বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
জগদীশচন্দ্র বসু
এক শিশি ‘কুন্তলীন তেল’ ঢেলে উত্তাল সমুদ্রকে তিনি শান্ত করতে চেয়েছিলেন। মা-র পুরনো বাসনপত্র গলিয়ে বাড়ির কামারশালায় কামান তৈরির ভূত মাথায় চেপেছিল। জন্ম তাঁর ১৮৫৮-র ৩০ নভেম্বর, ঢাকা থেকে ৩৫ মাইল দূরে রাড়িখাল গ্রামে। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে তিনি, জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন মা-র নয়নের মণি। বিদেশ গিয়ে ম্লেচ্ছ সংসর্গে জগদীশ ডাক্তারি পড়বেন তাতে ছিল মা-র ঘোরতর আপত্তি।
প্রবাসের মায়া কাটিয়ে জগদীশ তদ্দিনে কলকাতায়। গ্যালেনার মধ্যে দিয়ে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ প্রক্ষেপণের নেশায় মেতেছেন। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের জাদুস্পর্শে লেড সালফাইড ‘গ্যালেনার’ বিক্ষেপ ঘটে, প্রাণে খুশির জোয়ার আসে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে ‘গ্যালেনা’ তাই পরম স্নেহে বুকে আঁকড়ে রাখে। তড়িৎমোক্ষণ বন্ধ হলে ‘গ্যালেনা’ আবার নিস্তেজ, নিরুত্তাপ। এই ‘কন্টাক্ট সেন্সিটিভিটি’ শুধু জড়পদার্থের ধর্ম নয়। লজ্জাবতীর পাতা (মিমোসা পিউডিকা) বা বনচাঁড়াল (ডেসমোডিয়াম জাইরান্স) স্পর্শ করলেও তারা কুঁকড়ে যায়। ‘ভেজিটেবল ইলেক্ট্রিসিটির’ কল্যাণেই পাতার কুঁকড়ে যাওয়া। অগাস্টাস ওয়ালারের বহুকাল আগেই জগদীশচন্দ্র যার প্রমাণ দিয়েছিলেন। লজ্জাবতী বা বনচাঁড়াল যেভাবে বাইরের উদ্দীপনায় সাড়া দেয় ‘গ্যালেনা’ও ঠিক সেভাবেই উদ্দীপ্ত হয়। উদ্ভিদের রয়েছে ‘ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল পালস’ বা স্নায়ুতন্ত্র। যার দ্বারা গাছেরাও মনে রাখতে, শিখতে এমনকী চিনতেও পারে। ‘অ্যাকশন পোটেনশিয়াল’ মারফত বিভিন্ন উদ্দীপক যেমন আলো-তাপ-আঘাত-বিষ-চেতনানাশকে মানুষের মতোই যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে। সে যন্ত্রণা যদিও অব্যক্ত! উদ্ভিদের অনুভূতিবাহক ‘ফ্লোয়েম’, প্রাণীর ‘সাইন্যাপস’।
স্টেথোর মতো উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দনকে জগদীশচন্দ্র মেপেছিলেন ‘ক্রেসকোগ্রাফে’। ১৯২৯ সালে ‘গিল্ডহাউস বক্তৃতায়’ উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দনের অভূতপূর্ব ঘটনাটিকে তিনি বিশ্ববাসীর গোচরে এনেছিলেন। প্রাণীদের মতোই যে উদ্ভিদের উত্তেজনা-উদ্দীপনা আণবিক স্তরে অক্সিন-অ্যাকটিন-মায়োসিন-অ্যাসিটাইলকোলিনের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়, দেখিয়েছিলেন তাও। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের জনকও নিঃসন্দেহে জগদীশচন্দ্র। ‘টাইম ম্যাগাজিন’ তাঁর এই হীরক-শুভ্র উদ্ভাবনকে বলল বুজরুকি। রয়েল সোসাইটি বুজরুকি নিরসনের ভার দিল স্যার উইলিয়াম ব্র্যাগ আর স্যার উইলিয়াম বেলিসকে। উদ্ভিদের হৃৎস্পন্দনকে এক কোটি গুণ বড় করে ‘ক্রেসকোগ্রাফের’ মাধ্যমে গোটা পৃথিবীর কর্ণগোচর করলেন জগদীশচন্দ্র। বিমূঢ়-স্তম্ভিত-লজ্জিত-অবনত ‘টাইম’।
