বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
অমৃতসরের কোটলা সুলতান সিং গ্রাম। তার পুবদিকে জমজমাট বাজার। সকাল-বিকেল বিকিকিনি। সপ্তাহে তিন-চারদিন এক ফকির এই বাজারের ভিতর দিয়েই তাঁর গন্তব্যে পৌঁছন। পরণে কালো জোব্বা, গলায় হরেক রংয়ের পুঁতির মালা, মাথায় ফেট্টি। নাম কেউ জানে না তাঁর। শুধু জানে ফকিরের গানে মন্ত্রমুগ্ধ হতে হয়। দু’হাত আকাশের দিকে তুলে সুরেলা গলায় সবাইকে মাতিয়ে রাখেন তিনি। ব্যতিক্রম নয় বছর সাতেকের ফিকু। সে আবার ফকির বাবার পিছন পিছন ধাওয়া করে। বাজার, গ্রামের সীমানা পেরিয়ে তাঁর গন্তব্য পর্যন্ত। মন দিয়ে শোনে কাওয়ালি। দিব্যি তুলেও নেয় সেই সুর, সেই বোল। তারপর আবার ফিরে আসে বাজারে। ‘ফিকু আসছে, ফিকু আসছে’ আওয়াজ ওঠে। ব্যবসায়ীরা আদর করে তাকে এক গাছতলায় বসিয়ে গান শোনার অনুরোধ জানায়। ফকিরের গান একের পর এক গেয়ে চলে সে। মিঠে আতরের মতো সুবাস তার কণ্ঠে। মেলে বাহবা। করতালিও।
এমনি করেই কাটছিল ফিকুর শৈশব। ১৯৩৫’এ অমৃতসর ছেড়ে লাহোরে পাড়ি দিল তার পরিবার। লাহোরের নুর মহল্লায় সেলুন খুললেন বাবা হাজি আলি মহম্মদ। বলাই বাহুল্য, তখন দেশভাগ হয়নি। নতুন শহরে গিয়েও ফকির বাবার গান ভোলেনি ফিকু। সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে একমনে সে গুনগুন করতেই থাকে। জুটে যায় শ্রোতাও। তাদের মধ্যে একজন আব্দুল হামিদ। ফিকুর দাদার বন্ধু। শিশু প্রতিভাকে চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। স্থানীয় সঙ্গীত বিশারদদের কাছে তিনিই নিয়ে যান ফিকুকে। শুরু হয় তালিম। কয়েক বছর পর লাহোরের এক বিরাট জলসায় গান গাইতে এলেন কুন্দনলাল সায়গল। দু’দিনের মধ্যেই টিকিট নিঃশেষিত। কেএলের কণ্ঠে তখন মধু ঝরছে। অনুষ্ঠানের দিন সকাল থেকেই এলাকা ভিড়ে ভিড়। অবশেষে এল সন্ধে। মাইকে ঘোষণা হল, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের গান শোনাবেন কেএল সায়গল।’ চারদিক থেকে তাঁর নামে জয়ধ্বনি উঠল। কিন্তু হঠাৎই লোডশেডিং। অকেজো মাইক এবং লাউড স্পিকার। সংগঠকদের মাথায় হাত। কী করা যায়? এমন সময় ফিকুকে দিয়ে গান গাওয়ানোর পরামর্শ আব্দুল হামিদের। সামান্য আপত্তি করলেও শেষে তা মেনে নিতে বাধ্য হলেন তাঁরা। অর্থাৎ ‘ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্কস’ ভূমিকাতেই যাত্রা শুরু ফিকুর। বিনা মাইকেই। অধৈর্য শ্রোতারা ক্রমশ শান্ত হলেন। সেই ফকির বাবার কাওয়ালিতেই বাজিমাত ছোট্ট ছেলেটির। ‘পাখা বালিও, নাম জপো মৌলা নাম’ সহ বেশ কয়েকটি গান শুনে চমকে উঠলেন সকলে। বিদ্যুৎ সংযোগ এলে মঞ্চে উঠলেন কেএল সায়গল। অনুষ্ঠান শেষ হল নির্বিঘ্নে। সেই আসরেই ছিলেন সেকালের নামী মিউজিক ডিরেক্টর শ্যাম সুন্দর। ফিকুর প্রতিভা ধরা পড়েছিল তাঁর অভিজ্ঞ কানে। অনুষ্ঠান শেষে তিনিই সেই বালকটিকে বোম্বে আসার আমন্ত্রণ জানান। বাকিটা ইতিহাস। ছোট্ট ফিকুকেই সঙ্গীত জগৎ চেনে মহম্মদ রফি নামে।
কাজ শেষ হয়নি, টাকা চাইব কেন?
