কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
—‘ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বাস আসছে। হোটেল গেস্ট হাউসও ঠিক করা আছে। ওঁদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আমাদের। একটু দেখে নেবেন, ওদের যেন কোনো সমস্যা না হয়।’
—‘অবশ্যই দেখব ম্যাডাম, আপনি সুস্থ থাকুন।’
—‘আপনারা সুস্থ থাকলেই আমরা ভালো থাকব। সবাই খুব সাবধানে কাজ করুন।’
দ্রুতলয়ে হেঁটে গাড়িতে উঠে এনআরএস হাসপাতালের দিকে রওনা হলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সবে শুরু হয়েছে লকডাউন। অনেকেই বিভ্রান্ত। বাড়ি ফিরব কীভাবে, সব ক্যান্টিন প্রায় বন্ধ, বন্ধ হোম সার্ভিস... খাব কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী এসে উদ্বুদ্ধ করে যেতেই বোঝা গেল, লড়াইটা কঠিন। তবু জিততেই হবে আমাদের। গেস্ট হাউস, বাসরুট ঠিক করলেন ডেপুটি সুপার। পুরোদমে চালু হয়ে গেল ফিভার ক্লিনিক। ওয়ার্ডগুলোতে সন্দেহজনক কোভিড রোগীদের জন্য চালু হল আইসোলেশন ওয়ার্ড। মাস্ক, পিপিই কিটের অভাব অনেকটাই মিটে গেল।
জীবন বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছি আমরা। সুপার, ডেপুটি বাড়ি ফিরছেন মধ্যরাতে। ওদিকে ইতালি, ইংল্যান্ড থেকে এসে পৌঁছচ্ছে একের পর এক ডাক্তারের মৃত্যুর খবর। একদিকে জনগণ তালি বাজিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। অন্যদিকে, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িছাড়া হচ্ছেন! একদিকে কুর্নিশ , অন্যত্র বাড়িতে ঢোকামাত্র সবাই যেন ভূত দেখছে, দৌড়ে পালাচ্ছে! এত কাজের চাপ, যখন তখন আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, রাতে বাড়ি ফিরে মনে চোরা ভয়, কখন কে বলে বসে... আপনি আর এই আবাসনে না ফিরলেই ভালো!
চেন্নাইয়ে কোভিডে মৃত চিকিসকের শববাহী গাড়ি তাড়া করছে উন্মত্ত জনতা, কোনওরকমে প্রাণ হাতে করে দেহ কবর দিচ্ছেন সঙ্গী ডাক্তার। শেষকৃত্যে থাকতে পারলেন না চিকিৎসকের বাড়ির লোকজন। অসহ্য লাগত, দম বন্ধ হয়ে আসত আমাদের, মনে হতো, এই আমাদের জন্মভূমি? এ দেশেই আমাদের জন্য দিয়া জ্বালান কোটি কোটি ভারতবাসী! এখন কোভিডে আমি মরে গেলে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাও থাকতে পারবে না শেষ দেখাটুকু দেখতে! মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, তীব্র বিষাদে জুড়োতে চায় না চোখ, এ কোন পেশায় এলাম? জানপ্রাণ দিয়ে করোনার সঙ্গে লড়ে যাওয়া আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কী ভবিতব্য অপেক্ষায় আছে! জুনিয়র ডাক্তাররা সন্তানসম, ওদের জন্য বুক ভেঙে যায়।
কেউ হাসি না আর, ক্যাপমাস্কের আড়ালে শুধু যোদ্ধার জোড়া জোড়া চোখ। কাজের ফাঁকে আড্ডা কবে চুকেবুকে গেছে। সকাল থেকে রাত, শুধু রোগী দেখা আর অপেরেশন। জ্বর হয়েছে রোগীর? শ্বাসকষ্ট আছে? বাইরে থেকে এসেছেন? বাইরের দেশ থেকে কেউ এসেছে বাড়িতে? রুটিন প্রশ্ন করতে শিখছি সবাই। ভুল হলেই বিপন্ন হব। পড়াশোনা করতে হচ্ছে, জেনে নিতে হচ্ছে গাইডলাইন। সাবধান হতে হচ্ছে রোগী দেখায়, অপারেশন টেবিলে। আলাদা ওটি হচ্ছে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। জুনিয়ররা বাঁচাতে চাইছে আমাদের... ‘আপনি সাবধান স্যার, আমি নামছি ওটিতে’, নন্দিনীর কথা শুনে মনে হয়, এখনও সব আলো যায়নি নিভে।
দিনগুলো মেঘাচ্ছন্ন তবু, মৃত্যুর খবর দিচ্ছে। একের পর এক ডাক্তার, সিস্টার, স্বাস্থ্যকর্মী চলে যাচ্ছেন কোয়ারেন্টাইনে। চারদিক থেকে আসছে ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়ার খবর। না, ভয় পাইনি আমরা... এতটুকু না। যখন যেমন দরকার, নিজেদের কাজ করে গিয়েছি। ওটিতে ফিরে আসছে রসিকতা। সিজারে সদ্যোজাতকে হাতে নিয়ে নাম দিচ্ছি লকডাউন সিং! পিপিই কিট পরা পিজিটি পৌলমীকে ডাকছি ‘ফ্রন্টলাইন’ বলে। মানুষ যে আজকাল আমাদের ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র’ নামে ডাকে!
