কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
সমৃদ্ধ দত্ত: ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আসুন। আপনাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমরা চাইছি। পিকিংয়ে নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা আমরাই করব। আপনি এলে তা হবে আমাদের সম্মান।’ চীন সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দলাই লামা ভাবছেন, কী করবেন। সরকারি আমন্ত্রণ। যাওয়া উচিত! কিন্তু তাঁকে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকা তিনজন মন্ত্রী একটি গোপন বৈঠক করলেন। সিংহভাগের মতামত হল, এটা চীনের একটা ফাঁদ। দলাই লামা বললেন, আমার নাগরিকদের মতামতই শেষ কথা। তাঁরা যা বলবে। তিব্বতিরা স্পষ্ট জানিয়ে দিল, পিকিংয়ে নিয়ে গিয়ে চীন আপনাকে শুধু যে গ্রেপ্তার করবে তাই নয়, হত্যাও করতে পারে। দলাই লামা চীনের প্রতিনিধিকে ডেকে বললেন, আমার পক্ষে এই সময় লাসা থেকে বেরনো সম্ভব নয়। ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯।
ঠিক একমাস পর লাসায় চীনের মিলিটারি হেড কোয়ার্টারের কমান্ডার একটি আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দলাই লামাকে বললেন, একবার আসুন আমাদের ক্যাম্পে। একটা স্পেশাল থিয়েটার শো হবে। আপনি আমাদের অতিথি। দলাই লামা আবার বললেন, নাগরিকরা যা বলবে, তিনি তাই করবেন। নাগরিকবৃন্দ এবার আর শুধু মুখে নিষেধ করল না। ১০ মার্চ তিব্বতি নাগরিকরা ১০ হাজার বাহিনীর একটি ফোর্স তৈরি করে সিদ্ধান্ত নিল, দলাই লামাকে পাহারায় রাখা হবে। দলাই লামার অফিশিয়াল রেসিডেন্স নরবু লিংকা প্যালেসকে ঘিরে ফেললেন ওই ১০ হাজার তিব্বতি। দিবারাত্র পাহারা। তাদের দাবি, দলাই লামার চাইনিজ ক্যাম্পে থিয়েটার দেখতে যাওয়ার কোনও দরকার নেই। এমনকী চীনের কমান্ডার দেখা করতে এলেও আটকে দেওয়া হবে।
একের পর এক আমন্ত্রণ উপেক্ষা? চীন রাগে ফুঁসছে। এই ছোট্ট জনপদ তিব্বত এত সাহস পায় কোথা থেকে? কাম্পাস বিদ্রোহীদের সঙ্গে চীনা বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ চলছে। চীনের কোনও সন্দেহ নেই এই বিদ্রোহীদের মদত দিচ্ছেন দলাই লামা। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অপেক্ষা হিংসাত্মক কিছু হওয়ার। দলাই লামার তিন মন্ত্রী পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য বোঝাতে চীনা মিলিটারি ক্যাম্পে গেলেন। কিন্তু তাঁদের দেখেই রুদ্রমূর্তি ধরে চীনের কমান্ডার বললেন, যা হচ্ছে তার কঠোর পরিণামের জন্য তৈরি থাকতে বলুন দলাই লামাকে। সব নীরবে হজম করে ফিরে এলেন তিন মন্ত্রী। আর ১৬ মার্চ হঠাৎ সন্ধ্যায় শোনা গেল, চীনের আর্মি লাসার দিকে আসছে। তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল। আরও লোক জড়ো করতে হবে। ১০ হাজারে হবে না। তাই পোটালা থেকে নাগরিকরা এসে যুক্ত হল। বাঁচাতে হবে দলাই লামাকে। এবার এসপার নয় ওসপার। কাম্পাস বিদ্রোহীরা এতদিন একাই জঙ্গল আর পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এবার চীন মরিয়া। তাই সকল নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। সারারাত ধরে দলে দলে মানুষ এল প্যালেসের দিকে। মশাল জ্বলছে। ঘিরে রাখা হয়েছে নরবু লিংকা। রাতে অবশ্য কিছু হল না...।
পরদিন ভোর। হঠাৎ তীব্র বিস্ফোরণ। দু’বার। হতচকিত সকলে। কী হল! চীনা সৈন্য বোমা ফেলছে? চরম আতঙ্ক। কিন্তু আর কিছুই হল না সারাদিন। রাতেও না। ১৭ মার্চ। নরবু লিংকাকে ঘিরে থাকা হাজার হাজার তিব্বতবাসী যথারীতি পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু সত্যিই লাসার অদূরে চীনা সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছে আক্রমণের। নিঃশব্দে। আর সেই সংবাদ চলে এসেছে নরবু লিংকা প্রাসাদের অন্দরে। তাই দ্রুত একটি বৈঠক হল মন্ত্রীদের। বড়জোর ১৫ মিনিট। এবং তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত। ২৩ বছরের দলাই লামার সঙ্গে কিছু মন্ত্রী, কয়েকজন দেহরক্ষী, তাঁর মা আর ভাইয়েরা। গোপনে মধ্যরাতে এক সুড়ঙ্গপথে বেরিয়ে এলেন প্রাচীরের বাইরে। কারও হাতে আলো নেই। পথটিও ঘুটঘুটে অন্ধকার। কারণ চীনা বাহিনী একবার অগ্রসর হলে শুধু তাঁকে গ্রেপ্তার কিংবা হত্যা করেই সংযত হবে না। গোটা তিব্বতবাসীকে ধ্বংস করে দেবে। কারণ চীন জানে, তিব্বতবাসী শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করবে না। তাই দলাই লামার এই গোপন পলায়ন। নিজেকে যতটা না, তার থেকে বেশি দেশবাসীকে বাঁচাতে। হাঁটতে শুরু করলেন দলাই লামা। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ? কোথায়? ইন্ডিয়া। একমাত্র দেশ, যেখানে যাওয়া যায় বিনা দ্বিধায়। কিন্তু ভারত তখনও কিছুই জানে না। যদি ভারত তাঁকে ঢুকতে না দেয়? দলাই লামা নিশ্চিত। জওহরলাল নেহরুর প্রতি তাঁর বিশ্বাস অটুট।
দিনের বেলা হাঁটা যাবে না। যে কোনও মুহূর্তে আক্রমণ করবে চীনের সেনা। তাই সেই সময়টায় পাহাড়ের গুহায় অথবা পথে কোনও গ্রাম পড়লে উপজাতিদের আশ্রয়ে থাকা। আর সারারাত ধরে হাঁটা। পাহাড় ডিঙোতে হচ্ছে। পেরতে হচ্ছে নদী। এভাবেই ২৬ মার্চ ২০ জনের দল লুনৎসে জং গ্রামে এসে পৌঁছলেন। ম্যাকমোহন লাইন বেশি দূর নয়। অর্থাৎ ভারতের সীমান্ত। তবে আরও কয়েকদিন হাঁটতে হবে। ঠিক সেই সময় দলাই লামার ফেলে আসা লাসায় চলছে চরম নৃশংসতা। দলাই লামাকে প্রাসাদে পাওয়া যাচ্ছে না, এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই তিব্বতবাসী ধরে নিয়েছিল এই কাজ চীনের। তারা তৎক্ষণাৎ চীনের সামরিক ক্যাম্পের দিকে এগেতে শুরু করে। আর এটাই চাইছিল চীন। দলে দলে আর্টিলারি ফোর্স এসে নির্মমভাবে লাগাতার ৪ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করল। বোমায় বোমায় প্রায় ধ্বংস করল প্রাসাদ। দলাই লামার সরকারকে উৎখাত করে গঠন করে দিল স্বশাসিত পরিষদ। সরাসরি পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার অধীনে। এবং চারটি বাহিনীকে পাঠানো হল দলাই লামাকে ধরতে। তিনি যে পথে পালাচ্ছেন। দলাই লামার ২০ জনের দল হাঁটছে। তাঁদের ধরতে ততক্ষণে ঝড়ের গতিতে যাচ্ছে চীনা বাহিনী।
লুনৎসে জং গ্রামে এসে দলাই লামা ভাবলেন, ভারতকে একটা খবর পাঠানো যাক। জওহরলাল নেহরুকে একটি চিঠি লিখলেন দলাই লামা। ...‘জটিল এক পরিস্থিতিতে আমরা ভারতে প্রবেশ করার দ্বারপ্রান্তে। আপনার অনুগ্রহপূর্বক অনুমতি পাব এই বিশ্বাস আছে। আশা করি আপনি কিছু ব্যবস্থা করবেন।’ সেই চিঠি নিয়ে আগে একজন দূত গেল সীমান্তে। চিঠির কথা জানতে পেরে, নেহরু তৎক্ষণাৎ দূত পাঠালেন। অসম রাইফেলসকে নিয়ে তাওয়াং আউটপোস্টের কাছে অপেক্ষা করছেন, নেহরুর দূত, পি এন মেনন। দলাই লামাকে স্বাগত জানাতে। দলাই লামার ২০ জনের দল সেই সময় ব্রহ্মপুত্র নদী পেরচ্ছেন কিছুটা সাঁতরে, আর মেকশিফট ডিঙিতে।
৩১ মার্চ ১৯৫৯। অবশেষে দলাই লামা খিনজেমানে সীমান্ত পেরিয়ে পা রাখলেন ভারতে। তাওয়াংয়ে প্রবেশ করতেই তাঁর হাতে নেহরুর চিঠি তুলে দেওয়া হল। যেখানে নেহরু লিখেছেন, আমি আর আমার সহকর্মীরা আপনাকে ভারতে স্বাগত জানাই... আমরা আনন্দের সঙ্গে আপনার ভারতে থাকার ব্যবস্থা গ্রহণ করব...’। তেজপুরে দলাই লামা ঘোষণা করলেন, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ভারতে এসেছি। কৃতজ্ঞ ভারত সরকারের কাছে। ঠিক ওই মুহূর্ত থেকেই ভারত এবং চীনের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইতে শুরু করল। ভারতকে চীন সেই দিন থেকে শায়েস্তা করার সুযোগ খুঁজতে শুরু করল, কারণ একটাই, চীনের শত্রু দলাই লামাকে কেন নেহরু আশ্রয় দিলেন? সেদিন অলক্ষে জওহরলাল নেহরুর ‘হিন্দি চীনি ভাই ভাই’ স্লোগান মুছে গেল ম্যাকমোহন লাইনে।
** *
ডিসেম্বর ১৯৫৯। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর দুর্ধর্ষ ডিরেক্টর বি এন মল্লিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে একটি নোট পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার এরিয়ার (নেফা) সাড়ে ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় কিন্তু একটিও আমাদের আর্মি পোস্ট নেই। হিউজ গ্যাপ। এই গ্যাপ থেকে চাইনিজ আর্মি যে কোনও সময় ঢুকতে পারে। তৎক্ষণাৎ তাওয়াং, বমডিলা আর ডিরাংয়ে মোতায়েন থাকা অসম রাইফেলসের চারটি ডিভিশনকে তুলে এনে এই গ্যাপে একের পর এক আউটপোস্ট নির্মাণ শুরু করে দিল ভারত। এবং তীব্র প্রতিবাদ জানাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল চীন। ভারত বলল, আমাদের টেরিটরিতে আমরা পোস্ট তৈরি করছি এবং করব। তোমাদের আপত্তি কিসের? ইতিমধ্যেই তোমরা বরং আমাদের এলাকার অন্তত ১০০ মাইল ঢুকে এসেছো। এই জায়গা খালি করে দিতে হবে। চীন বলল, সরব না। ১০ জুলাই জানা গেল, ভারতের একটি পোস্টকে ঘিরে ধরে চীনের বাহিনী ভারতের গোর্খা সেনাদের উদ্দেশে লাউডস্পিকারে বলছে, ভারতীয়দের হয়ে যুদ্ধ করবে না তোমরা। আমরা তোমাদের বেশি আপন। গোর্খা বাহিনীর তিনজন সেনা বেরিয়ে এসে সবার আগে গুলি ছুঁড়েছিল ওই লাউডস্পিকার লক্ষ্য করে।
সেপ্টেম্বর, ১৯৬২। নেফার বিভিন্ন অংশ জুড়ে যখন ভারত নিজেদের পোস্ট তৈরি করছে, আচমকা চীনের বাহিনী ঢুকে পড়ছে ভারতের অভ্যন্তরে। আর দখল করে নিচ্ছে একটি দু’টি পোস্ট। ভারতীয় সেনা নীরবে সহ্য করতে রাজি নয়। ৯ অক্টোবর তারা উলটে চীনের এলাকায় ঢুকে পড়ে চীনেরও দু’টি পোস্টে নিজেদের পতাকা উড়িয়ে দিল। ১৩ অক্টোবর দিল্লির পালাম এয়ারপোর্টে জওহরলাল নেহরুকে সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন, চীন সীমান্তের খবর কী? কতদিন লাগবে অনুপ্রবেশকারী চীনা সেনাকে সরিয়ে দিতে? নেহরু দৃশ্যতই রেগে যান। কারণ, তাঁকে এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে টেলিগ্রাম করে ততক্ষণে নেফার এরিয়া কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল বি এ কাউল বলেছেন, চাইনিজ আর্মি হেভি ডেপ্লয়মেন্ট হয়েছে। আমরা স্যার আউটনাম্বারড! ওদের থেকে সংখ্যায় কম। সরে আসা উচিত আমাদের। নেহরু কী সিদ্ধান্ত নেবেন বুঝতে পারছেন না। নেহরু তাই সাংবাদিকদের বললেন, আর্মিকেই সব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেখা যাক।
২০ অক্টোবর চীন সামগ্রিকভাবে আক্রমণ করেছিল ভারতকে। ১৯৬২ সালের সেই যুদ্ধে ভারত যথেষ্ট কোণঠাসা হয়। বস্তুত চীনের সেমি অটোম্যাটিক রাইফেলের সঙ্গে ভারতীয় সেনারা থ্রি নট থ্রি দিয়ে লড়াইয়ে অসম সাহসের পরিচয় দিয়েও পরাস্ত হয়। চীন একটা সময় আচমকা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ভারতের এলাকা থেকে সরে যায়, এসবই জানা তথ্য। তবে দখলীকৃত জমি সবটাই চীন ছাড়েনি।
চীনের কাছে ১৯৬২ সালে ভারতের ওই কোণঠাসা হওয়ার সংবাদ নতুন নয়। আমরা বরং অসমসাহসী কিছু সেনা জওয়ানের অসংখ্য ঘটনার একটিমাত্র কাহিনী মনে রেখে দিই। লাদাখের চুশুল সীমান্তে ১১২ জন আহির সেনা (যাদব) শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে। যখন তাদের হাতের অস্ত্র পর্যন্ত কেড়ে নেয় চীনা বাহিনী, তখন রাম সিং নামে এক জওয়ান খালি হাতে মুখোমুখি হন ১০ জন চীনা সেনার। আর একাই তিনি ১০ জনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে একের পর এক চীনা সেনাকে পাহাড়ের গায়ে নিয়ে যান এবং ধরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে পাথরের উপর ফেলতে থাকেন। তিনি ছিলেন হরিয়ানার এক কুস্তিগীর। ১০ জন চীনা সেনাকে এভাবেই পাহাড়ের দেওয়ালে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলেন এই রাম সিং। ওই বিক্রম দেখে পাহাড়ের ঠিক বিপরীত প্রান্তে অবস্থানরত চীনা সেনা আর অগ্রসর হয়নি। ভয়ে। তারা পালিয়ে গিয়েছিল। আজও হরিয়ানায় এই বীরগাথার উৎসব পালন করা হয়।
** *
২০২০। মে মাস। অবিকল সেই একই পরিস্থিতি। ভারত যেই কারাকোরাম হাইওয়ের কাছে পৌঁছনোর মতো সড়ক নির্মাণে জোর দিয়েছে, চীনের নাকের ডগায় উপস্থিতি বোঝানোর জন্য যখনই উত্তরাখণ্ডে নতুন সড়ক নির্মাণ করছে, তখনই বেজিং আবার শুরু করেছে ১৯৬২ সালের গেমপ্ল্যান। এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতোই। হিমালয় ঘেঁষে চীনের মোট ১৪টি এয়ারবেস রয়েছে। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, অরুণাচল আর সিকিমের উল্টোদিকে। চীন ভেবেছিল ভারত সড়ক নির্মাণ করলেও এয়ারফোর্সে জোর দেবে না। কিন্তু আচমকা দেখা গেল, ভারত জিরো, টুটিং, পাসিংঘাট আর মেচুকায় অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড তৈরি করে ফেলেছে। এসে গিয়েছে সি ওয়ান থার্টি হেভি ট্রান্সপোর্টার। সুতরাং চীনের মনে সংশয় ঢুকেছে। ভারতের লক্ষ্য কী? সংশয়ের কারণ, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার অতি বন্ধুত্ব। আর করোনার সময়কালে আমেরিকা বনাম চীন বিরোধ চরম অবস্থায় যাচ্ছে।
ঠিক এরকমই এক অবস্থায় সিকিম সীমান্তের এক ভারতীয় যুবক লেফটেন্যান্ট এমন একটা অপমান করে বসেছে, যা এখনও চীন হজম করে উঠতে পারছে না। সিকিমের চীন সীমান্ত মুগুথাঙে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢুকে চীনের বাহিনীর এক অফিসার আচমকা চিৎকার করে বলে ওঠে, এই সিকিম ইন্ডিয়ার ল্যান্ড নয়। এটা চীনের। সিকিমকে ছেড়ে দিতে হবে। দু’পক্ষই উত্তেজিত। সংঘাতের পরিস্থিতি। ধাক্কাধাক্কি চলছে। অফিসাররা বলছেন, এরকম কথা আমরা মেনে নিতে পারি না। সেই যুবক লেফটেন্যান্ট এত কিছু ভালো ভালো কথার তোয়াক্কা করেননি। তিনি ওই ধাক্কাধাক্কির মধ্যেই জাম্প করে সামনে হাজির হন এবং চীনের যে অফিসার ওই কথাটি বলেছেন, তাঁর মুখের উপর স্রেফ একটা বক্সিং পাঞ্চ। এক মুহূর্তে নাক থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে শুরু করেছিল ওই চীনা জওয়ানের। সকলেই এক মুহূর্ত হতচকিত হয়ে যায়। অফিসাররা এরপর তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেলেও, গোটা সেনাবাহিনীর মধ্যে এখন ওই যুবক লেফটেন্যান্টের জয়গান চলছে। আর চীন এখনও ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে একটা বাচ্চা ছেলের হাতে হওয়া এই অপমানে।
চীনের আগ্রাসী প্ল্যান মোটামুটি একইভাবে এগচ্ছে। ১৯৬২ সালের ধাঁচে। প্রথমে লাদাখ সীমান্তে ঢুকে দাদাগিরি। ভারতের আউটপোস্ট কিংবা সড়ক নির্মাণে আপত্তি তোলা। লাদাখ, অরুণাচল প্রদেশ, আকসাই চীন, সিকিম। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বহুদিনের গোপন বাসনা এবং পলিটব্যুরোয় একাধিকবার আলোচনাও হয়েছে যে, একদিন এই প্রতিটি লোকেশন চীনের হবে। ভারত একথা জানে। ভারত কী করছে? বিপুল পরিকাঠামো বাড়াতে শুরু করেছে চীন সীমান্তে। ১) চারধাম যোজনার কেদার, বদ্রী, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রীর ৮৯০ কিলোমিটার জাতীয় সড়কের উন্নয়ন বড় কথা নয়, আসল কথা এই রোড ভারতীয় সেনাকে আরও দ্রুত পৌঁছে দেবে চীন সীমান্তে। ২) ভারত ৭৩টি আইসিবিআর নির্মাণ করছে। আইসিবিআর মানে কী? ইন্দো-চায়না বর্ডার রোড। যার মোট দৈর্ঘ্য হল ৩ হাজার ৩৫০ কিলোমিটার। ১৯৯৯ সাল থেকে চলছে এই রাস্তাগুলি। ৩) ডারবুক থেকে শায়ক হয়ে দৌলত বেগ রোডের শেষপ্রান্ত বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ এয়ারস্ট্রিপে গিয়ে থামবে। এই প্রজেক্টের নাম ডিএস ডিবিও। এটাই সবথেকে চীনের মাথাব্যথা। কারণ এই রাস্তা চীনের অধিকারে থাকা আকসাই চীনের দিকে এগচ্ছে। ১৯ বছর ধরে এই রাস্তা নির্মাণ চলছে। এখন সমাপ্তির পথে। এই প্রত্যেকটি কর্মসূচির বিরোধী চীন। পাশাপাশি বিশ্ববাণিজ্যে চীন আগামীদিনে ধাক্কা খেতে চলেছে। বহু সংস্থা ও দেশ চীনের দিক থেকে মুখ ফেরাচ্ছে। তাই চীনের ক্ষোভ বাড়ছে। বাড়ছে প্রতিশোধস্পৃহা। তাই সীমান্তে সেনা মোতায়েন। পাল্টা ভারতও চোখ সরাচ্ছে না। লাদাখে চলছে স্নায়ুর লড়াই।
চীনের টার্গেট কী? বিশ্বের সুপারপাওয়ার হওয়া। সেই লক্ষ্যে চীনের ধ্রুবপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়ান বেল্ড ওয়ান রোড প্রকল্প। যেখানে ভারত যোগ দিচ্ছে না। জিং জিয়াং থেকে আধুনিক যুগের সিল্ক রুট করতে চায় চীন। যাবে মধ্য এশিয়া, কাজাকাস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইতালি। সমুদ্রপথের প্রস্তাবিত রুট কি? চীনের ফুজিয়ান থেকে ইতালির ভেনিস। এই গোটা প্রকল্প যদি কখনও বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাণিজ্য সম্ভাবনা কতটা? তিন লক্ষ কোটি ডলার! চীন পৃথিবীর নতুন সম্রাট হতে চায়! এই পথে যে আসবে, তাকেই চীন সরিয়ে দেবে যেন তেন প্রকারেণ। এরকমই এক আগ্রাসী মনোভাব ক্রমেই স্পষ্ট। আমেরিকা নয়। রাশিয়া নয়। চীনের মনোবাসনা সর্বাগ্রে একটাই। ভারত তার বশ্যতা স্বীকার করুক। গোটা দুনিয়া চীনের ঋণের ছাতায় অবনত। অথচ পাশেই থাকা ভারত কীভাবে অর্থনীতিকে এখনও এতটা শক্তপোক্ত রেখেছে? এটাই চীনের কাছে বিস্ময়। তাই ভারতের মেরুদণ্ড ভাঙতে হবে বাণিজ্যে, অর্থনীতিতে এবং প্রেস্টিজে। সীমান্ত আগ্রাসনের কারণ ভয় দেখানো। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। সীমান্ত সতর্কতাই শেষ কথা নয়। আরও হাই প্রোফাইল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এখন।
২০০১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে চীন বনাম আমেরিকার প্রবল এক চাপানউতোর চলছিল। হঠাৎ ওই কূটনৈতিক যুদ্ধের মধ্যেই একের পর এক আমেরিকান কর্পোরেট অফিস, সেনেটরদের দপ্তর এবং সংবাদপত্র ভবনে চিঠি আসতে শুরু হল। চিঠি খোলার পরই একের পর এক কর্মী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। অথবা মৃত্যু। অন্তত ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল! কে পাঠিয়েছে ওইসব বিষাক্ত চিঠি? কেউ জানে না। প্রমাণ নেই। সন্ত্রাসবাদী হতে পারে। কিন্তু আমেরিকার একটি সন্দেহ যে, ওই কাজ ছিল চীনের! প্রতিটি চিঠিতে মেশানো ছিল ভয়ঙ্কর অ্যানথ্রাক্স জীবাণু! ওই ঘটনা সত্য-মিথ্যা যাই হোক, ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে সবকিছুর জন্য। নিছক সীমান্তে ফিজিক্যাল যুদ্ধ চীনের কাছে পুরনো হয়ে গিয়েছে। বেজিংয়ের আধুনিক এক্সপেরিমেন্ট, বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার! ভারত তৈরি তো?