পিতার স্বাস্থ্যহানি হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
বিল্টু বলল— ‘আজ্ঞে, মিতা বক্সি।’
বাজখাঁই গলায় দ্বিতীয় প্রশ্ন ধেয়ে এল, ‘কন্যার পিতার নাম?’
বিল্টু প্রায় বলে ফেলেছিল জগা’দা, তবে শেষ মুহূর্তে চেপে গেল। জগা’দা কখনও বাপের নাম হতে পারে না।
কিন্তু চেপে গেলেও হবে না, নাম একটা বলতেই হবে। অথচ জগা’দার ভালো নাম কিছুতেই মনে আসছে না বিল্টুর। অনেক ভেবে সে বের করে ফেলল একখানা খাপে খাপ মেলানো নাম। বলল, ‘মনে পড়েছে স্যার... মেয়ের নাম মিতা বক্সি, বাবার নাম পিতা বক্সি।’
রেজিস্ট্রার ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, ‘পিতা বক্সি! এরকম আবার নাম হয় নাকি?’
নাছোড় বিল্টু বলল, ‘কেন হবে না স্যার, হতেই পারে। প্রপার নাউন।
ভাগ্য ভালো হলে এই করোনার টাইমে যে কোনও সময়ে তিনি পরমপিতাও হয়ে যেতে পারেন! শুধু শুধু একখানা অরিজিনাল নাম খরচা করে কী লাভ স্যার?’
দুর্যোগ পাতলা হলেও তার রেশ পুরোপুরি কাটেনি। এখনও মুখে মাস্ক, পকেটে স্যানিটাইজার। কলেজ স্ট্রিটে পড়ন্ত বিকেলে সেদিন শুধুমাত্র মাস্কের কারণে যৎপরনাস্তি অপমানিত হলেন বোসবাবু। অত্যন্ত ভদ্র, পড়ুয়া, মগ্ন পাঠক, মধ্য পঞ্চাশের বোসবাবু ফুটপাতের দোকানে জনৈক কমবয়সি, চটপটে, দক্ষ, কথাবার্তায় চৌখস দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে ভালো অমনিবাস কোথায় আছে বলবেন ভাই?’
ক্রেতা ও বিক্রেতা দু’জনের মুখেই মাস্ক। সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনে প্রায় দেড়-দু’ফুট দূর থেকে ভদ্রজনোচিত মৃদু গলায় বোসমশাই প্রশ্নটা করেছিলেন। আহা, দোকানদারের কান দু’টি দেখে তার বড় মায়া হচ্ছিল—তাতে আর একটুও জায়গা নেই। চশমার ডাঁটি, মাস্কের ইলাসটিক, মোবাইলের তার ও শীতের টুপিতে তাঁর কান ওভার লোডেড। বোসবাবুর প্রশ্নটা এইসব প্রবল বাধা অতিক্রম করে কী ভাষায় যে তাঁর কানে ঢুকেছিল, তা তিনিই জানেন। চোখ নাচিয়ে দোকানদার জবাব দিলেন, ‘ভালোমন্দ কোনও রমণীই এখানে বাস করেন না, ভুল জায়গায় এসেছেন। অন্য জায়গায় যান।’
বোসমশাই অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন, রাগে গা রি রি করে উঠল। কিন্তু ভদ্র বাঙালি অপমানিত হলে আজকাল আর তর্ক-ঝগড়া করে না, চুপিসারে কেটে পড়ে। বোসবাবুও তাই করলেন। কেবল প্রস্থানের আগে, যাত্রাপালায় যেমন বীরযোদ্ধা তলোয়ারখানা সশব্দে খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, তিনিও তেমন এক হ্যাঁচকা টানে মাস্কটা খুলে ফেললেন। তাতে শব্দ হল না, উল্টে ইলাসটিক গেল ছিঁড়ে। কুড়ি টাকা ভোগে।
বাগবাজার ফেরিঘাট থেকে একটু এগিয়ে বাঁ-দিকে একটা গলি, ঠিক নাম জানা নেই রাস্তাটার, সেখানে দুই কি তিন নম্বর বাড়িটা বোসমশাইয়ের। সবুজ দরজা। দরজার সামনে দু’দিকে দুটো লাল রঙের রোয়াক। একটায় লুডোর ছক আঁকা, অন্যটা দাবার বোর্ড। যথাক্রমে গিন্নি ও কর্তার জন্য। সকাল, লেট সকাল, এমনকী সন্ধে রাতের টিমটিমে আলোতেও দুই প্রৌঢ়কে সেখানে দাবা বোর্ডের দু’পাশে চিন্তামগ্ন অবস্থায় দেখেননি, এরকম লোক গোটা বাগবাজারে একজনও আছে কি না সন্দেহ।
দুই প্রৌঢ়ের একজন এই বোসবাবু। পুরো নাম বাবর বোস। অবাক হবেন না, পাড়ার লোক নয়, এ তাঁর নিজের পিতামহ স্বর্গত পাঁচু বোসের দেওয়া নাম। পিতামহের বিশ্বাস ছিল নাতির নাম বাবর হলে ‘বাবার হইল আবার জ্বর...’ ক্রম অনুসারে সামনের ছ’প্রজন্ম তারা বাগবাজারে সেটলড থাকবে। পাঁচুবাবুর বন্ধু বাংলার শিক্ষক ক্ষিতিমোহন মহাশয় প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এসব মুঘল নাম কেন, মৌর্য বংশের দিকে তাকাও, নাতির নাম দাও তৃতীয় পাঁচু।’ পিতামহ রাজি হননি। একমাত্র মুঘল নামেই সিক্সথ জেনারেশনের গ্যারান্টি আছে।
বাবর বোসের সহ-খেলোয়াড় সান্যালবাবু একটু জুনিয়র। কিন্তু তিনি প্রচুর অস্থাবর সম্পত্তির অধিকারী— গ্যাস অম্বল, কবিতার খাতা, উদাসীন গিন্নি, রোম্যান্টিক মহিলা কলিগ— তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা অতি দীর্ঘ।
এই দুই বিপরীত চরিত্রের মানুষ দু’হাজার কুড়িতে এসে একই বিন্দুতে মিলিত হলেন— দু’জনেই গৃহবন্দি।
কিন্তু গৃহবন্দি জীবনও জীবন। ফেলে তো আর দেওয়া যায় না। সন্ধের যে সময়টা দাবা বোর্ডে দিতেন সে সময়টুকু ইনভেস্ট হয় মোবাইলে!
—হ্যালো সান্যাল, আজ ঘর ঝাড়ু দিলে নাকি?
—না বোসদা। বাসন মেজেছি।
—ও—। বাসন মাজা তো ভেরি ইজি...বিজ্ঞাপনে দেখায়, তিন ফোঁটা সাবানে পঞ্চাশটা বাসন!
—আপনি?
—এই একটু সব্জি কেটেছি। খুব টাফ কিছু নয়, কেবল পাঁচশো আলুর খোসা ছাড়াতে গিয়ে আড়াইশো হয়ে গেল! আচ্ছা, রসুনের কোয়ার খোসা ছাড়ানোর কোনও মেসিন হয়?
—না, শুনিনি। আপনাদের ওদিকে কেউ ধরা পড়ল নাকি?
—ধরা! নাঃ, কোনও খবর নেই। তোমাদের ওদিকে?
—আছে দাদা। পাশের বাড়ির কর্তার মাসতুতো ভাই। পজিটিভ।
—সে কী! তাহলে তুমি বরং ক’দিন এসো না।
কিছুক্ষণ দু’প্রান্তই চুপ। তারপর বোসবাবু বললেন, ‘আচ্ছা সান্যাল, তুমি তো লেখোটেখো, কলেজ স্ট্রিটে একখানা বইয়ের সন্ধান নেবে?’
—কী বই দাদা? কলেজ স্ট্রিট তো বন্ধ।
—‘এক খাঁচায় কাটিয়ে দিন/ বাঘ-বাঘিনী নিশিদিন’—অনেক টেকনিক্যাল টিপস আছে নাকি বইটিতে।
—তাই নাকি! অনলাইনে দেখুন না, পেলে আমারও এক কপি...।
তবে এই দৈব দুর্বিপাক ক্রমশ পাতলা হচ্ছে, লোকজনও বের হচ্ছে রাস্তায়। তবে পুরো নিস্তার এখনও পাওয়া যায়নি। অফিসের বড়বাবু সেদিন বলছিলেন, ‘বউকে ফোন করলে পাক্কা দেড় মিনিট খরচা—আধ মিনিট বউ, এক মিনিট বচ্চন সাহেব।’ লোকজন যে অল্পবিস্তর সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছে, তা মাস্কের অবস্থান দেখলেই বোঝা যায়। মাস্ক এখন মুখ থেকে নেমে এসেছে থুতনিতে। বড়বাবু বললেন ‘বলতে নেই... আমার বউ বেশ ফর্সা, বুঝলে। সেদিন রাস্তায় তাকে দূর থেকে দেখে তো আমার চক্ষুস্থির! বউয়ের এক গাল দাড়ি!’
