বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
করোনা কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও, ঋণাত্মক চাপ বা নেগেটিভ প্রেশার বজায় রাখার জন্য খুব ঠান্ডা রাখা যায় না। আমাদের পরনে থাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা পোশাক। এই ধরনের পোশাকে হাওয়া বা তরল পদার্থ জামা ভেদ করে ঢুকতে পারে না। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীর ঘামে ভিজে যায়। পাশাপাশি চোখে চশমা ও মুখে মাস্ক পরতে হয়। এই বিশেষ মাস্কের নাম N-95 বা FFP2। বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি ভেদ করে করোনার জীবাণু শ্বাসনালীতে প্রবেশ করার সম্ভাবনা৯০ শতাংশেরও বেশি কম। কিন্তু সমস্যা হল, এটা পরে শ্বাস নিতে প্রচণ্ড অসুবিধা হয়। ফলে দম বন্ধ হয়ে আসে, মুখমণ্ডল ঘেমে যায়। তাই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, চশমার কাচে বাষ্প জমে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। পাশাপাশি এই মাস্ক নাকের ব্রিজের উপর চেপে বসে ব্যথার উদ্রেক করে।এই গোটাটা মিলিয়ে হচ্ছে পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট বা পিপিই। পিপিই একবার পড়লে জল বা খাদ্য গ্রহণ করা যায় না, এমনকী শৌচালয়েও যাওয়া যায় না। প্রায় ছয় থেকে আট ঘণ্টা একটানা এভাবে কাজ করতে হয়।
তবে এই আমানুষিক পরিশ্রমের শেষে আমাদের পাওনা একটাই। সেটা হল, মানুষের সুস্থ হয়ে ওঠা, বাড়ি ফিরে যাওয়া। আর আশার কথা, করোনা রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই ভালো হয়ে ওঠেন। ব্যতিক্রম খুব বয়োজ্যেষ্ঠ বা যাঁদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। কারণ, তাঁরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আসলে, করোনা ভাইরাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্তনালীর অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠের উপর হামলা করে। এর ফলে কিডনিজনিত সমস্যা দেখা যায়, মস্তিষ্কের স্ট্রোক কিংবা হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়ে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফুসফুসের। এআরডিএস জাতীয় রোগ থেকে শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হয়। তখন কিছুক্ষেত্রে আমাদের ভেন্টিলেশনের সাহায্য নিতে হয়। ‘ভেন্টিলেশন’ শব্দটা শুনলেই সাধারণ মানুষ বেশ ভয় পান। কিন্তু শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভেন্টিলেশন লাগে না। তাই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মানেই কিন্তু মৃত্যু নয়...।
তবে করোনা কক্ষের মধ্যে অনেকগুলি অনুভূতি একত্রে বাস করে। রোগীদের চোখেমুখে যেমন মৃত্যুভয় ফুটে ওঠে, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও কাজ করে একটা অসহায়তা। কেননা,এই ভাইরাসের কোনও প্রতিষেধক এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। যা চিকিৎসা চলছে, সবই পরিস্থিতির উপর বিচার করে পরীক্ষামূলকভাবে। কিছু ক্ষেত্রে আশার আলো দেখা গেলেও, বেশিরভাগটাই একটা শেষ চেষ্টা করে দেখার প্রবণতা।
আর একটা দিক হল, পরিবারের থেকে দূরে থাকার সর্বগ্রাসী যন্ত্রণা। রোগীদের আত্মীয়-স্বজন সবাই কোয়ারেন্টাইনে। তাই তাঁদের পক্ষে হাসপাতালে আসা অসম্ভব। যাঁরা বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি, তাঁদেরও করোনা কক্ষে ঢোকার অনুমতি নেই। অর্থাৎ, অসুস্থতার মধ্যে প্রিয়জনের পাশে পরিবারের কেউই উপস্থিত থাকতে পারছেন না। চিকিৎসকের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় যোগাযোগ স্থাপন হয় টেলিফোন কিংবা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে। কিন্তু বাড়ির লোকের কাছে খবরাখবর পৌঁছে দিতে এই দূরভাষ মাধ্যম অনেক সময়ইকাজ করতে চায় না মানসিকভাবে। মানে, যে রোগী মুমূর্ষু, বাঁচার আশা খুব কম, তাঁদের বাড়ির লোককে এই সংবাদ ওইভাবে কি দেওয়া যায়! যে পরিবারের মানুষের সঙ্গে একবারও সাক্ষাৎ হয়নি, তাঁদের কাছে মৃত্যু সংবাদ শুধু টেলিফোনের মাধ্যমে কি পৌঁছে দেওয়া উচিত?
এতো গেল রোগী বা তাঁর পরিবারের কথা। চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুভূতি, যন্ত্রণাটা কীরকম? গোটা দিন করোনা আক্রান্তের সেবা-শুশ্রূষা করার পর দিনের শেষে তাঁদের মনে প্রশ্ন উঠছে, বাড়ির লোকের কাছে আমরা এই ভাইরাসকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি না তো! কারণ, চিকিৎসা করতে করতে অনেক সময় কিছু স্বাস্থ্যকর্মী নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাই, পরিবার-পরিজনের থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেকে। ফলে প্রিয়জন ও কর্তব্যের মধ্যে এক অদ্ভূত দোটানায় ভুগতে থাকেন তাঁদের অনেকেই। এ এক নিষ্ঠুর রোগ, নির্মম সমাজচিত্র। এরকম আগে কখনও দেখিনি।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবী অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। একদিকে মৃত্যুভয়, অন্যদিকে অর্থাভাব। কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে, সেটা ভেবেই এখন মানুষ হাঁপিয়ে উঠছে। দেশে আক্রান্তের লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এটা তথ্য যেমন উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তেমনই মানুষকে একটা সময় কাজে ফিরতেই হবে, এই কঠোর বাস্তবকেও উপেক্ষা করা যায় না। তাই সতর্ক থাকার সময় এসেছে।খোলা বাজার থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধ কামরা, যেখানে অনেক মানুষের সমাগম, সেখানে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই মেট্রো রেল, লাইব্রেরি, অফিস ইত্যাদি জায়গায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে অনেক বেশি।আশেপাশে দেখতে পাচ্ছি, মাস্ক পরে এক অদৃশ্য উৎসাহের সূচনা হয়েছে। কিন্তু শুধু মাস্ক পরলেই সুরক্ষিত থাকা যাবে না। রোগ প্রতিরোধের বাকি দু’টো স্তম্ভের কথা মানুষ প্রায়ই ভুলে যাচ্ছেন। মনে রাখবেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও হাত ধোয়ার বিকল্প কিন্তু মাস্ক পরা নয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভাইরাসের ক্ষমতা হ্রাস পায়। এখন প্রয়োজন সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার মনের জোর। আর আগামী বেশ কিছু মাস এই নতুন জীবনধারাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়ার অধ্যবসায়...।
কনসালটেন্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন