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। লোককল্পনা থেকে উঠে আসা চরিত্রটি সম্ভবত কাল্পনিক। উনিশ শতকের বটতলা সাহিত্যের হাত ধরে এই গোপাল মিথটির গড়ে ওঠা। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি দেখা যায় বঙ্গজ এই বিদূষক নির্মাণের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় আর কৃষ্ণনগরের জড়িয়ে থাকা গভীর চিন্তনের বিষয়। কৃষ্ণনগর তৎকালীন বঙ্গসংস্কৃতির অঘোষিত ভরকেন্দ্র না হলে বাংলায় আঠারো শতকের আরও অনেক সমৃদ্ধ নগর থাকতে এর ভিত্তিভূমি হয়ে উঠল এই শহর। এত নৃপতি থাকতে কৃষ্ণচন্দ্ৰকেই বা কেন দেখানো হল তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা হিসাবে? অনেকের মতে, গোপাল আসলে কৃষ্ণনগর রাজসভাকেন্দ্রিক সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষের একধরনের স্বতঃস্ফূর্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধেরই মূর্ত-প্রতীক। অবশ্য শুধু কৃষ্ণচন্দ্রের আমল বলেই তো না, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তাঁর উত্তরপুরুষ মহারাজা গিরিশচন্দ্রের আমলেও কৃষ্ণনগর রাজসভায় রস রসিকতার চর্চার ধারা বজায় ছিল। গিরিশচন্দ্রের সভা অলঙ্কৃত করেছেন রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী।
কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে সঙ্গীতচর্চায় যেমনভাবে গোয়ালিয়র ঘরানার কলাবৎ বিসরাম খাঁয়ের নাম উঠে আসে, তেমনই ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এর গীতরূপ পরিবেশন করার জন্য নীলমণি জিউসাই-এর নামও বাংলা শাক্তসঙ্গীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্মাতা রামপ্রসাদ সেন সৃষ্ট ধারা ‘রামপ্রসাদী’ নামে অচিরেই হয়ে উঠেছিল বাংলাগানের একটি প্রধান শ্রীছাঁদ। গিরিশচন্দ্রের আমলে দিল্লির বিখ্যাত গায়ক কায়েম খাঁ ও তাঁর বিখ্যাত তিনপুত্র মিয়াখাঁ, হম্মু খাঁ ও দেলাওর খাঁ নদীয়ার রাজদরবারে এসে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন পরবর্তী কালে এই সময় জুড়ে দরবারি সঙ্গীতচর্চায় কৃষ্ণনগর হয়ে উঠেছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। সেই সময় পাখোয়াজ সঙ্গতে ধ্রুপদ গাওয়ার ঐতিহ্য বঙ্গদেশে হাতে গোনা যে সব জায়গায় ছিল তার মধ্যে কৃষ্ণনগর অন্যতম প্রধান সন্দেহ নেই।
পরবর্তী সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের প্রসঙ্গ আলোচনায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানুষটি সম্ভবত দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। উনিশ শতকের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গদ্যলেখক হিসাবে পরিচিত হলেও তাঁর জীবনের সমধিক আলোচনাযোগ্য দিক হচ্ছে তাঁর সঙ্গীত জীবন। তিনি নিজে ছিলেন সুকণ্ঠ গায়ক। কিন্তু গাওয়ার জন্য উপযুক্ত ভালো গানের অভাব বোধ করায় তিনি নিজেই ‘গীতমঞ্জরী’ নামক একটি অসামান্য গানের বই লিখে ফেলেন। হিন্দি গানের ছাঁদে লেখা এইসব গানের বিষয় মূলত ঋতুবর্ণনা, জন্মতিথি, অপত্য মাতৃস্নেহ, বাৎসল্য সন্তান লাভ, বিবাহ ইত্যাদি। শুধু সঙ্গীতজ্ঞই নন, তিনি ছিলেন সমকালীন বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ খেয়াল গায়ক হিন্দুস্তানি কলাবন্তী সঙ্গীতের অনেক শ্রীছাঁদের সন্ধান মেলে সেই সময়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য