প্রকৃতি আহ্লাদে আছে, গাছের সবুজ পাতায় পিছলে পড়া আলো। জারুল কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া দেখে খুশির তুফান ওঠে প্রাণে। হাসপাতালের বাগানে মাদক কামিনীর ফুটফুটে সাদা পাপড়ি ঝরে পড়ে করতলে। কনকচাঁপার গন্ধে মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া মাকে। চড়াই, শালিক, টিয়া, দোয়েল, ঘুঘু, কাঠবিড়ালি লকডাউনের বন্ধু হয়ে যায়। পুলিসকে জানিয়ে সন্ধ্যায় চলে যাই নদীর কিনারে। দূষণহীন বাতাস, নিঃশব্দ পথ, গান গাইছে নদী। গঙ্গায় স্ফটিকস্বচ্ছ জল বহুযুগ বাদে। মনে হয় আঁজলা করে তুলে খাই। গঙ্গায় শুশুক নাকি আসছে আবার। নদীর পশ্চিম তীরে অপার্থিব সূর্যাস্ত ওই। রঙের উৎসব দেখে হারিয়ে যায় মনখারাপের চিঠি।
লকডাউন কত কী শিখিয়ে দিয়ে যায়! উর্দির আড়ালের পুলিসকে চেনা হল নতুন করে। দেখলাম পুলিসের এতকাল লুকিয়ে থাকা মানবিক মুখ। দেখলাম, আমাদের চাঙ্গা রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ওরা। হয়তো ডাক্তার আর পুলিস খেটেছে, মানুষের দুঃখ দেখেছে সবচাইতে বেশি। দু’জনেই সমব্যথী তাই। নতুন করে চিনছি আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাইকর্মীদের। মানুষ ভয়ে কাঁপছে ঠকঠক করে। ওঁদের মাইনে কম, তবু দায়িত্ব নিয়ে করে যাচ্ছেন কাজ। মেন বিল্ডিংয়ের এক লিফটম্যানের কোভিড ইনফেকশন হল, ভর্তি হলেন আইডি হাসপাতালে। তবু কাজ করে গেলেন অন্য লিফটম্যানেরা।
একটা ভাইরাস এসে কেড়ে নিল কত কত মানুষের কাজ। কত মানুষ কাল কী খাবেন, ভেবে হলেন নিদ্রাহারা। বাস নেই, নেই ট্রেন, অটো। রোগীর বাড়ির লোক হাসপাতালে রাত কাটাবেন ভুখা পেটে? এগিয়ে এল পাড়ার ছেলেদের দল। সাধ্য মতো খাবার দিল দু’বেলা ওদের। হাজার হাজার বেসরকারি সংস্থা রাজ্যজুড়ে, দেশজুড়ে নিরন্ন অভুক্ত মানুষকে জোগাল রেশন, দু’বেলার খাবার। যাদবপুর আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জোট বেঁধে আজও কলকাতা ও কলকাতার বাইরে প্রত্যন্ত জেলায় একটানা চালিয়ে যাচ্ছে কমিউনিটি কিচেন। মন্মথর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল লকডাউন, আরও কত তরুণের সঙ্গে। মাঠে, গাছতলায়, পাড়ার পার্কে উনান জ্বালিয়ে খাবার রান্না করছেন যাঁরা, নিরন্নকে জোগাচ্ছেন অন্ন, তাঁদের দিকে তাকাতেই সব বিষাদ কেটে গিয়েছে গত ষাট দিনে।
তবু বুক ভেঙে যায়। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক হেঁটে চলেছে নিরন্তর। টাকা নেই, খাদ্য নেই, নেই যানবাহন। নো পলিটিক্স প্লিজ! তত্ত্ব ভুলতে শেখাল লকডাউন। ডাক্তার হলেও নাগরিক তো বটে! প্রশ্নটা কুড়ে খায়, বলার সময় এসেছে। দেশজুড়ে লকডাউন শুরু করতে এত তাড়াহুড়ো কেন? কয়েকটা দিন সময় নিয়ে, পরিকল্পনা করে সবাইকে ঘরে ফিরিয়ে দুয়ার আটকানো যেত না কি?
শরীরের দক্ষ মিস্ত্রি আমরা, জানি ছোঁয়াচে রোগ, ভাইরাস, সংসর্গ এড়িয়ে চলার বিধি ব্যাকরণ। লকডাউন অবশ্য দরকারি, একমাত্র পথ কিন্তু নয়। রাতারাতি সব বন্ধ করে দেওয়া মানে সমাজে গভীর ক্ষত। হয় তুক, নয় তাক করে কোভিডের রোগী হয়তো কমে, ঢাকা যায় না দেশে জনস্বাস্থ্যের গভীর বিবর।
তবু বাজারই শেষ কথা নয়, শেষ কথা বলে না যুদ্ধবিমান-মিসাইল-সাবমেরিন। শেষ কথা ভালোবাসা, আরোগ্যের রাষ্ট্রীয় আশ্বাস। শেষ কথা কর্মহীনতার প্রতিষেধক বটিকা। স্বাস্থ্য মানে শুধু রোগের চিকিৎসা নয়, স্বাস্থ্যের জন্য চাই গরিবের, প্রান্তিক মানুষের সুষম আহার। দায় শুধু স্বেচ্ছাসেবীদের? নাকি রাষ্ট্রেরও?
আত্মঘাতী বাঙালির দ্বিচারিতার কোনও শেষ হয়তো নেই। লকডাউন তবু প্রশ্ন রেখে যায়...।
লেখক: আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক