পিতার স্বাস্থ্যহানি হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
কলকাতায় অনেকগুলো দফায় দুর্গাপুজোর পট পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের সময় কেন জোয়ার এল? কারণ, আমরা (সমসাময়িক শিল্পীরা) শুধুমাত্র দুর্গাপুজোর বিষয়-ভাবনা নিয়ে সময় কাটাই না। প্রত্যেকেরই আলাদা আর্ট প্র্যাকটিস রয়েছে। নিরন্তর চর্চাই যে কোনও শিল্প এবং শিল্পীকে উন্নতির পথে পা দিতে শেখায়। আমি, সনাতন দিন্দা, সুশান্ত পাল, আরও কত নাম— প্রত্যেকের নিজস্ব আর্ট ব্যাকগ্রাউন্ড ও চর্চা রয়েছে। শারদোৎসবের হাত ধরে পাবলিক আর্টে তার প্রভাব অবশ্যই পড়েছে।
২০০০ সালের আগে আমরা মূলত দেখতাম কাঁথির ডেকরেটারদের। ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে ডিজাইন। সুন্দর কাজ। তারপর আমরা এলাম। পুজোর থিমে নবজাগরণ বলাটা বাড়াবাড়ি, কিন্তু সরাসরি আর্টের প্রভাব পড়ল পুজোয়। ক্রমশ অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলা গ্রামগঞ্জের লোকায়ত শিল্পকে মণ্ডপে তুলে ধরা শুরু হল। পট, টেরাকোটা, কাঠের মুখোশ, গালা পুতুল, টেপা পুতুল, ডোকরা আরও কত কী! তা দিয়েই সাজল শহরের দুর্গাপুজো। থিমের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই।
বন্দন রাহার ভাঁড়ের মণ্ডপ কার্যত কলকাতার থিমপুজোর ‘শোলে’। ওই সময় এভাবে এরকম মেটেরিয়াল ব্যবহার করার কথা কেউ ভাবেনি। এত সারল্য। আজ ভাঁড়ের কিছু ভাবা হলে হয়তো সেই উন্মাদনা থাকবে না। কিন্তু তখন মানুষের কাছে ওটাই বিশাল ব্যাপার ছিল।
কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে তাতেও এল ব্যাপক বদল। শিল্পীর নিজস্ব ভাবনার উপস্থাপন এতদিন ছিল না। এবার শুরু হল সেই কাজ। আইডিয়া তুলে ধরার জন্য অনুষঙ্গ হিসেবে আমিও ফোক আর্ট ফর্ম ব্যবহার শুরু করলাম। এটা চলল তিন-চার বছর। তারপর দুর্গাপুজো হয়ে উঠল সরাসরি সামাজিক ইস্যুভিত্তিক থিমের আঙিনা। নারী নির্যাতন, জাতপাত— সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা। এখন যেটা চলছে, সেটা পুরোপুরি ‘কনসেপচুয়াল প্র্যাকটিস’। যার সঙ্গে জুড়েছে পাবলিক আর্ট, ইনস্টলেশন আর্টের মতো গালভরা টার্ম। ধর্মীয় বিধি কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বেড়েছে মানুষের অংশগ্রহণও।
বছরের চারটে মাস শিল্পীরা কখনও গলিতে, কখনও রাস্তায়, কখনও বা মাঠে নিয়ে চলে আসছে তাঁদের স্টুডিও। বিভিন্ন ধরনের শিল্পী-কারিগর এক জায়গায় এসে কাজ করছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে শিল্প সচেতনতা। এটাই বিশাল প্রাপ্তি। কলকাতার মানুষের মনন, চেতনা অনেক বদলে দিয়েছে শহরের দুর্গাপুজোগুলি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আর ১০ বছর পর কল্লোলিনী তিলোত্তমার পুজো বিশ্বের মানচিত্রে স্থায়ী জায়গা করে নেবে। একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যে শিল্প ও সংস্কৃতির উৎসব হয়ে উঠেছে, এ একটা বিরাট ব্যাপার।
আমি কোনওদিন নির্দিষ্ট মাধ্যমে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি। যেমন চাইনি হোয়াইট কিউব গ্যালারির মধ্যে শুধু কয়েকজন মানুষ আমার শিল্পের বোদ্ধা হোক। ছোট থেকেই স্কাল্পচার আমায় আকর্ষণ করত। ২০০০ সালে বুঝতে পারলাম, দুর্গাপুজো আমার প্ল্যাটফর্ম হতেই পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের চর্চা। নিষ্ঠাভরা সাধনাও। যাতে মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো যায়। আস্তে আস্তে তা বেড়েছে। ধর্মীয় আচারবিধির বাইরে বেরিয়ে এসেছে আজকের দুর্গাপুজো। অনেক রক্ষণশীল জায়গা ছিল প্রতিমার আঙ্গিক নিয়ে। সে সব আর নেই।
কিন্তু তৃপ্তি আসেনি। সন্তুষ্টি এলে হয়তো ২০ বছর ধরে টানা কাজ করে যেতেও পারতাম না। নিজের কাজ বলতে গেলে তিনটি থিমের কথা মনে পড়ে। ২০০৬ সালে লেকটাউন প্রদীপ সঙ্ঘে ‘শব্দ কল্প দ্রুম’, ২০০৭ সালে খিদিরপুর ২৫ পল্লিতে ‘মানবজমিন’ এবং ২০১৬ সালে ঠাকুরপুকুর এসবি পার্কের ‘বাঁক’। কিন্তু অন্যদের কাজ দেখলেই মনে হয়, কিছুই করতে পারিনি। অনেকের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাই। ছোট ছোট শিল্পীদের কাজ দেখি। রাত দুটো পর্যন্ত সুরুচি সঙ্ঘের প্রতিমা রং করতে করতেও সহশিল্পীদের বলি, জেনে রাখো, যদি মাটির মূর্তিতে অনায়াস দক্ষতায় কেউ রঙের আগুন জ্বালতে পারে, সেটা সনাতন দিন্দা। গৌরাঙ্গ কুইল্যা একটা গোটা গ্রামকে পরিচালনা করে। ওই দক্ষতা আমার নেই। ও যে মাপে কাজ করে, যত মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে—তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। প্রদীপ দাস কত ভালো করছে। আমাদের থেকে কত ছোট। গতবার সমাজসেবীর থিম করেছিল। এবারও করছে। পার্থ সেনগুপ্তের কাজও দারুণ। গতবার ঠাকুরপুকুর এসবি পার্ক সর্বজনীনের শিল্পী। ওদের সবার থেকে শিখি। প্রকৃত শিল্পীর ধর্ম এটাই।
আমার মতে আর্ট সেটাই, যা মানুষের কাজে লাগে। তবেই তো উৎসবের সার্থকতা। ধর্মের দিক থেকে দেখি না আমি। শিল্পী হিসেবে সামাজিকভাবে দেবী দুর্গাকে জনজীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়াই আমার থিম। এখন পুজোকে ঘিরে রয়েছে বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। শিল্পকলাকে সরাসরি পাকস্থলির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া গিয়েছে। যাবতীয় কর্মকাণ্ড সবই মা দুর্গাকে ঘিরে। আমার কাছে দেবী এখানেই জাগ্রত। আমার কাছে থিম ওটাই। মুম্বইয়ের গণেশ পুজো নয়। এখানে সামাজিকীকরণ অনেক গভীর। মানুষের সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে পুজো। এখানেই শিল্পীর সার্থকতা। শিল্প তখনই সার্থক, যখন তা মানুষের জন্য হয়ে ওঠে। বিলাসিতার জন্য শিল্প—ভাবতেই পারি না।