বললাম, ‘বলেন কী! আপডেটেড করোনা নাকি?’
বড়বাবু একগাল হেসে বললে, ‘না হে, কাছে গিয়ে দেখি কালো মাস্ক থুতনিতে নামানো!’
পাবলিক করোনা ভুলতে চাইলে কী হবে, তাকে মনে করিয়ে দেওয়ার লোকজনের অভাব নেই। এক দশকর্মা ভাণ্ডারের সামনে দেখি বোর্ড ঝুলছে— ইউজ অ্যান্ড থ্রো স্যানিটাইজড পইতা ব্যবহার করুন। দেহ জীবাণুমুক্ত রাখুন।
এ প্রসঙ্গে আমাদের বড়বাবুর একখানা গল্প না বললেই নয়। দু’হাজার উনিশের ডিসেম্বরে তিনি একটা কোটের মাপ দিয়েছিলেন। নাম করা দর্জি, বেশ ভিড় হয়। মাপটাপ নিয়ে দর্জি বলল, ‘মাসখানেক পর আসুন ট্রায়াল দেবেন।’
প্রায় মাস খানেক পর তিনি ট্রায়াল দিতে গেলেন। তাঁকে দেখে দর্জি অবাক হয়ে বলল, ‘আপনাকে ফেব্রুয়ারিতে আসতে বলেছিলাম না?’
বড়বাবু বললেন ‘তাই নাকি! আমি যেন শুনলাম—’
দর্জি বিগলিত হয়ে বলল, ‘তাতে কী, মানুষ মাত্রেই ভুল হয়!’
একমাস পর ফের গেলেন বড়বাবু। দর্জি বিনয়াবনত হয়ে বলল, ‘ব্যস, প্রায় হয়ে এসেছে, আর সাত দশ দিন স্যার...।’
এইভাবে মাসখানেক টেনে দিতেই লকডাউন শুরু। বড়বাবুর অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। ছুটিই ছুটি। তিনি গেলেন তাগাদায়। দর্জি বলল, ‘আপনার তো এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। খেয়েদেয়ে মোটা হবেন। পুরনো মাপের বানিয়ে কী লাভ! আসুন মাস ছয়েক পর, নতুন মাপ নেব।’
ছ’মাস পর বড়বাবু ফের গেলেন দর্জির দোকান। সে বলল, ‘ফের নাকি অফিস-টফিস খুলতে শুরু করেছে শুনলাম, আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু হবে, শরীর ঝরতে শুরু হবে আপনার। আপনি বরং—।’
বড়বাবু আর থাকতে পারলেন না। মেজাজ হারিয়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো, প্রত্যেকবারই সামনের একখানা ডেট দিচ্ছেন?’
দর্জি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘টিভি খুললেই দেখবেন সামনের মাসে ভ্যাকসিন বের হওয়ার খবর। পেয়েছেন এখনও? ওখানে বলতে পারছেন?’
দু’হাজার একুশ তো শুধু করোনা পরবর্তী বছর নয়, ভোটেরও বছর। জ্যোতিষ সম্রাট দিবাকর (স্বর্ণপদক, লন্ডন) এর কুড়ি সাল ভালো যায়নি। একুশে হাত দেখার ব্যবসা পুনরুদ্ধারে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। কোষ্ঠী বিচার করবেন একশো পার্সেন্ট গ্যারান্টিসহ। বিফলে মূল্য ফেরত।
তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট মালাকার একদিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, বিফলে মূল্য ফেরত লেখাটা কি ঠিক হচ্ছে! কেউ যদি সত্যি সত্যিই ফেরত নিতে আসে?’
দিবাকরবাবু বললেন, ‘ওরে বোকা, প্রিন্টেড কোষ্ঠীর একদম শেষ লাইনখানা দেখে নে, খুদে খুদে অক্ষরে লেখা আছে— ইহা বুথ ফেরত সমীক্ষার কৌশল অনুসারে নির্মিত।’
মালাকার হাঁ। দিবাকর হেসে বললেন, ‘এসব কোভিডের শিক্ষা, রোগ হতেও পারে, নাও পারে, যতই তুমি মাস্ক পর।’
দু’হাজার একুশকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছেন নবীন ডাক্তার। তিনি গঞ্জের প্রবীণ ডাক্তার। নাইনটিন সিক্সটিতে দ্বারভাঙা থেকে পাশ করা কোয়াক চিকিৎসক। পসার এক সময় ছিল, এখন স্টেথোতে ধুলো, প্র্যাকটিস প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। বছর পাঁচেক হল একখানা হলঘর লাগোয়া দুটো রুম নিয়ে তিনি ম্যারেজ হলের ব্যবসা করছিলেন। মোটামুটি চলছিল তার ম্যারেজ হল। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ল দু’হাজার কুড়িতে। ফাল্গুনের পর নো বুকিং। সংসার চালানোই দায়।
শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে এলেন পুরনো পেশায়। তবে সরাসরি নয়, ইনডিরেক্ট। অনেক ভেবে নবীন ডাক্তার বুঝেছেন, পৃথিবীতে যতই দৈব দুর্বিপাক, বিদ্রোহ-বিপ্লবই ঘটুক না কেন, উৎপাদন প্রক্রিয়া কোনও দিন ব্যাহত হবে না। তাই ম্যারেজ হল হয়ে গেল নার্সিং হোম। নাম ‘ডেলিভারি’। বহু চিন্তা করে তিনি নামখানা রেখেছেন। ছুটকো রোগ, অ্যাক্সিডেন্ট কেস নিয়ে কেউ যেন না আসে।
তবে এ নামেও নিস্তার নেই। সেদিন এক ভদ্রলোক ফোনে বললেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি, উঠোন দাওয়া নিয়ে বিস্তর জায়গা। আপনাদের হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে নাকি?’
দিন কয়েক আগে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে জনৈক ভদ্রলোক এসেছেন। পেশেন্টকে বিছানায় শুইয়ে নবীন ডাক্তার বসলেন অফিস ঘরে।
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা খরচা কেমন দাঁড়াবে?’
নবীন ডাক্তার মুখস্থের মতো বলে গেলেন, ‘নর্মাল পনেরো, সিজার পঁচিশ।’ ভদ্রলোক নিষ্পাপ মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা আমার চয়েস নাকি আপনার?’
কাশী মিত্তির লেনের ঢ্যাঙা পল্টুর ব্যবসা কিন্তু লকডাউনে বিন্দুমাত্র ডাউন হয়নি। সে একজন প্রতিষ্ঠিত চোর। বাচ্চাগুলোর স্কুল নেই, অফিসবাবুর ওয়ার্ক ফ্রম হোম— পল্টু ভেবেছিল না খেয়েই মরতে হবে শেষে! বাড়িই যদি খালি না থাকে, চুরি হবে কী করে? পরে দেখল ব্যাপারটা উল্টো। ওয়ার্ক ফ্রম হোম-টোম ফালতু। বাড়িতে থাকলে কর্তা আয়েশি হবেই এবং গিন্নি হবে সোহাগি। নিট ফল দুপুর ও রাতে ফুল প্রুফ ঘুম। এই বাজারে পল্টুকে তো ওভার টাইম করতে হল! দুপুরে কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই রাতের হাতছানি।
