পিতার স্বাস্থ্যহানি হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
এত সাধনা, কণ্ঠে বেদনা... তারপরও মায়ের দেখা না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল না?
হ্যাঁ, বাবার অনেকবার ঈশ্বরদর্শন হয়েছে। নানাভাবে... নানা জায়গায়। কাকা ছিলেন বাবার একান্ত অনুগামী। বাবা জীবনে যা যা করতেন, প্রতি ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করতেন কাকা। বাবার প্রতি ওঁর ভক্তি ছিল সাংঘাতিক। কারণ আমার দাদু যখন মারা যান, কাকা তখনও মায়ের গর্ভে। বাবা তাই কাকাকে পুত্রবৎ মানুষ করেছিলেন। কাকাও বাবাকে যে কতটা সম্মান করতেন, বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু ওঁর আক্ষেপ ছিল একটাই... মায়ের এত নামগান করেন, তবু কেন তাঁর দেখা পান না। বলতেন, ‘এত করে ডাকি তোকে, আমায় কেন একবার দর্শন দিলি না!’ মনের এই কষ্ট, যাতনা বা জ্বালা যা-ই বলুন, তাঁকে কুরে কুরে খেত। স্নান করে ঠাকুরের কাছে আহ্নিক-পুজো আর পাঁচ জনের মতো তিনিও করতেন। কিন্তু ওঁর আসল পুজো ছিল গান। মায়ের গানকে উনি যে মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে প্রতি শব্দে ভক্তির জোয়ার আসত। সেই জন্যই আলাদা পুজোর দরকার ওঁর অন্তত ছিল না। এখনও কেউ যদি মায়ের সামনে বসে ওঁর কোনও গান গুনগুন করে গায়, তাতেই দেখবেন কী অদ্ভুত শান্তি। খুব বাস্তব কথা বলছি। কোনও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পথে হেঁটে নয়, শুধুমাত্র সাধারণ শ্যামাসংগীত গেয়ে এত জনপ্রিয়তা পৃথিবীতে কেউ পেয়েছেন বলে আমি জানি না।
দুই ভাইয়ের অন্তরঙ্গতাও তো এক অনুপ্রেরণা...
হাওড়ায় সরস্বতী পুজোর সময় ঘুড়ি ওড়ানো হয়। বাবা সেদিন কলকাতায় আসবেন। কাকা তখন হাওড়ারই বাড়িতে। সেবার বাবা বেরনোর সময় বলে গিয়েছেন, ও (পান্নালাল) এলে একটা টাকাও কেউ দেবে না। কারণ সেদিন বিকেলে অনুষ্ঠান ছিল... দু’জনেরই। বাবা-কাকার মোট তিনটি অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। কিন্তু কাকা তক্কে তক্কে ছিলেন। বাবা যেই বেরিয়েছেন, কাকা ছুটে এসেছেন আমার মায়ের কাছে... ‘টাকা দাও, ঘুড়ি কিনব।’ মা বলছেন, ‘না কোনওমতেই না। তোমার মেজদা বারণ করে গিয়েছেন।’ সে ছাড়বে না। বাচ্চা ছেলের মতো বায়না... জবরদস্তি। আদায় করেই ঘুড়ির কিনতে দে দৌড়। শাসন ছিল... স্নেহও। এইসব ছোট ছোট ঘটনা, এই নৈকট্য তো বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় না! এটা একবোরেই আন্তরিক। আমি বাবা-কাকা সম্পর্কে বলতে শুরু করলে শেষ হবে না...। বাবা বলতেন, ‘আমার কখনও কোনও হিংসে হয়নি। তবে বলতে পারি শ্যামাসংগীতে ওর পর্যায়ে কেউ নেই, আগামীতেও হবে না।’ ‘সাধ না মিটিল আশা না পুরিল...’ বেরোবার পরে ভারতজুড়ে কাকার জনপ্রিয়তা যে শিখর ছুঁয়েছিল, সেখানে কেউ পৌঁছতে পারেনি।
ফিল্মের গান, ভক্তিগীতি সবই বাবা করেছেন। সব ভক্তিমূলক ছবিতেই বাবার গান থাকত একটা সময়। এরপরে তাঁর কাছে প্রস্তাব আসে নন-ফিল্ম শ্যামাসংগীত করুন। তখন বাবা বলেছিলেন, ‘ওটা পান্নার জন্য। পান্না ছাড়া কাউকে মানাবে না। ওর মতো আন্তরিক নিবেদন আর কারও নেই।’ কাকার আবার ভীষণ ঝোঁক ছিল আধুনিক গান গাইবার। বাবার সব গান ভালোবাসতেন। বাবা বললেন, ‘শ্যামাসংগীতটা তোমার জন্য থাক। তুমি ওটাই গাও।’ তাতে যে সুনাম কাকা পেলেন, তারপর ইচ্ছে থাকলেও আর অন্য গানে ফেরেননি।
শোনা যায়, পান্নালালবাবু একবার নাকি ভবতারিণীর তুঁতেরঙা বেনারসি পরা রূপ আগেই দেখতে পেয়েছিলেন?
একবার ফাংশান করে অনেক শিল্পী মিলে ফিরছিলেন ট্রেনে। হঠাৎ কাকা চুপচাপ হয়ে গেলেন। এমনিতে খুব হুল্লোড়ে মানুষ, সবসময় হইহই, মজা করা অভ্যেস। সবার সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে যাবেন... গাড়িতে যখন উঠছেন, দেখা গেল এক চ্যাঙারি মিষ্টি, কচুরি নিয়ে উঠছেন কাকা। সেই মানুষকে চুপচাপ দেখে সবাই অবাক। সবাই জিজ্ঞেস করছেন, ‘কী ব্যাপার, তোর কী হল? চুপ করে গেছিস।’ নির্মলা মিশ্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষেরা ছিলেন সঙ্গী। খানিক পরে কাকা তাঁদের বললেন, ‘দেখতে পাচ্ছি ভবতারিণী মাকে তুঁতে রঙের বেনারসি শাড়ি পরানো হয়েছে।’ সবাই তখন তাচ্ছিল্য করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন উনি দক্ষিণেশ্বর স্টেশনে সবাইকে জোর করে নামালেন। বললেন, ‘বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি করে দেব। কিন্তু মায়ের দর্শন করতে হবে।’ সেখানে সবাইকে নিয়ে গিয়ে দেখলেন, মাকে তুঁতে রঙেরই বেনারসি পরানো হয়েছে। সে দৃশ্য দেখে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
মায়ের দেখা না পেয়ে ওঁর কি সংসারে বৈরাগ্য এসেছিল?
মায়ের জন্য এমন টান যাঁদের থাকে, অপ্রাপ্তিতে তাঁদের মনঃসংযোগ নষ্ট হয়। যাতে মন থাকে, তা থেকে মন সরে যায়। কাকা কায়মনোবাক্যে, অন্তর দিয়ে মাকে চেয়েছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে হয়তো পাননি। কিন্তু পরোক্ষভাবে পেয়েছেন। দেখুন রামপ্রসাদ যেমন সরাসরি মাকে পেয়েছিলেন, ওঁর সেই সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু কাকা তো মায়ের আশীর্বাদ, পরশ সবই পেয়েছেন। না হলে অমন আকুলতা আসে নাকি গলায়? তবে মাকে না পেয়ে সংসার থেকে সরে গিয়েছিলেন, এ কথা বলা যায় না। উনি চরম সংসারী ছিলেন। আমার তিন খুড়তুতো বোন। তাঁদের ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন, চুল বেঁধে দিতেন। এতটাই সংসারী ছিলেন তিনি। সংসারের প্রতি কোনও বিরূপতা কখনও আসেনি।
শোনা যায়, একটা সময় শ্মশানে গিয়ে বসে থাকতেন?
হ্যাঁ। বালিতে বারেন্দ্রপাড়ায় আমাদের নিজস্ব শ্মশানঘাট ছিল। উনি প্রায়শই রাতে ওখানে গিয়ে বসে বসে কাঁদতেন। গানও করতেন। কিন্তু সংসার থেকে দূরে গিয়ে নয়।
আপনি কীভাবে পেয়েছেন তাঁকে?
গান করি ঠিকই। কিন্তু ওই দুই ভাইয়ের আন্তরিকতা হয়তো খুঁজে পাই না। খুব চেষ্টা করি... অন্তর দিয়ে গাইতে। ওঁদেরই মতো গান করি। কিন্তু ওঁদের দু’জনের মতো হওয়া...! আগামী একশো কেন, দু’শো বছরেও হবে না কেউ। এটা স্পষ্টতই আমার মনে হয়। আর কে কী বলবেন, আমি জানি না। আগামী দু’শো বছরে আর ধনঞ্জয়-পান্নালাল আসবে না।
শৈশব স্মৃতি...