‘গ্যালেনার’ শরীরে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ যে লজ্জাবতীর মতোই শিহরণ জাগায়, তার হদিশ প্রথম দিয়েছিলেন ম্যাক্সওয়েল-হার্ৎস-অলিভার লজ। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে পাকড়াও করার চেষ্টাও তাঁরা শুরু করেছিলেন। সেই চেষ্টারই মধুরেন সমাপয়েৎ জগদীশচন্দ্রের হাতে। হার্ৎসের ৬৬ সেমি তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে ৬ সেমিতে নামালেন লজ। জগদীশচন্দ্র লজের ৬ সেমি তরঙ্গকে বানালেন ৫ মিলিমিটারের লিলিপুট মাইক্রোওয়েভ। ‘তেজোমিটার’ আর ‘গ্যালেনা রিসেপ্টরের’ মাধ্যমে সেই তরঙ্গ প্রেরণ আর গ্রহণও করে তুললেন সুচারু-সাবলীল। ১৯০১-র ১০ মে, ‘রয়েল সোসাইটির’ শুক্র-সন্ধ্যার জমাটি আড্ডায় রেডিওর জন্ম মুহূর্তের সাক্ষী রইল গোটা বিশ্ব। রয়েল সোসাইটির বক্তৃতার দিন-দুয়েক আগে বেতারতরঙ্গের যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্যসহ জগদীশের খেরোর খাতাটি খোয়া যায়। আর সেই খাতা হাতিয়েই নাকি নোবেল পকেটে পোরেন মার্কনি। ভগিনী নিবেদিতা আর সারা বুলের নিরন্তর ঠেলা-গুঁতোয় ১৯০৪ সালে বেতারের পেটেন্ট (নং-৭৫৫৮৪০) জুটলেও আত্মভোলা জগদীশচন্দ্র পেটেন্টের পুনর্নবীকরণের কথা গেলেন বেমালুম ভুলে।
শম্ভুনাথ দে
বার তিনেক নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত তিনি— ডাঃ শম্ভুনাথ দে। আবিষ্কার করেছিলেন কলেরা-টক্সিন। জন্ম তাঁর ১৯১৫-র ১ ফেব্রুয়ারি। রবার্ট কখ কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করে জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু কলেরা মহামারীতে কলেরা জীবাণুর নেই কোনও ভূমিকা। কলেরার জীবাণু ভিব্রিও কলেরির দেহ-নিঃসৃত অধিবিষ বা কলেরা-টক্সিনই যে নাটেরগুরু তা কল্পনাও করতে পারেননি কখ।
নোবেল কমিটি কেন কলেরা-টক্সিন আবিষ্কারকের পাদপ্রান্তে নত? কারণ কলেরা-টক্সিন আবিষ্কৃত না হলে কলেরা মহামারীকে কিছুতেই রোখা যেত না। রবার্ট কখ ভেবেছিলেন সালমোনেল্লা-সিজেল্লা-সিউডোমোনাসের মতো কলেরার জীবাণুও ক্ষরণ করে ‘এন্ডোটক্সিন’। ‘এন্ডোটক্সিন’ তো নয়ই, মানবশরীরের ক্ষুদ্রান্ত্রেই কেবল কলেরার জীবাণু ক্ষরণ করে ‘এক্সোটক্সিন’। ক্ষুদ্রান্ত্রের ঝিল্লিকে ফোঁপরা করে এক্সোটক্সিন শরীরের অত্যাবশ্যকীয় জল-সোডিয়াম-পটাশিয়াম-বাইকার্বনেটকে ঠেলে বের করে দিতে থাকে।
১৮৮৪-তে কলেরার জীবাণু আবিষ্কারের ৭৫ বছর পর শম্ভুনাথ দে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন কখের অনুমান কতটা ভুল ছিল। নোবেল ততদিনে কখের জিম্মায়। এইডস-হেপাটাইটিসের মতো কলেরা রক্তঘটিত রোগ নয়। গবেষণাগারে কলেরার জীবাণু রক্তে প্রবেশ করিয়েও তাই কলেরার সাক্ষাৎ পাননি কখ ও তাঁর অনুগামীরা। শম্ভুনাথের অনিকেত গবেষণাপত্রটি ১৯৫৯ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার সেলেব দ্বীপপুঞ্জ থেকে কলকাতায় আগমন কলেরার এক খানদানি কুটুমের। নাম তার এল-টর বায়োটাইপ। এল-টর বায়োটাইপের শরীরে বেমালুম হাপিশ কলেরা-টক্সিন। নির্বিষ কলেরার সঙ্গে যুদ্ধে নামতে স্বভাবতই নারাজ শম্ভুনাথ। শম্ভুনাথের পড়াশোনা, গড়িবাটি হাইস্কুল থেকে মহসিন কলেজ হয়ে মেডিক্যাল কলেজ— সবটাই জলপানির টাকায়। মেডিক্যাল কলেজের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক এম এন দে-র