বাড়তি অর্থ পাওয়ার যোগ রয়েছে। পদোন্নতির পাশাপাশি কর্মস্থান পরিবর্তন হতে পারে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পক্ষে থাকবে। ... বিশদ
মনস্বী অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার একবার শ্রীরামকৃষ্ণকে বুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু সে প্রসঙ্গে যখন স্বামী বিবেকানন্দের কথা এল তখন তিনি একটু সমস্যায় পড়লেন। ভগবান বুদ্ধের কোন পার্ষদের সঙ্গে স্বামীজির তুলনা করবেন, সেটি তাঁকে বেশ চিন্তায় ফেলল। শেষমেশ তিনি লিখলেন— তিনি রাহুল নন, উপালি নন, আনন্দ-সারিপুত্তও নন, তিনি এদের সমবেত মূর্তি!
বিখ্যাত লেখক ক্রিস্টোফার ইশারউডের অনুসরণ করে বলা যেতে পারে, বিবেকানন্দও তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের মতোই এক ‘phenomen’। যাঁকে ব্যাখ্যা করা সাধারণের ‘কম্মো’ নয়। অন্যের কাছে না শুনে নিজের চোখ-কান, মগজ ব্যবহার করে যাঁরা বিবেকানন্দকে পড়েছেন, তাঁরা বিবেকানন্দ-প্রতিভার সামনে স্তম্ভিত না হয়ে পারেন না। আমেরিকার সম্ভ্রান্তকুলে জন্ম, বার্নার্ড শ প্রমুখের বন্ধু জোসেফিন—যিনি তাঁর বিখ্যাত ‘ম্যাকলাউড স্পিরিট’ নিয়ে সারা ভূমণ্ডল চষে বেড়িয়ে সে আমলের ইউরোপ-আমেরিকার সব বাঘা বাঘা লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তিনিও স্বামীজির ব্যক্তিত্ব দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছেন, ‘স্বামীজীর যে জিনিসটি দেখে আমি সবচেয়ে আকৃষ্ট হয়েছি তা হল তাঁর অন্তহীন প্রসারতা, অতলস্পর্শ গভীরতা। সে গভীরতার উপর-নীচ বা পাশ কোনওটাই আমি কখনও ছুঁতে পারিনি।’
সত্যি কথা বলতে কী, সমকালের থেকে এগিয়ে থাকা স্বামীজির চিন্তাভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এইরকম ‘জবরদস্ত’ বিবেকানন্দ যখন রামকৃষ্ণ আন্দোলনকে একটা সাংগঠনিক আকার দিতে চাইলেন, তখন তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন, রামকৃষ্ণ দর্শনকে জনসাধারণের কাছে সুষ্ঠুভাবে এবং নিয়মিতভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি পত্রিকার খুব প্রয়োজন। তিনি আমেরিকা থেকে মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে গুরুভাই ও প্রীতিভাজন অনুরাগীদের কাছে উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখতেন। সাধারণ মানুষ যেখানে একটি কাজ শুরু করার আগে শতবার হোঁচট খান, সেখানে স্বামীজির চিন্তা একইসঙ্গে নানা অচিন্ত্যনীয় পথে আরবি ঘোড়ার মতো ছুটত। তাঁর সবকিছুই ছিল রাজকীয়।
যখন অর্থের সঙ্কট নবগঠিত এই আন্দোলনের সামনে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখনও স্বামীজি আমেরিকা থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ তারিখে গুরুভাইদের উদ্দেশে চিঠিতে লিখছেন— ‘তোমাদের একটা কিনা কাগজ ছাপবার কথা ছিল, তার কি খবর?... একটা খবরের কাগজ তোমাদের edit করতে হবে, আদ্দেক বাংলা আদ্দেক হিন্দি—পার তো আর একটা ইংরাজিতে। পৃথিবী ঘুরে বেড়চ্ছে—খবরের কাগজের subscriber সংগ্রহ করতে কদিন লাগে? যারা বাহিরে আছে, subscriber জোগাড় করুক—গুপ্ত [সদানন্দ] হিন্দি দিকটা লিখুক, বা অনেক হিন্দি লিখবার লোক পাওয়া যাবে। মিছে ঘুরে বেড়ালে চলবে না।’
ক্রমে স্বামীজির উৎসাহে মাদ্রাজ থেকে ‘ব্রহ্মবাদিন্’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা বের হল (১৮৯৫-এর ১৪ সেপ্টেম্বর)। এটি ছিল ধ্রুপদী ঘরানার একটি পত্রিকা। সাধারণ পাঠকের কাছে এই নতুন ভাবধারা নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত সহজতর ইংরেজিতে একটি পত্রিকার কথা স্বামীজি ভাবলেন। এই ইচ্ছারই ফলশ্রুতি ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ (প্রথম প্রকাশ ১৮৯৬ সালের জুলাই)। ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ভক্তদের দ্বারা প্রকাশিত হতো। কিন্তু বেশ কয়েক বছর চলার পর এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ ১৮৯৮ সালের জুন পর্যন্ত ভক্তদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার পর, সম্পাদকের আকস্মিক প্রয়াণে জুলাই মাসটি বন্ধ রেখে আগস্ট মাস থেকে প্রথমে আলমোড়া এবং পরে মায়াবতী থেকে সঙ্ঘের ইংরেজি মাসিক পত্র হিসেবে এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
এদিকে স্বামীজি প্রথমবার বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে ১৮৯৭ সালের ১ মে প্রতিষ্ঠিত হল রামকৃষ্ণ মিশন। কিন্তু নানা কারণে তখনও বাংলা ভাষায় রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কোনও মুখপত্র প্রকাশের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। স্বামীজি অস্থির হয়ে পড়লেন। তাঁর হাতে আর বেশি সময় তো নেই! তাঁর সঙ্গী বলতে তখন গুটিকয়েক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী আর অনন্ত স্বপ্ন। স্বামীজি তাঁর অদ্ভুতকর্মা গুরুভাই সারদাপ্রসন্ন বা স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে এই কাজের জন্য উপযুক্ত মনে করতেন।
* ‘উদ্বোধন’-এর প্রথম সংখ্যা
স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ বা সারদাপ্রসন্ন মহারাজ ছিলেন সত্যিই এক অদ্ভুত মানুষ। প্রিয় নেতা বিবেকানন্দের ‘শ্লেষের পীড়নে’ যিনি নিজের ‘যমতাড়ানে’ নামটিকে ঈষৎ ছোট করে পরবর্তীকালে ত্রিগুণাতীত নামে পরিচিত হয়েছিলেন। নরেন্দ্র ও সারদাপ্রসন্নের পাঠাভ্যাসকালীন একটি ছোট্ট স্মৃতি স্বামীজির ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের সূত্রে আমরা পাই। স্মৃতিটি এই দুই গুরুভ্রাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর চমকপ্রদ আলোকপাত করে। কে বলতে পারে উদ্বোধনের প্রথম সম্পাদকরূপে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের মনোনয়ন এই রকম ছোট ছোট ঘটনার মধ্যেই লুকিয়েছিল কি না!
মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, ‘নরেন্দ্রনাথের যখন পাথুরীর অসুখ হয়, তখন ৭নং রামতনু বসু গলির বাড়িতে সারদা মহারাজ শুশ্রূষার জন্য আসিয়া থাকিতেন। তিনি ‘ক্যাসেলের’ ছবিওয়ালা শেক্সপীয়ারের গ্রন্থগুলি পড়িয়া নরেন্দ্রনাথকে শুনাইতেন এবং নরেন্দ্রনাথ একটু সুস্থ বোধ করিলে শেক্সপীয়ারের নানা গ্রন্থ ও কাব্যের বিষয় বুঝাইয়া দিতেন। বালক সারদা মহারাজ সম্মুখে বইখানি খুলিয়া রাখিয়া একমনে নরেন্দ্রনাথের নিকট শেক্সপীয়ারের কাব্যের সহিত সংস্কৃত কাব্যের কোথায় মিল ও কোথায় বৈষম্য আছে—সেই সমস্ত স্থির হইয়া বসিয়া শুনিতেন। শুনিতে শুনিতে সারদা মহারাজের মুখে ধ্যানের ভাব ফুটিয়া উঠিত। তিনি তখন আর পড়িতে পারিতেন না, বইখানি বন্ধ করিয়া দিয়া স্থির মনে জপ করিতেন। তিনি যখন বেদান্তশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেন, তখনো ঠিক এই রকম এক-মন-প্রাণ হইয়া পড়িতেন। বিকাল হইল, সূর্য অস্ত গেল, কিন্তু সারদা মহারাজের কোন হুঁশ থাকিত না। অন্ধকার হইয়া আসিলে আলো জ্বালিয়া আবার পড়িতে বসিতেন এবং গভীর রাত্রি পর্যন্ত পাঠ করিতেন। এইরূপে তিনি সংস্কৃত ও ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্রে বিশেষরূপে শিখিয়াছিলেন।’
স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা স্বামীজির একটি চিঠিতে স্বামী ত্রিগুণাতীতের নিজেরও একটা বাংলা কাগজ বের করার ইচ্ছার একটু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। স্বামীজি স্বয়ং ত্রিগুণাতীতানন্দজিকে লিখলেন, ‘তোর কাগজের idea অতি উত্তম বটে এবং উঠে পড়ে লেগে যা, পরোয়া নেই। ৫০০ টাকা পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেব, ভাবনা নেই টাকার জন্য। আপাতত এই চিঠি দেখিয়ে কারুর কাছে ধার নে।...লেখক অনেক চাই। তারপর গ্রাহক যোগাড়ই মুশকিল, ...চালাও কাগজ, কুছ পরোয়া নেই। শশী শরৎ কালী প্রভৃতি সকলে পড়ে (অর্থাৎ সকলে মিলে) লিখতে আরম্ভ কর।...তুই খুব বাহাদুরি করেছিস। বাহবা সাবাস!’
