গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
প্রশ্ন: ‘চারুলতা’-র জন্য নিজেকে কীভাবে তৈরি করেছিলেন?
মাধবী: ছ’বছর বয়স থেকে কাজ করা শুরু করেছিলাম। তারপর নানা পথ পেরিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে কাজ। ‘সাহসিকা’ বলে একটি ছবিতে হিরোইনের ছেলেবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ওঁর আরও তিন-চারটি ছবিতে কাজ করেছি। এই দিয়েই শুরু। ননস্টপ কাজ করে গিয়েছি। এরপর তপন সিংহের ‘টনসিল’ ছবিতে আমি নায়িকা। একে একে মৃণাল সেন হয়ে ঋত্বিক ঘটক, তারপর সত্যজিৎ রায়। যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছি, তাঁরাও সব বিরাট বিরাট শিল্পী। ছবি বিশ্বাস থেকে শুরু করে শিশির ভাদুড়ী, সরযূবালা দেবী-প্রভা দেবী—এই সব বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাছ থেকেই আমার শিক্ষালাভ। সত্যজিতের সঙ্গে আগে ‘মহানগর’(১৯৬৩), তারপর ‘চারুলতা’ (১৯৬৪)। ‘চারুলতা’ নিয়ে নতুন করে ভাবার কিছু ছিল, এমনটা নয়। আমি শুধু নিজের চরিত্রটা নিয়েই ভেবেছিলাম। যেভাবে আগে বলে যেতেন, তাতেই বোঝা যেত উনি (সত্যজিৎ) ঠিক কী চাইছেন। সেভাবেই করতাম। যে চরিত্রের যেমন প্রয়োজন, উনি ঠিক সেভাবেই সেই শিল্পীকে গাইড করতেন।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের গল্প, ‘নষ্টনীড়’-এ অভিনয় করছেন, এটা মনে আলাদা করে কোনও দাগ কেটেছিল?
মাধবী: রবীন্দ্রনাথের লেখা বই পড়তে তো অবশ্যই ভালো লাগত, এখনও লাগে। যখন উনি (সত্যজিৎ) বললেন যে ‘নষ্টনীড়’ করব, তুমি ‘নষ্টনীড়’টা পড়ো... তখন আমি বলেছিলাম, ওটা আমার পড়া। তাতে উনি বললেন, না আমি পাঠাচ্ছি, তুমি আবার পড়ো। তখন আবার পড়লাম। তারপর উনি ডেকে পাঠালেন।
প্রশ্ন: সত্যজিৎ নিজে বলেছেন, ‘চারুলতা’ ওঁর সবচেয়ে নিখুঁত ছবি, দর্শকদের একটা বড় অংশের মধ্যেও অন্যতম প্রিয় সত্যজিতের এই ছবিটি। সে ব্যাপারে আপনার কী মত?
মাধবী: সেটা হয়তো আজ এসে বলাই যায়। কিন্তু যখন ‘চারুলতা’ হয়েছে, তখন কিন্তু অনেক রকমের সমালোচনা হয়েছে। ছবির নাম ‘চারুলতা’ কেন, তাই নিয়েই আপত্তি তুলেছেন অনেকে। প্রথমে কিন্তু ‘নষ্টনীড়’-ই নাম ছিল। আমার বাড়িতে কখনও এলে দেখবেন, সেই ‘নষ্টনীড়’-এর একটা পোস্টার রয়েছে। সেই পোস্টার সব ছাপানো হয়ে গিয়েছিল। তারপরে জানা গেল, ‘নষ্টনীড়’ (১৯৫১) নামে সুনন্দা দেবীর একটা ছবি আছে, তাই এক নামে দু’টো ছবি করা যাবে না। তখন উনি ‘চারুলতা’ নাম দিলেন।
প্রশ্ন: এই ছবির শ্যুটিং যতদিন ধরে হয়েছে, তার মধ্যে কোনও স্মরণীয় ঘটনা বলবেন?
মাধবী: লম্বা সময় ধরে শ্যুটিং চলেছিল। বসে থাকতে হতো। অনেক সময়ই শিল্পীদের বোর লাগত। তখন মানিকদা মজা করতেন... ম্যাজিক দেখাতেন। যাতে আমরা উজ্জীবিত থাকি। ছবিটা হয়ে যাওয়ার পরে স্টুডিওতে দেখার ব্যবস্থা ছিল। ছোট হাউসের মতো। সেখানে সব টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে শিল্পী—সবাই মিলে আমরা দেখেছিলাম ছবিটা। দেখার পরে মানিকদা বললেন, “ছবিটা ভাই ভালো হয়েছে। তবে চলবে কি না, বলতে পারছি না!”
প্রশ্ন: ‘চারুলতা’য় অভিনয়ের পরে কী রকম অনুভূতি হয়েছিল, নিজের মতো করে কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন?
মাধবী: সত্যজিতের ছবিতে নিজের মতো করে ভাবার কিছু থাকে না। এমন ভাবে স্ক্রিপ্টটা লেখা থাকে, তাতে নিজের আলাদা করে ভাবার দরকারই পড়ে না।
প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে আবার তাঁর ছবি নিয়ে চর্চা হচ্ছে, এখনও তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক, আপনার কী মনে হয়?
মাধবী: প্রাসঙ্গিক শব্দটা আপনি ব্যবহার করছেন। প্রাসঙ্গিকই যদি হবেন, তাহলে তো দেখা যেত, এখনও ওঁর স্টাইলে, অনুপ্রেরণায় ছবি হচ্ছে। সত্যজিতের যত ছবি রয়েছে, তার মধ্যে কোনও ‘ভালগারিজম’ নেই। সব ছবির মধ্যে একটা নিখাদ সৌন্দর্যের জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়। সেই জায়গাটা কি আপনি এখন পাচ্ছেন এ যুগের ছবিতে? সাধারণ লোকে তাঁকে মনে করছে ঠিকই। কিন্তু ওইটুকুই। তাঁর প্রভাব এ কালের ছবিতে সেভাবে পড়ল না। এটা দুঃখজনক লাগে আমার। এখন একটা রোম্যান্টিক সিন হলে কেউ দোলনায় দোলে না, তারা নাচে। একশো ছেলেমেয়ে মিলে নাচ-গান হয়! এটা কোন ধরনের রোম্যান্টিকতা, আমি জানি না।
প্রশ্ন: ওঁর কোন ছবি আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?
মাধবী: সব ছবিই ভালো। আলাদা করে বলতে পারব না। ‘অপরাজিত’ থেকে ‘অপুর সংসার’ তো আমার অসাধারণ লাগে। আর বাকি সবগুলোই অনবদ্য।