আমার কাকা যে একজন এত বড় শিল্পী, মানুষের এত কাছের, এত জনপ্রিয়... আমরা কোনওদিন এসব বুঝতাম না। তিনি এমনভাবে আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন... ইয়ার্কি ফাজলামি কিছু বাদ যেত না! এমনভাবেই চলতেন। আমাদের পরীক্ষা হয়ে গেল। কাকা নিয়ে চলে গেলেন তাঁর কাছে। কাঁকুলিয়া রোডের সেই বাড়িতে চার-পাঁচ দিন থেকে এলাম। দারুণ কাটত সময়টা। কাকা যে কত বড় মাপের মানুষ, সেটা বুঝেছি উনি চলে যাওয়ার পর।
গানের কথা কী মনে পড়ে?
যখন গাইতে বসি, দু’জনকেই খুব মনে পড়ে। অনুভব করি, ওঁরা আমার পাশে আছেন। আর সেই সাহসে ভর করেই কত মানুষের সামনে যে গান গেয়েছি...। কাকা যখন বাবার কাছে গান তুলতে আসতেন... বাবা শেখাচ্ছেন, কাকা গান তুলছেন...দুর্লভ এক দৃশ্য। যার সাক্ষী আমি। এগুলো থেকেই তো অনেক কিছু শিখেছি-জেনেছি। পরবর্তীকালে নিজে যখন কোনও অনুষ্ঠানে গেয়েছি, ভাবতে পারবেন না কত বয়স্ক মানুষ এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন। বাধা দিলে বলেছেন, ‘আপনি কার ছেলে, কার ভাইপো দেখতে হবে তো...।’ এই প্রাপ্তি কোথায় রাখি...! এইসব অভিজ্ঞতার পরে স্তব্ধতা ঘিরে ধরে আমায়। এক একটা অনুষ্ঠানে এমনও হয়েছে, শ্রোতা খুব সাংঘাতিক। ধরে নিন, গান শোনার লোকই তারা নয়। বাবা-কাকার নাম করে আমি গাইতে শুরু করেছি, টানা এক ঘণ্টা পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। ওঠার পরে চরম হাততালি। এ তো বাবা-কাকারই আশীর্বাদ! তা ছাড়া কোনওমতেই হয় না... হতে পারে না। আমি গান করি, আমার মতো চেষ্টা করি। তার মধ্যে কেউ যদি অসাধারণ কিছু খুঁজে পান, সেটাও বাবা-কাকার আশীর্বাদ।
তাঁদের থেকে কিছু পাওয়া বাকি থেকে গিয়েছে মনে হয়?
সে তো বটেই। মনে হয় ওঁরা যদি আরও কিছু দিন কাছে থাকতেন, আরও অনেক কিছু শিখে নিতে পারতাম। আরও ভালো করে নিজেকে তৈরি করতে পারতাম। তখন তো গাছের ফল, পাড়ছি আর খাচ্ছি। সেই গাছ তো আর নেই... কিনে খেতে হবে। মূল্যটা এখন এসে বুঝতে পারি।
পান্নালালবাবুর শেষের সময়টা মনে আছে?
তাঁর চলে যাওয়া নিয়ে বহু রটনা আছে। একমাত্র সত্যি কথা যেটা আমি বাবার থেকে শুনেছিলাম, মাতৃদর্শন না পেয়ে অভিমানে তিনি চলে গিয়েছিলেন। শ্যামা মাকে পেলাম না, এ ছিল তাঁর চরম কষ্ট। আর কোনও রটনা এর মধ্যে ছিল না। অনেক কথা কানে আসে আমাদের, কাগজে ছাপাও হয়, তাঁরা কেউ কোনওদিন তাঁকে দেখেছেন বলে শুনিনি। অথচ তাঁরা নানারকম বলে যান... হাসি পায়। বাইরে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেই ভদ্রলোকের একটা কথা আমার আজও মনে আছে। বলেছিলেন, কালীপুজো মানে জবাফুল, বেলপাতা আর পান্নালালের গান। এই কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। এই তিন উপকরণের কোনও একটিকে বাদ দিয়ে পুজো হবে না। এই সম্পূর্ণতা খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই তো সার্থকতা।