এত সত্ত্বেও দু’হাজার কুড়ি যে তাকে ‘দাগা’ দিয়েছে, হোল লাইফে তা সে পায়নি। সেদিন দত্তদের বাড়ি থেকে একশোর একটা পুরো বান্ডিল সে ঝেড়ে নিয়ে এসে রেখে দিয়েছিল চালের টিনের ভেতর। ক’দিন নিশ্চিন্ত, কাজে বের না হলেও চলে। মন বেশ ফুরফুরে। কিন্তু সে সুখ সইল না। পায়ে পা লাগিয়ে তুমুল ঝগড়া করে বউ চলে গেল বাপের বাড়ি। প্রায় বিনা কারণে ঝগড়া— সন্ধেবেলা দু’পাত্তর টেনেছিল, এই তার অপরাধ! দিন দুয়েক পর চালের টিনে হাত ঢুকিয়ে বান্ডিলখানা বের করতেই চক্ষু চড়কগাছ! ঝগড়াটগড়া সব নাটক— এই ছিল মনে! বান্ডিলের প্রথম পাঁচটা ও শেষ পাঁচটা অরিজিনাল নোট। বাকি সব সেম সাইজের সাদা কাগজ। তাতে আবার লেখা— ‘ইতি- তোমার বউ’।
এত বড় কাণ্ডের পর কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারে? পল্টুও পারেনি। কয়েক পাত্তর খেয়ে সন্ধে থেকেই সে চৌকিতে লটকে পড়ল। কিন্তু চোরের ঘুম তো, মাঝরাতে খসখস শব্দে ভেঙে গেল। অন্ধকারে ঠাহর করে দেখল, কে যেন মেঝেতে গামছা বিছিয়ে রেখে পা টিপেটিপে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। পল্টু বুঝল, তার বাড়িতেই ছিঁচকে চোর ঢুকেছে। সে পড়ল মহা ফাঁপরে। নিজে চোর হয়ে ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলে কাউকে ধরিয়ে দেওয়া নীতিহীন কাজ। অথচ, চুরি যদি হয়েই যায়, সেটাও প্রেস্টিজের ব্যাপার।
কিন্তু গামছা বিছালো কেন? নিশ্চয়ই এর মধ্যে কিছু ঢেলে খুঁট বেঁধে নিয়ে যাবে। হলও তাই। সত্যি সত্যি রান্নাঘর থেকে ভারী চালের টিনখানা নিয়ে এসে ছিঁচকে চোরটা উপুড় করে দিল মেঝেতে। তারপর গামছায় খুঁট বাঁধতে গিয়ে তাঁর মাথায় হাত! গামছা কোথায়?
বড় চোর পল্টু আগেই যে সরিয়ে দিয়েছে গামছাখানা। অন্ধকারে সে বেচারা টের পায়নি, সব চাল মেঝেতে। নিজেকে আর সামলাতে পারল না ছিঁচকে, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
এবার পল্টু আলো জ্বালিয়ে বলল, ‘অ্যাই, কাঁদছিস কেন?’
লোকটা বলল, ‘আমার লাস্ট গামছাটাও গেল...’
পল্টু দয়া পরবশ হয়ে বলল, ‘যাবে কেন...এই তো...’
গামছাখানা ফেরত দিতে গিয়ে পল্টু দেখল, তাতে অজস্র ফুটো। ছ্যা ছ্যা করে বলে ফেলল, ‘এই তোর বুদ্ধি! এই ফুটো গামছাতে চাল নিবি?’
ছিঁচকে জবাব দিল, ‘কী করব, গেল হপ্তায় মিত্তিরদের উঠোন থেকে নতুন গামছা তুলে নিয়ে গেছিলাম। বউ সেটা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল যে! বলে গেল, পুরনো গামছা নিয়ে বাপের বাড়ি গেলে প্রেস্টিজ থাকবে না।’
এসব দু’হাজার কুড়ির কিসসা। ঢ্যাঙা পল্টুর একুশে হবে স্বাভাবিক জীবন এবং স্বাভাবিক জীবন মানেই অস্বাভাবিক কম রোজগার। তা হওয়াই ভালো। পয়সা বেশি হলে বউয়ের মেজাজ হয়। মেজাজ গরম হওয়া ভালো নয়।
ওই কাশী মিত্তির লেনেই থাকে আমাদের বিশু পাল। পাক্কা হিসেবি মানুষ। সে ফিনিক্স পাখির মতো। না, ভুল হল, ওসব ফিনিক্স পাখিটাখির উদাহরণ বিদেশে চলে। বরং বলা যায় দুব্বোঘাসের মতো— মরিয়াও মরে না এবং যেখানে-সেখানে গজিয়ে ওঠে। কোথাও জায়গা না পেলে ঘনিষ্ঠদেরই হাড়ে। বহু ব্যবসা করে এবং ফেল দিয়ে সে এই সারসত্য বুঝেছে, পাবলিক ডিমান্ড না থাকলে কোনও ব্যবসাই চলে না। পাবলিকের প্রয়োজন এরকম যেকোনও ব্যবসাতেই প্রচণ্ড কম্পিটিশন। বহু ক্যালকুলেশন করার পর, প্রচুর চিন্তা করে সে বাসস্ট্যান্ডের ধারে সরকারি জায়গায় খুলে ফেলল জনগণের শৌচালয়। এর চেয়ে হাইডিমান্ড এই শহরে আর কী হতে পারে!