এই সঙ্গীতগ্রন্থে। কলকাতায় প্রথম হারমোনিয়াম যদি আসে ঠাকুর বাড়িতে, তবে আজকালকার গানবাজনায় প্রায় অনিবার্য এই বিলেতি যন্ত্রটি আসে কৃষ্ণনগরের এই দেওয়ান বাড়িতে। তাঁর সঙ্গ পাওয়ার জন্য কৃষ্ণনগরে ছুটে এসেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, তাঁর ভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ নক্ষত্র। আর ‘নীলদর্পণ’ খ্যাত দীনবন্ধু মিত্র তো ছিলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চার উত্তরাধিকার ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হয়েছে তিন পুরুষ ধরে যথাক্রমে দ্বিজেন্দ্রলাল ও দিলীপকুমার রায়ের মধ্যে দিয়ে। একেই অনেকে বলে থাকেন কৃষ্ণনগর ঘরানা, যা শুরু হয়েছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা থেকে।
ভাষা ও সাহিত্য, দেশজ নাগরিকতা বা শুধু সঙ্গীতই নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও নদীয়ার রাজধানী কৃষ্ণনগর হয়ে উঠেছিল পালাবদলের অগ্রণী। পর্যাপ্ত ঋণের বোঝায় ন্যুব্জ হয়েও কৃষ্ণচন্দ্র যেভাবে অগণিত মন্দির, মেলা, মোচ্ছবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়েছেন, সচেতনভাবে বা নিজের অজান্তেই নিয়ে এসেছেন এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ। নদীয়ারাজ রুদ্র রায় ১৬৭৬ সালে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করলেও তাঁর প্রপৌত্র কৃষ্ণচন্দ্র তাকে সর্বজনীন রূপ দেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তে দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই লিখেছেন, ‘দুর্গোৎসব বাংলাদেশের পরব, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে এর নামগন্ধ নাই । বোধহয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল হতেই বাংলায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব।’ সমারোহের সঙ্গে দুর্গোৎসব যে নদীয়া রাজবাড়ি থেকেই বাংলাদেশের সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়ে, তা ‘সমাচারদর্পণ’ পত্রিকাতেও লেখা হয়। শুধু দুর্গাপুজোই না, কথিত আছে কৃষ্ণচন্দ্র নাকি তাঁর আমলে ফরমান জারি করে এই নদীয়া রাজ্যে দশ হাজার কালীপুজোও করান। কালীপুজোর পাশাপাশি অন্নপূর্ণা, জগদ্ধাত্রী, রাজবল্লভী প্রভৃতি দেবীর পুজোয় প্রভূত উৎসাহ দান করে তিনি বাংলায় ক্রমবর্ধমান বৈষ্ণব সংস্কৃতিকে কাউন্টার করতে চান, তৈরি করতে চান বিরুদ্ধস্রোত।
এই নদীয়ার রাজাদের আমলেই নিম্নবর্গীয় বৌদ্ধদের (ডোম, হাড়ি) চরক উৎসব হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি দ্বারা অধিকৃত হয় এবং হয়ে ওঠে শিবের গাজন (উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়— কৃষ্ণনগর ও নবদ্বীপের মাঝামাঝি সুবর্ণবিহারের গাজন)। এই রাজাদের তত্ত্বাবধানেই নবদ্বীপ নিকটবর্তী পারপুর বা পাহাড়পুরের বৌদ্ধশিলাগুলির গৌরীপট্ট ছাড়াই শিবত্বপ্রাপ্তি ঘটে। শাক্ত দেবদেবীর পুজোয় পঞ্চ ম-কার আদি তান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব হ্রাস করে, তিনি যথাসম্ভব এইসব পুজোগুলিকে শান্ত গার্হস্থ্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। যার ফলে নবাবি আমলের পতনের পর থেকেই হিন্দু গৃহাঙ্গনে পুজোআচ্চার প্রবল জোয়ার দেখা যায়। সমাজতত্ত্বের দৃষ্টি থেকে এও এক নিঃশব্দ যুগান্তরের হদিশ বইকি।