উৎসাহেই ‘লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ’-এর স্যার ক্যামেরনের কাছে শম্ভুনাথের গবেষণায় নাড়াবাঁধা। স্যার ক্যামেরন ছিলেন প্রফেসর দে-র বিশেষ বন্ধু। ইংল্যান্ডে ‘হাইড্রোকেফালাস’ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন শম্ভুনাথ। বিভিন্ন দুর্বিপাকে সে গবেষণায় দাঁড়ি পড়ল অচিরেই। প্রফেসর ক্যামেরনের পরামর্শে ‘পালমোনারি ইডিমা’ নিয়ে এমন অত্যুৎকৃষ্ট গবেষণা করলেন শম্ভুনাথ যে ১৯৪৯-এ মিলল পিএইচডি। দেশে ফেরা সে বছরই।
কলেরায় আগ্রহ উৎসাহ লন্ডনে থাকাকালীনই। দেশে ফিরে নীলরতন সরকার হাসপাতালে ‘চেয়ার অফ প্যাথলজি’। সব কলেরা রোগীর ঠিকানা তখন কেয়ার অফ শম্ভুনাথ। ১৯৫৫-তে রয়েল সোসাইটির ‘নাফিল্ড ফাউন্ডেশনে’র অর্থানুকূল্যে পুনরাগমন গ্রেট-ব্রিটেনে। ই কোলাই নিয়ে বলবেন। কানায় কানায় পূর্ণ রয়েল সোসাইটির প্রেক্ষাগৃহ। মন্ত্রমুগ্ধ একরাশ শ্রোতা। বিলেত থেকে প্রত্যাবর্তন এবার মেডিক্যাল কলেজে। ওয়েলকাম ট্রাস্টের আমন্ত্রণে শেষবারের জন্য বিলেত ভ্রমণ ১৯৬০-’৬২-তে। উপলক্ষ লন্ডন ইউনিভার্সিটির ফিজিওলজির ডিএসসি ডিগ্রি গ্রহণ।
১৯৭৮-এ ‘নোবেল ফাউন্ডেশন’ তাঁকে ৪৩তম ‘নোবেল সিম্পোসিয়াম অন কলেরা রিলেটেড ডায়ারিয়াস’-এ বক্তব্য রাখার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাল। বিষয় ই কোলাই-এর সেরোটাইপিং। শম্ভুনাথ দে-র জ্ঞান-প্রজ্ঞায় অভিভূত নোবেল কমিটি। অথচ, ১৯৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোটস মেডাল’ ছাড়া সারাজীবনে কোনও সম্মান জোটেনি তাঁর। ভারতের কোথাও পঠনপাঠন বা গবেষণার কাজে মিতবাক মানুষটি কখনও ডাক পাননি। নোবেল কমিটির প্রথম নিমন্ত্রণ পত্রটাও কারওর অসূয়ায় ডাঃ দে-র হাতে পৌঁছয়নি। গবেষণায় অনুদান জুটেছে ছিটেফোঁটা, পকেটের টাকা খরচ করে চালিয়েছেন গবেষণা। তাঁর জ্ঞান-দক্ষতা-পারদর্শিতা নিয়েও তোলা হয়েছে প্রশ্ন। ‘কারেন্ট কনটেন্টস’র একটি সংখ্যা ডাঃ শম্ভুনাথ দে-কে নিবেদন করবেন বলে সম্পাদক ইউজিন গারফিল্ড তাঁর সম্মতি আদায়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কোমায় আচ্ছন্ন তিনি যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, তখন সেই চিঠি এসে পৌঁছল।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
১৯৩১-এর ১৬ জানুয়ারি, হাজারিবাগে মামারবাড়িতে জন্ম তাঁর। তিনি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও ধাত্রীবিদ— ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো তাঁরও পিএইচডি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনিও ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্রের মতো দৃঢ়চেতা, নিজের ক্ষমতা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। কর্মোদ্যোগী। অসামান্য প্রতিভাধর। ক্রান্তদর্শী।
তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে থেকে মাত্র ৪টি বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাতেই তাঁর অভ্রংলিহ প্রতিভার কিছুটা আঁচ মিলবে। পুরুষ হরমোন ‘টেস্টোস্টেরন’ মহিলাদের বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় ভীষণ কার্যকরী প্রথম তিনিই দেখালেন। মহিলাদের রজঃনিবৃত্তির পর তাদের মূত্র-নিঃসৃত হরমোন (এইচএমজি) থেকে সংগৃহীত যৌন হরমোন ‘গোনাডোট্রপিন’ ডিম্বাশয়ের সক্রিয়তা বাড়ায়। মসৃণ করে ডিম্বাণু নিঃসরণ। গর্ভবতী মহিলাদের মূত্র থেকে মেলে এইচসিজি বা ‘হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন’। শারীরবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকে এতকাল লেখা ছিল ‘ট্রোফোব্লাস্ট’ সেল থেকে মেলে ‘এইচসিজি’। তিনি প্রমাণ করলেন, ট্রোফোব্লাস্ট নয়, এন্ডোমেট্রিয়াম বা জরায়ুগাত্রের ‘ডেসিডুয়াল সেল’ থেকে মেলে ‘এইচসিজি’। আইভিএফ বা কৃত্রিম প্রজননে দুটিই কালজয়ী আবিষ্কার।
সাতের দশকে আলট্রাসাউন্ড ছিল কপোলকল্পনা। আলট্রাসাউন্ডের বিকল্পে সুভাষ একটি প্রোবের সাহায্যে (কল্পোটমি) নিখুঁত দক্ষতায় ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে চমকে দিলেন বিশ্বকে। বর্তমানে তাঁর দেখানো পথেই আইভিএফের ডিম্বাণু সংগৃহীত হয়। মানবভ্রূণকে (ব্লাস্টোসিস্ট) ড্রাই-আইস (কঠিন কার্বন ডাই-অক্সাইড) ও তরল নাইট্রোজেনে হিমায়িতকরণ বা ‘ক্রায়োপ্রিজার্ভ’ ছিল তাঁরই মস্তিষ্ক-প্রসূত। অজ্ঞ-অর্বাচীন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা নিদান দিয়েছিলেন ৫৩ দিন হিমায়িতকরণে ভ্রূণ নাকি ৮ ইঞ্চি লম্বা হয়ে যাবে। জিনের চরিত্র যাবে পাল্টে। প্রকৃতপক্ষে হিমায়িতকরণেই সুস্থ-অবিকৃত থাকে ভ্রূণ, অটুট, অপরিবর্তিত থাকে জিন-চরিত্রও। কৃত্রিম প্রজননে ‘ক্রায়োপ্রিজার্ভ’ই বিশ্বজনীন। তিনি দেখালেন ৮টি কোষের ভ্রূণ (ব্লাস্টোসিস্ট) জরায়ুতে সবথেকে ভালোভাবে পরিপোষিত হয় যদি সেই রজঃচক্রেই নিষিক্ত ভ্রূণটিকে প্রোথিত না করে পরবর্তী কোনও রজঃচক্রে তা করা হয়। কয়েকটি স্ত্রী-হরমোনের বিরূপ প্রতিক্রিয়াকেও সহজে পাশ কাটানো যায় তাতে। ভ্রূণটির স্বাভাবিক বৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়।
সুভাষবাবুর তত্ত্বাবধানে ১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি দুর্গা বা কানুপ্রিয়া ভূমিষ্ঠ হল। ১৯৭৮ সালের ১৯ অক্টোবর ডাঃ মুখোপাধ্যায় এই নলজাত শিশুর জন্মবৃত্তান্ত সবিস্তার বৈজ্ঞানিক অনুষঙ্গে স্বাস্থ্যদপ্তরে পাঠালেন। সুভাষের দাবিদাওয়া কতটা সত্যি জানতে তৎকালীন রাজ্য সরকার ‘দাশগুপ্ত কমিটি’ গড়ল। রিপোর্ট পরীক্ষা করে এই কমিটি রায় দিল, সবটাই বুজরুকি। একদল সরকারি তাঁবেদার, স্রেফ ক্ষমতার লোভে, তাঁদের জ্ঞানগম্মিকে বন্ধক রেখে রিপোর্ট সুভাষিত করলেন দুটি শব্দে— ‘আনবিলিভেবল’ অ্যান্ড ‘অ্যাবসার্ড’। ১৯৮১ সালের ১৯ জুন অকাল আত্মহননে ধরাধাম থেকে চিরবিদায় নিলেন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
১৯৮৬ সালে ভারতের প্রথম ‘টেস্ট-টিউব বেবি’র জনক হিসাবে ডাঃ টি সি আনন্দকুমারের কপালে জুটল সরকারি স্বীকৃতি। ২০ বছর পরে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নলজাতক শিশুর গবেষণা প্রবন্ধের পাতা ওলটাচ্ছিলেন ডাঃ আনন্দকুমার। গভীর অভিনিবেশে ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা কর্মকাণ্ড অধ্যয়নের পর লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল তাঁর। সেই মুহূর্তে প্রেস কনফারেন্স