বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
একইভাবে বয়সে ছোট সুকুমার রায়কে অসম্ভব স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। সুকুমারও দারুণ শ্রদ্ধা করতেন রবি ঠাকুরকে। কবিগুরু যখন গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে ইংল্যান্ডে, তখন প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়ার জন্য সুকুমারও সেখানেই। দু’জনে দু’জনের সান্নিধ্যে তো অবশ্যই ছিলেন। রবি যখন রোডেনস্টাইন এবং পিয়ার্সনের মতো ব্যক্তিদের সাহচর্যে, তখন তাঁর ‘যুবক বন্ধু’ (সুকুমারের প্রয়াণের পরে শান্তিনিকেতনে ‘আমার যুবক বন্ধু’ নামে বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং) সুকুমারও ছায়াসঙ্গীর মতো কবির সঙ্গে ছিলেন।
বয়সে ছোট প্রতিভাবান সুকুমার যখন মৃত্যুশয্যায়, ছুটে যান কবিগুরু। রবীন্দ্রসঙ্গীতের চিরকালের অনুরাগী সুকুমার তখন তাঁর কাছে শুনতে চেয়েছিলেন, ‘দুঃখ এ নয়, সুখ এ যে গো...’ গানটি। এত আগে লেখা গানটির সুর নিজেরই আর মনে ছিল না রবীন্দ্রনাথের। তিনি প্রথমে বলেছিলেন, ‘তুমি তো আমায় বিপদে ফেললে।’ তারপর আর কিছু না বলে মিনিট পাঁচেকের জন্য বাইরে চলে যান প্রবীণ কবি। ওইটুকু সময়ে গানটির নতুন সুর বেঁধে ফিরে এসে সুকুমারকে শোনান তিনি, একবার নয়... পরপর দু’বার। এহেন স্নেহের পাত্রকে রবীন্দ্রনাথ সব সময়ের জন্য মনের মণিকোঠায় রেখে দিয়েছিলেন।
এই সূত্রে বলি, রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট করার নেশার কথা অনেকেই হয়তো শুনে থাকবেন। সুকুমার রায়কে এতটাই ভালবাসতেন যে, তাঁকে প্ল্যানচেটে কাছে ডাকার কথা ভেবেছিলেন তিনি। সে ঘটনা যখন সত্যিই ঘটে, কবি জানান, সুকুমার তাঁকে এসে অনুরোধ করেছেন, “আপনি আমার ছেলেকে আপনার আশ্রমে নিতে পারেন?” পরবর্তীকালে তেমনটা ঘটতে দেরিও হয়নি। সুকুমার-জায়া সুপ্রভা সত্যজিৎকে নিয়ে এসেছিলেন কবিগুরুর কাছে।
সেই কলাভবন থেকে শুরু হয় মানিকের চিত্রকলা, সঙ্গীত ও আরও অন্যান্য বিষয়ের অদম্য আগ্রহ। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির শ্রেষ্ঠ মনীষীর সঙ্গেও সত্যজিতের নৈকট্য তৈরি হয়ে যায়। যা থেকে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের নান্দনিকতার ধারণার মূলটিই একেবারে অন্য ধারায় চালিত হতে শুরু করেছিল। এই যোগাযোগের সামগ্রিক প্রভাবটা ভালো রকমের অনুভূত হয়েছিল সুকুমার-পুত্রের উপরে। তার সঙ্গে সত্যজিতের শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা যে সেই যোগাযোগকে আরও দৃঢ় করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আসা যাক রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে তৈরি সত্যজিতের ছবির কথায়। আমার মতে, এই ক্ষেত্রে পরিচালকের সেরা ছবি ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে তৈরি ‘চারুলতা।’ সত্যজিৎ নিজেও বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “যদি চারুলতা ফের বানাতে হয়, একইভাবে বানাব।” ছবিটা তাঁকে এতটাই তৃপ্ত করেছিল। এবার দেখা যাক, এই ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার কীভাবে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে ছবিটিকে।
‘চারুলতা’ শুরু হচ্ছে যখন, স্ক্রিনজুড়ে আমরা দেখতে পাই সেলাইয়ের নকশা তোলা হচ্ছে সূচে। ভূপতির নামের আদ্যক্ষর ইংরেজিতে বি—দু’টি সালঙ্কারা হাত সুতোয় বুনছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যের’ সুর। ভাবুন, যে গানের কথায় আছে, ‘দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ...’ সেই গান দিয়ে শুরু হচ্ছে ‘চারুলতা।’ যা এক কথায় চারুর জীবনকেই তুলে ধরে। যে গৃহবধূর নিস্তরঙ্গ জীবনে তাকে সময় দিয়ে উঠতে পারে না তার ব্যস্ত স্বামী ভূপতি, সেই শূন্যতায় ঢুকে পড়ে অমল। সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের গল্পে শেষটায় ভূপতি বোঝে, চারুর প্রতি তাঁর অবহেলার কথা। কেন চারু অমলে অনুরক্ত, স্পষ্ট হয়ে যায় তার কাছে। সে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু রয়ে যায় একরাশ দ্বিধা। সেই সংসার কি ছন্দে ফিরল? নষ্ট নীড় কি অটুট রইল? এই প্রশ্ন রেখেই শেষ হয় ছবি।
চারু অসম্ভব সেনসিটিভ মহিলা। সে ভাষায় সব প্রকাশ করে না। কম কথা বলে। মনের ভাব সুপ্ত রাখে। শরীরী ভাষা অনেক কিছু বলে দেয়। ছবি শেষ হওয়ার পরে টাইটল মিউজিকের সঙ্গে সংযোগটা আরও স্পষ্ট হয়। চারু সেভাবে ভালবাসা ব্যক্ত করার সুযোগ পায়নি, অমল আসার পরে তার সেই পরিবর্তন ঘটে। তাই ‘নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ...।’ মনের এই দ্বন্দ্ব বোঝাতে আর কিছু কি আইডিয়াল হতে পারত?
