কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
এনএসডি-র আঙিনা
১৯৮৬ সালে এনএসডিতে পড়তে আসি। ওখানেই প্রথম দেখি ইরফানকে। ওর থেকে এক ক্লাস জুনিয়র ছিলাম। ইরফান তখন মুখচোরা এক মানুষ। কারও সঙ্গে খুব একটা কথাবার্তা বলত না। একদমই মিশুকে নয়। হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু। ইরফানের স্ত্রী সুতাপা তখন থেকেই ওর পাশে। আমাদের হস্টেলে সবথেকে অগোছাল ছিল ইরফানের রুম। প্রথম যখন অভিনয়ের ক্ষমতা দেখলাম, তখন থেকেই আমি ওর ফ্যান। সেটা ছিল আমাদের কলেজের একটা নাটক। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দ্য লোয়:র ডেপথস’। মনে হয়েছিল, ওর মধ্যে আলাদা কিছু আছে। সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্বের পথ চলা শুরু।
অভিন্ন আমরা
আমরা দু’জনেই ফিল্ম পাগল। চিন্তাভাবনা, পছন্দ-অপছন্দ, দৃষ্টিকোণ
সবই এক। ইরফানের একটা বড় গুণ যে, ওর জানার ইচ্ছে প্রবল। সব বিষয়ে অদম্য কৌতূহল। আর তার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করত। সেই সময় আমাদের প্রিয় অভিনেতা ছিল আল পাচিনো, রবার্ট প্যাটিনসন...। এনএসডির এক বছরে ইরফানের অনেক ভালো কাজের স্বাক্ষী ছিলাম। তবে ওর অভিনীত একটা নাটক আজও ভুলতে পারি না। ইরফান এনএসডি থেকে পাশ করে বেরনোর পরের... ‘লাল ঘাস পে নীলে ঘোড়ে’ নাটকে লেনিনের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিল। এরপর ইরফানের প্রচুর নামডাক হয়। এর মধ্যেই আসে মীরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বে’ ছবিতে কাজের ডাক।
এই সফর
ইরফান মুম্বই যাওয়ার কিছু বছর পর আমিও ওখানে যাই। একসঙ্গে শুরু হয় আমাদের লড়াই। আমরা সারাদিন একসঙ্গে কাটাতাম, সিনেমা নিয়ে আড্ডা মারতাম। ধীরে ধীরে ইরফানকে উচ্চতায় উঠতে দেখি। অভিনেতা ইরফানের মধ্যে অনেক বদল আসে। প্রতিদিন ও নিজেকে আরও পরিণত করেছে।
মানুষ ইরফান
মানুষ ইরফান একই ছিল। জয়পুর থেকে আসা সেই সাধারণ ছেলেটা আজ অসাধারণ হয়ে উঠলেও ওর মধ্যে কোনও পরিবর্তন আসেনি। আর ইরফানের এই গুণটাই ওকে সকলের থেকে আলাদা করেছে। সাফল্যের ভারে ও কখনও নুইয়ে পড়েনি। বরং আরও শিক্ষা নিয়েছে। ছোট শহর থেকে আসা অনেকেরই মাথায় সাফল্যকে চড়ে বসতে দেখেছি। এরপর কোথাও তারা হারিয়ে
গিয়েছে। কিন্তু ইরফান ছিল সত্যি ব্যতিক্রমী। ও সাফল্যকে খুব সুন্দর সামলাতে পারত। ইরফান মনে করত, ওর অভিনয় সফর এই সবে শুরু হল। হলিউডেও ও অনেক কাজ করেছে। তারপরও ওর প্রতিনিয়ত শেখার ইচ্ছেয় এতটুকু ঘাটতি হয়নি। এত বড় স্টার, তাও পা সবসময় মাটিতে। অসম্ভব বিনয়ী,
জ্ঞানী, হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, বিন্দাস টাইপের মানুষ। সেন্স অব হিউমারও ছিল দুর্দান্ত।
অন্য জগত
ফিল্ম ছাড়া ক্রিকেট, ওয়াইল্ড লাইফ, পরিবেশ এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসত ইরফান। রাজনীতি নিয়েও আগ্রহ ছিল। আর ভালোবাসত বেড়াতে। বিশেষ করে জঙ্গলে...। আমরা একসঙ্গে অনেকবার জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে গিয়েছি। তবে সিনেমার পরে ওর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল ক্রিকেট। চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন লন্ডনে ছিল। ইরফান তখন নিজের কাছে ফোন সবসময় রাখত না। সুতপার সঙ্গে আমার স্ত্রী-র দারুণ বন্ধুত্ব। আমি ওর থেকেই সব খবরাখবর পেতাম। তবে লন্ডনে থাকতে আমার সঙ্গে যতবার কথা হয়েছে, বিষয় ছিল শুধুই ক্রিকেট। ভারতের ইংল্যান্ড সফর কত কী বলত! লর্ডসে গিয়ে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান ম্যাচ দেখেছিল। মারাত্মক উত্তেজিত ছিল ব্যাপারটা নিয়ে। আমাকে ফোনে ইরফান সেই ম্যাচটা প্রায় পুরো কমেন্ট্রি করেছিল। সৌখিন
ছিল খাওয়াদাওয়ায়। কোনওদিনই বেশি খেতে পারত না। তবে যাই খেত, শর্ত একটাই... স্বাদ মুখে লেগে থাকতে হবে। নিজে রান্নাও করত দারুণ! ওর ‘ইয়াকনি পোলাও’ আজও ভুলতে পারিনি। ভালো ঘুড়িও ওড়াতে পারত।
সম্পর্কের রসায়ন
আমাদের সম্পর্কটা ছিল ভারি অদ্ভুত। আমি ওকে কখনও বাবা হিসেবে পেয়েছি, আবার কখনও বড় দাদার মতো। কখনও মেন্টর হয়ে পথ দেখিয়েছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কাছের বন্ধু ইরফানই। এই এক জীবনে ওর থেকে স্বাদ পেয়েছি সব সম্পর্কের।
জাদুকর ইরফান
আমার পরম সৌভাগ্য যে ইরফানের মত অভিনেতাকে নিয়ে আমি প্রচুর কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমার মতো অন্য কেউ ওর সঙ্গে এত কাজ করেননি। সবসময় আমার চেষ্টা থাকত, ওর উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যাওয়ার। এমনকী
লেখক হিসেবেও আমাকে অনেক ভাবনাচিন্তা করতে হতো। ইরফান যে
দৃশ্যে আছে, তার মধ্যে নতুন কিছু জুড়তে হতো। জানতাম, ও-ই পারবে সেই দৃশ্যটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করত, ডুবে থাকত তাতেই। অত্যন্ত বুঝদার অভিনেতা ছিল ইরফান। এক একটা চরিত্র ওর অভিনয়ের গুণেই জীবন্ত হয়ে উঠত। পুরো চিত্রনাট্য পড়ার পরই ও ছবি করতে রাজি হতো। সত্যি বলতে ইরফান ছিল অভিনয় জগতের জাদুকর। ওর মত অভিনেতা অনেক দশকে একটা জন্মায়।
বিদায় বন্ধু
আমার মননে, সৃষ্টিতে চিরকাল জীবন্ত হয়ে থাকবে আমার প্রাণের ইরফান। শেষবেলায় আমাদের কোনও কথা হয়নি। হাসপাতালে গিয়ে দেখি হাসিখুশি, প্রাণবন্ত সেই মানুষটা অচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় শুয়ে। আরও কত কথা অবলা থেকে গেল। আরও কত সৃষ্টির উল্লাসে মেতে ওঠা বাকি। আরও কত পথ চলা রয়ে গেল বাকি... জীবনের সফরসঙ্গী হয়ে।
অনুলিখন: দেবারতি ভট্টাচার্য