তখনও ভারত স্বাধীন হয়নি। বোম্বের এক নামী স্টুডিওয় শাহজাহান ছবির গানের রেকর্ডিং চলছে। কেএল সায়গল, রাগিনীর মতো তারকারা রয়েছেন। মিউজিক ডিরেক্টর নৌশাদ সাব। কোরাসে গানে গলা মেলানোর সুযোগ পেলেন মহম্মদ রফি। তবে একটি লাইন ছিল শুধু তাঁরই। প্রথম দিনের কাজ শেষ। প্যাক-আপ করে দোতলার স্টুডিও থেকে নীচে নেমে নৌশাদ দেখলেন, কুড়ি বছরের রফি দাঁড়িয়ে। বললেন, ‘বাড়ি যাওনি কেন এখনও? তোমার কাজ তো ঘণ্টাখানেক আগেই শেষ হয়েছে।’ শান্ত স্বরে রফির উত্তর, ‘কালও তো এখানেই রেকর্ডিং। বাড়ি ফিরে আবার আসার পয়সা আমার কাছে নেই। তাই এখানেই কোনওরকমে রাত কাটিয়ে দেব।’ চমকে উঠলেন নৌশাদ। কী বলে ছেলেটা! একটু ভেবে তাঁর মৃদু ধমক, ‘গান তো গেয়েছ। টাকা চাইলেই পারতে। খামোখা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।’ মাথা নিচু করে রফি জানালেন, ‘গান তো পুরোটা হয়নি। টাকা চাইব কেন?’ নৌশাদ সাব বুঝলেন, এ ছেলে অনেক দূর যাবে। প্রায় জোর করেই তিনি পাথেয় দিলেন মহম্মদ রফিকে। শুরু হল দুই সঙ্গীত সাধকের একসঙ্গে পথ চলা। নৌশাদের সুরে ১৪৯টি গান গেয়েছেন রফি। ১৯৫২ সালে বৈজু বাওরায় তাঁর গাওয়া ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে’ গান তো এখনও আসমুদ্রহিমাচল কাঁপায়।
সলামত রহো, সলামত রহো...
অনেক মিউজিক ডিরেক্টরের গ্রুপেই কাজ করেছেন লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল। তাই দুই বন্ধুকেই চিনতেন রফি। ছয়ের দশকের গোড়ায় এল-পি ভাবলেন, এবার স্বাধীনভাবে সুর দেবেন। প্রথম ছবি পরশমণি। ডিরেক্টর বাবুভাই মিস্ত্রি। গান লিখলেন আশাদ ভোপালি। আর তা গাইলেন মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, মুকেশ এবং কমল বারোট। এই ছবিতে রফি সাব একটি সোলো এবং লতাজির সঙ্গে একটি ডুয়েট গেয়েছেন।
স্টুডিওয় এলে ‘সলামত রহো, সলামত রহো’ গানটি রেকর্ড করলেন রফি সাব। লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল সম্মান-দক্ষিণা বাবদ তাঁর হাতে গুঁজে দিলেন এক হাজার টাকা। মুম্বই ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির তানসেন তো দেখে অবাক। তবে তিনি তা বুঝতে দিলেন না এল-পি’কে। পকেট থেকে দুটো এক টাকার নোট বের হল তাঁর। তারপর দু’জনের হাতেই তুলে দিলেন ৫০১ টাকা করে। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘এ আমার আশীর্বাদ। নিতে দ্বিধা কোরো না। ভবিষ্যতে তোমাদের সুরে প্রচুর গান গাইব।’
কথা রেখেছিলেন রফি। এল-পি’র সুরেই সবচেয়ে বেশি গান (৩৬৯) তিনি গেয়েছেন। জীবনের শেষ প্লে-ব্যাকও এই জুটির সুরেই।
জানে চমন শোলা বদন পহেলুঁ মে আ যাও...