একইভাবে ধরা যাক এ ছবিতে ব্যবহৃত ‘চিনি গো চিনি তোমারে, ও গো বিদেশিনী...’ গানটির কথা। কিশোর কুমারের গলায় গানটি তো অনবদ্যই। তার সঙ্গে যে যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ, তারও কোনও তুলনা হয় না। একদিকে বেহালা, একদিকে পিয়ানো। ছবিতে অমল গাইতে গাইতে যেন চারুকে দোলাচলে রাখছে। চারুও অমলের প্রতি ভালবাসা ব্যক্ত করবে কি না, এমনটা ভাবতে ভাবতে যেন সামলে নিচ্ছে নিজেকে। ‘...ভুবন ভ্রমিয়া শেষে, আমি এসেছি নূতন দেশে, আমি অতিথি তোমারই দ্বারে, ও গো বিদেশিনী...।’ যা শুনে দু’হাত দিয়ে লজ্জায় মুখ ঢাকছে চারু। আবার আঙুল সরিয়ে তাকাচ্ছে অমলের দিকে। চারুর মনের এই হিল্লোল যন্ত্রানুষঙ্গে সুন্দর ধরা পড়েছে। এখানেই সত্যজিতের মাস্টারস্ট্রোক! এটা উনি ছাড়া কেউ ভাবতেই পারবেন না। আমার এই অদ্ভুত ব্যবহার ভালো লাগে। এই যে, চারু-অমলের সম্পর্ক চেহারা পাচ্ছে, আবার পাচ্ছে না। ছবির সেরা দৃশ্য যেন লুকিয়ে রয়েছে ‘ও গো বিদেশিনী...’ গানের চিত্রায়ণেই।
আরও একটি গানের কথা মনে পড়ছে। ‘তিনকন্যা’র ‘মণিহারা’য় রুমা গুহঠাকুরতার গলায় ‘বাজে করুণ সুরে...।’ যা ব্যক্তিগতভাবেও আমার খুব ভালো লাগে। গানটির যে রেন্ডিশন্ শোনা গিয়েছে... আমার মতে, তা অসামান্য। ছবিটিতে ‘হরর’-এর সঙ্গে ‘প্যাথোস’-এর দারুণ মিশ্রণ আমাদের মুগ্ধ করে। ‘মণিহারা’য় স্বামী কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অদ্ভুত বেদনায় দীর্ণ, কারণ স্ত্রীকে ভালবেসেও মন পাননি তিনি। স্ত্রীর আসক্তি শুধু অলঙ্কারেই। ‘বাজে করুণ সুরে...’র মধ্যে সেই অদ্ভুত মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। দক্ষিণী রাগ ‘সিংহেন্দ্রমধ্যম’-এ আধারিত একটি গানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ এই গান বেঁধেছিলেন। গানটি অদ্ভুত থ্রিল তৈরি করে। যেন অপার্থিব একটা মুহূর্ত। জানলার পাশে খাটে বসে তানপুরা নিয়ে স্ত্রী গাইছেন, তাকে রক্তমাংসের মানুষ বলে আর মনে হচ্ছে না! আলো-ছায়ায় গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো একটা দৃশ্য। তার মধ্যে ‘বাজে করুণ সুরে...’ , এ সত্যজিতের অপার দক্ষতা ছাড়া আর কী!
রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়, এমন ছবিতেও সত্যজিতের রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারের আরও একটি মুন্সিয়ানা আমার মনে ভাসছে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় অমিয়া ঠাকুরের গলায় ‘এ পরবাসে রবে কে?...।’ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপে অপূর্বভাবে ব্যবহার করেছেন অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার। ছবির সব ক’টি চরিত্রের যে টানাপোড়েন, তার মধ্যে দারুণভাবে গানটা আসছে। গানের পরে করুণার দাদার চরিত্রে পাহাড়ি সান্যাল তাঁকে এসে বলছেন, “কত দিন পরে গান গাইলি বল তো।” গানের মধ্যে এমন একাকীত্ব, যার পরেই করুণা বলে ওঠেন, “দাদা, ওরা সব কোথায়?” একা থাকার যন্ত্রণা বোঝাতে এর চেয়ে নিদারুণ দৃশ্যায়ন আর হয় না। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির সম্পদ এই গানটি।
অনুলিখন: অন্বেষা দত্ত