ডেকে তিনি সারা পৃথিবীকে জানালেন ভুল হয়ে গিয়েছে বিলকুল। ভারতে নলজাত শিশুর প্রথম সার্থক রূপকার ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় তিনি নন মোটেই। আনন্দকুমার না থাকলে চির-বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতেন সুভাষ। ‘ডিকশনারি অব মেডিক্যাল বায়োগ্রাফির’ আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে স্যার রোনাল্ড রস, ইউ এন ব্রহ্মচারীর সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে শুভ্র-সমুজ্জ্বল যে বাঙালি, তিনি ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
দিলীপ মহলানবিশ
১৯৩৪-এর ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের বাজিতপুরে জন্ম তাঁর। ডাক্তারি পাশ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৫৮-তে। মেডিক্যালের শিশু বিভাগেই শুরু ইন্টার্নশিপ— তিনি ডাঃ দিলীপ মহলানবিশ। ১৯৬০-এ যোগ দিলেন লন্ডনের ‘এনএইচএসএ’। প্রথম ভারতীয় হিসাবে মাত্র ২৮ বছরে ‘কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফর চিলড্রেনে’ রেজিস্টার। বহু নিঃসঙ্গ বিনিদ্র বরফঝরা রাত পেরিয়ে লন্ডন থেকেই ডিসিএইচ। এমআরসিপি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিদেশে হাতেকলমে কাজের অভিজ্ঞতা ব্যাগে পুরে ১৯৬৪-তে দেশে ফিরলেন দিলীপবাবু। ‘ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট’ নিয়ে শুরু করলেন কাজ বেলেঘাটা আইডিতে। ফুলের মতো নিষ্পাপ ফুটফুটে শিশুদের সূচ ফুটিয়ে কলেরার ইন্ট্রাভেনাস চালাতে বড্ড কষ্ট হতো তাঁর। বিকল্প রাস্তার সন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন বেশ কিছুকাল আগেই। ডায়ারিয়া আক্রান্ত বেশ কিছু শিশু আইডিতে ভর্তি হল। ন্যাজো-গ্যাস্ট্রিক রুটে ওআরএস চালানোর সুযোগ হাতে এসে অতর্কিতে ধরা দিল। কলেরা বা ডায়ারিয়ায় দ্রুত শরীর থেকে জলের সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় খনিজ লবণ বেরতে থাকে। ডিহাইড্রেশন বা জল-বিয়োজনের ফলে রক্তচাপ কমতে থাকে। জলসাম্য বজায় রাখতে পারলেই কলেরা বা ডায়ারিয়া জব্দ। নাসাপথে শিশুদের বিন্দুমাত্র যন্ত্রণা না দিয়ে নল মারফত দিলীপবাবু সরাসরি পাকস্থলীতে নিয়ে ফেললেন ওআরএসকে। রাতারাতি ফল মিলল, শিশুরা সত্বর সুস্থ হতে শুরু করল। সরকার বা শিশুদের মা-বাবার সন্দেহ-সংশয় থেকেই গেল। সূচ না ফুটিয়ে আবার ডায়ারিয়ার চিকিৎসা হয় নাকি! হঠাৎই ভীম-প্রলয়ে হাজির ১৯৭১-এর সেই কালোদিন। মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের স্রোতে বনগাঁ সীমান্ত প্লাবিত। বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে থাকা মানুষের মধ্যে দেখা দিল কলেরা মহামারী। দিলীপবাবুর ওপর দায়িত্ব বর্তাল কলেরা রোগীদের বাঁচানোর। বমি আর দাস্তের পিচ্ছিল স্রোতে হাঁটু-গেড়ে বসে ‘ড্রিপ’ চালাচ্ছেন দিলীপবাবু। আচম্বিতে ইন্ট্রাভেনাসের ভাঁড়ার গেল শূন্য হয়ে। দিলীপবাবু ছুটলেন বড়বাজার। কেনা হল বস্তা বস্তা নুন-চিনি-সোডিবাইকার্ব। ১ লিটার জলে ২২ গ্রাম গ্লুকোজ বা চিনি, ৩.৫ গ্রাম নুন বা সোডিয়াম ক্লোরাইড আর ২ গ্রাম বেকিং সোডা বা সোডিয়াম বাই-কার্বনেটের অনুপম মিশ্রণে তৈরি হল জীবনদায়ী ওআরএস। ১৬ লিটারের ড্রামে কলের মুখ লাগিয়ে ওআরএসের জল-বিতরণ শুরু হল। ম্যাজিকের মতো কাজ হল। মৃত্যুহার একলাফে ৩০ শতাংশ থেকে কমে হল ৩ শতাংশ। ১৯৭১ সালের ২৪ জুন থেকে ৩০ আগস্ট দিলীপবাবু জান বাজি রেখে, নাওয়াখাওয়া ভুলে আবিশ্ব পৌঁছে দিলেন ওআরএসের জয়গাথাকে।
ওআরএসের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার কারণ একটাই— বাড়িতে খুব সহজে বানানো যায় এই মহৌষধ। নির্বিবাদে খাওয়ানো যায়। ধীমান বড়ুয়া তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য-সংস্থার বড়কর্তা। তিনি সটান চলে এলেন বনগাঁয়, দিলীপবাবুর অ-মানুষী কাজকম্ম স্বচক্ষে দেখতে। মুগ্ধ ধীমানবাবু। তৎক্ষণাৎ ওআরএসকে স্বীকৃতি দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৯৮০-এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৯০-এর প্রথমার্ধ, হু-র ‘ডায়ারিয়া ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের’ মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে বিশ্বের ৩০টি দেশে বিরামহীন চরকি-পাক কাটলেন দিলীপবাবু।
সূচের পরিবর্তে জলে গোলা ওআরএসের গোটা কর্মকাণ্ডটা ১৯৭৩-এ দিলীপবাবু লিপিবদ্ধ করলেন ‘জনস হপকিনস মেডিক্যাল জার্নালে’। ল্যানসেট আভূমি প্রণত হয়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কারের তকমায় ভূষিত করল ওআরএস-কে। ওরাল হোল সেল কলেরা ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগের পিছনেও মূল কারিগর দিলীপবাবু। সেটিও শোরগোল-ফেলা আবিষ্কার। আজ অশীতিপর দিলীপবাবু মনে করতে পারেন না অতীব গুরুত্বপূর্ণ সে আবিষ্কারের বিন্দুবিসর্গও। মনে করতে পারেন না যে ‘প্লসে’ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে প্রথম জ্বলজ্বলে নামটিই তাঁর।
২০০২ সালে ওআরএসের সফল প্রবর্তক হিসাবে কর্নেল ও কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে ‘পলিন’ প্রাইজে সম্মান জানিয়েছিল দিলীপবাবুকে। একই কাজের স্বীকৃতিতে, ২০০৬ সালে পেয়েছিলেন থাইল্যান্ডের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘মাহিডল অ্যাওয়ার্ড’। ‘পলিন’ প্রাইজের স্মারকটিও আজ অমিল। নিজের বাড়িতে, ১৯৯১-তে শুরু করেছিলেন ‘সোসাইটি ফর অ্যালায়েড স্টাডিজ’। ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীরা যাতে হাতেকলমে কাজ শিখতে পারে। মিলতে পারে দিলীপবাবুর কতিপয় সার্থক উত্তরসূরি। মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই ‘সোসাইটি ফর অ্যালায়েড স্টাডিজ’। নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আজ চোখের কোণটা তাঁর ভিজে যায় বারবার। স্মিত হাসির আড়ালে ঝরে পড়ে একরাশ দলা-পাকানো অভিমান। পড়ন্ত বিকেলে জানলার ফাঁক গলে চুইয়ে আসা রোদে ডুকরে ওঠে এক কিংবদন্তি বিজ্ঞানীর অগ্নিভ প্রব্রজ্যা। শ্রান্ত মেঘেরা দূর আকাশের কোলে থমকে থেমে স্যালুট জানায় নতমস্তকে। ঘরে ফেরা পাখিরা তারস্বরে ধিক্কার জানিয়ে যায় আত্মঘাতী বাঙালির বিস্মরণের চিরাচরিত ঐতিহ্যকে।
..........................................
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়