প্লে ব্যাকে গানের সঙ্গে অভিনয় মেশাতে পেরেছিলেন বলেই মহম্মদ রফি কিংবদন্তি। এরজন্য তাঁকে বিশাল মেহনত করতে হয়েছে এমনটা নয়। গানের আগে জেনে নিতেন, কার লিপে গাইতে হবে। তারপর দৃশ্য ও মুড বুঝে নেওয়া ছিল রফি সাবের অভ্যাস। বাকিটা আপনাআপনিই হয়ে যেত। শাম্মি কাপুর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘গানের দৃশ্যে আমার অভিনয়ের সিংহভাগই করে দিতেন রফি সাব। আমি শুধুই লিপ দিতাম।’
জাভেদ আখতারের স্মৃতিচারণায় একটি ঘটনা এবার শোনা যাক, ‘গুমনাম ছবির গানের রেকর্ডিং হচ্ছে। ডুয়েট। গাইছেন রফি সাব এবং সারদাজি। কাচের ঘরে দু’টি মাইকের সামনে দু’জনে। সারদাজি গাইছেন, ‘ও মেরে দিল, মেরে হামদম, বাঁহো মে আ যাও’। রফি সাব তখন ঘরের একপাশে রাখা এক টেবিল থেকে জলের গ্লাসে চুমুক দিতে ব্যস্ত। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে শান্তভাবে মুখ মুছতে দেখলাম তাঁকে। এবার ঘুরে মাইকের কাছে পৌঁছনোর আগে রফি সাব দেখলেন, বাইরে এক বন্ধু বসে আছেন। কয়েক মুহূর্ত ইশারাতেই দু’জনের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান হল। সারদাজির অংশ তখন শেষের দিকে। যন্ত্রীদের অনেকেই প্রমাদ গুনছেন। রফি সাব ঠিক সময়ে ধরতে পারবেন তো? মিউজিক ডিরেক্টর শঙ্কর-জয়কিষণের মুখে অবশ্য উদ্বেগের বিন্দুমাত্র ছায়া নেই। কারণ মহম্মদ রফি কোন পর্যায়ের গায়ক, তা তাঁরা জানতেন। বন্ধুর সঙ্গে ইশারা পর্ব শেষ করে ঠিক সময়েই মাইকের কাছে এসে তিনি শুরু করলেন, ‘হোয় হোয়, জানে চমন শোলা বদন পহেলুঁ মে আ যাও।’ ঠিক যে অভিনয়টা রফি সাবের কণ্ঠে চেয়েছিলেন শঙ্কর-জয়কিষণ। এই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল, অভিনয়টা ওঁর রক্তে নয়, কণ্ঠে রয়েছে।’
কর চলে হাম ফিদা জানো তন সাথিয়োঁ...
৩০ জুলাই ১৯৮০। সোমবার। সন্ধে পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা তখন রাতের লক্ষ্যে ছুটছে। মুম্বইয়ের এক স্টুডিওয় ‘আসপাস’ ছবির রেকর্ডিংয়ে ব্যস্ত মহম্মদ রফি। রয়েছেন প্রোডিউসার-ডিরেক্টর জে ওমপ্রকাশ, সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল। গানের কিছুটা রেকর্ড হওয়ার পরেই প্যাক-আপ বললেন ওমপ্রকাশ। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গাড়িতে উঠলেন রফি সাব। শরীরটা ভালো নেই ঠিকই। কিন্তু এখন মনটাও কেমন খচখচ করছে তাঁর। কাজ বাকি রেখেই বাড়ির পথ ধরবেন? উঠে এলেন সেই সিঁড়ি বেয়েই। ওমপ্রকাশকে বললেন, ‘মাত্র চার লাইনই তো বাকি। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এখনই গেয়ে দিচ্ছি। রফি সাব রাজি তো কেয়া করেগা কাজি। মিনিট পনেরোর মধ্যেই কাজ শেষ। স্টুডিও ছাড়লেন তিনি। ফিরলেন বাড়িও। সেই তাঁর শেষ ফেরা। রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। মঙ্গলবার সকালে বলতে গিয়ে গলা ধরে এল কাইফি আজমির, ‘হকিকত ছবির ওই গানটার কথা মনে পড়ছে। কর চলে হাম ফিদা জানো তন সাথিয়োঁ...। আমারই লেখা গান... কিন্তু তাতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফি সাব। আজ থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।’