কোন সে সুদূর অতীতে, অন্য কোনও গঞ্জ-শহরে বিশু পালের দাদুর ছিল জনতা হিন্দু হোটেল— সেসব সুখস্মৃতি এখনও বাড়িতে আলোচনা হয়। আহা! কী সস্তায় মানুষকে খাইয়ে দাদু পুন্যি অর্জন করে গেছে। পুন্যি অর্জনের লোভ কার না নেই! বিশু পালও তার নতুন খোলা শৌচালয়ের নাম দিল— ‘জনতা শৌচালয়’। দাদু খাইয়ে পুন্যি করে গেছে— সে না হয়—। রেটও বেশ রিজিনেবল— ছোট বাইরে পঞ্চাশ পয়সা আর বড় বাইরে দেড় টাকা।
বিশু পালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিউনিসিপ্যালিটির রিটায়ার্ড ঝাড়ুদার হারু বলল, ‘আটআনা ফেরত দেবে কী করে? এখন তো আধুলি উঠে গেছে।’
বিশু পাল হেসে জবাব দিল, ‘কেন, পঞ্চাশ পয়সার লজেন্স ধরিয়ে দেব।’
গাঁদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে মার্চের পনেরো তারিখ জনতা শৌচালয় ওপেনিং হল। মুখ থুবড়ে পড়ল শেষ সপ্তাহে। লকডাউন।
যার দুর্ভোগ যত, তার আশাও তত। বিশু পাল একুশকে নিয়ে তাই বুক বেঁধেছে। মানুষজন আবার বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, রাস্তায় বের হলেই ইয়ে পাবে, তখন তার শৌচালয় ছাড়া গতি কী! তাই একুশে পাবলিক ডিমান্ডের ওপর বিশু পালের জীবন নির্ভর করছে!
এদিকে, লোকাল ট্রেন ফের চালু হয়েছে। কিন্তু তিরিশ বছরের ডেলি প্যাসেঞ্জার মিসেস সেন আর আসছেন না। লকডাউনের মধ্যেই তিনি অবসর নিয়েছেন। তাঁর এখন মর্নিং ওয়াক, লাফিং ক্লাব শাসিত জীবন। দূর প্রবাসে ছেলে-বউমা, মেয়ে-জামাই। বছরটা যা গেল, নানা জায়গা থেকে বিভিন্নরকম খবর। কোনওটাই ভালো নয়। দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না। অথচ একটা পজিটিভ কিছু আঁকড়ে না ধরলেই নয়। অনেক ভেবে মা-ঠাকুমাদের মতো তিনিও মন দিলেন সূচিশিল্পে। দিন তিনেকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তাঁর শিল্পকর্ম বেডরুমের দেওয়ালে ঝুলল।
সেন মহাশয় শুতে এসে দেখেন দেওয়ালের ফ্রেমে মেরুন কাপড়ের ওপর সাদা সুতোয় লেখা, ‘আমার সন্তান যেন থাকে ভ্যাকসিন ভাতে।’
ফিরে আসি বাগবাজারে। বিকেল শেষ হচ্ছে। সারা দুপুরটা লুডোর রোয়াকে খুব হুজ্জোত গেছে। নির্বাচনী সভার মতো গিন্নিদের লুডোতে চোর, বাটপাড় ইত্যাদি সম্বোধন ও অপবাদে চিল-চিৎকার। এই মুহূর্তে দাবার রোয়াকে দুই প্রৌঢ় স্থির। সান্যাল মশাই একখানা চাল দিয়ে রিল্যাক্স হয়ে বললেন, ‘দুই রোয়াকে লুডো এবং দাবা। এ যেন জীবনের সারসত্য দাদা... ভাগ্য আর বুদ্ধি। যাই বলুন, সর্দি-কাশি, আমাশাটামাশা নিয়েও ফিরে তো এসেছি।’
বাবর বোস চাল ফিরিয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করলেন, ‘দুর্যোগ ক্ষণস্থায়ী, শেষপর্যন্ত জেতে না। বাবার হইল আবার জ্বর, সারিল ঔষধে... কী ভেবেছেন? সিক্সথ জেনারেশন পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। ভাগ্য প্লাস বুদ্ধি, ইজিকাল্টু কনটিনিউটি, কনটিনিউটি...।’