সে সময়ে যে এই কাজটি একেবারেই সহজ ছিল না, সেকথা স্বামীজি নিজেও জানতেন। কিন্তু কঠোরতার ভ্রূকুটিতে আদর্শকে নীচে নামানোর লোক তাঁরা কেউই ছিলেন না। যখন দারুণ প্রতিকূলতার ক্রমাগত নিষ্পেষণে ত্রিগুণাতীতানন্দজি একটু যেন হতোদ্যম হয়ে পড়তেন, তখনই তাঁকে জাগিয়ে তুলত স্বামীজির বজ্রনির্ঘোষ। কিন্তু সে আঘাতে কোনও কর্কশতা ছিল না, বরং তাতে লুকিয়ে থাকত এক গভীর প্রীতি যা সরস করে দিত কঠিন-বন্ধুর যাত্রাপথ। প্রত্যক্ষদর্শী শুদ্ধানন্দজি অনেক পরে স্বামী অশোকানন্দকে শুনিয়েছিলেন সেই সংগ্রামপূর্ণ দিনগুলির কথা। তিনি বলতেন যে, এমনও হয়েছে যখন স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ এই পত্রিকার জন্য প্রায় সাড়ে ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত পরিশ্রম করেছেন। আধঘণ্টা রেখেছেন একটু চোখ বোজার জন্য। তারপর হয়তো একটা কাঠের বেঞ্চের উপর শুয়ে লম্বা হতেন এবং আধঘণ্টা হয়ে গেলে কোনও অ্যালার্ম ঘড়ির সাহায্য ছাড়াই উঠে পড়তেন। এইভাবে তিনি এই পত্রিকাটিকে দাঁড় করানোর জন্য কি না করতেন! সম্পাদনা করতেন, কম্পোজ করতেন, লোকের অভাবে নিজেই ছাপাতেন এবং তারপরে বহু ঘুরে ঘুরে গ্রাহক জোগাড় করতে বেরিয়ে পড়তেন। এর পরেও তাঁকে সেবারত অবস্থায় দেখা যেত কোনও অসুস্থ কর্মীর পাশে। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাসে তাঁর অতুলনীয় পরিশ্রম একটি মাইলফলকের মতো হয়ে রয়েছে। ডঃ শশিভূষণ ঘোষ যিনি কখনও কখনও ত্রিগুণাতীতানন্দ মহারাজকে এই সকল কাজে একটু সাহায্য করতেন— তাঁর সূত্রে জানা যায় যে, সেই দিনগুলোতে মহারাজ সময়ের অভাবে কোনওদিন হয়তো প্রায় উপবাসেই কাটিয়ে দিতেন। দিনে মুখে যেত বড়জোর হয়তো একটা মাত্র কলা!
এইরকম ভয়াবহ কষ্টের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনের প্রথম সংখ্যাটি যখন বের হল, তখনও তিনি স্বামীজির ভয়ে নিজে না গিয়ে স্বামী শুদ্ধানন্দকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন। স্বামীজি সম্ভবত তৎক্ষণাৎ বইটি পড়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু তারপর যখন এই নতুন পত্রিকাটির cover to cover তিনি পড়লেন, তখনও চিন্তিত ত্রিগুণাতীত মহারাজ স্বামীজির শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে ‘কত্তার মর্জির’ খবর নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এই ঘটনার সুমধুর বর্ণনা আমরা শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ নামে বইটির পাতা থেকে তুলে ধরলাম। ‘উদ্বোধন’, তার প্রথম সম্পাদক ত্রিগুণাতীত এবং স্বামী বিবেকানন্দের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি অনবদ্য চিত্র এই কথাগুলির আড়ালে লুকিয়ে আছে।
‘‘স্বামীজী। (পত্রের নামটি বিকৃত করিয়া পরিহাসচ্ছলে) ‘উদ্বন্ধন’ দেখেছিস?
শিষ্য। আজ্ঞে হ্যাঁ; সুন্দর হয়েছে।
স্বামীজী। এই পত্রের ভাব ভাষা—সব নূতন ছাঁচে গড়তে হবে।
শিষ্য। কিরূপ?
স্বামীজী। ঠাকুরের ভাব তো সব্বাইকে দিতে হবেই; অধিকন্তু বাঙলা ভাষায় নূতন ওজস্বিতা আনতে হবে। এই যেমন— কেবল ঘন ঘন verb use (ক্রিয়াপদের ব্যবহার) করলে, ভাষার দম কমে যায়। বিশেষণ দিয়ে verb (ক্রিয়াপদ)-এর ব্যবহারগুলি কমিয়ে দিতে হবে। তুই ঐরূপ প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ কর। আমায় আগে দেখিয়ে তবে উদ্বোধনে ছাপতে দিবি।
শিষ্য। মহাশয়, স্বামী ত্রিগুণাতীত এই পত্রের জন্য যেরূপ পরিশ্রম করিতেছেন, তাহা অন্যের পক্ষে অসম্ভব।
স্বামীজী। তুই বুঝি মনে করছিস, ঠাকুরের এইসব সন্ন্যাসী সন্তানেরা কেবল গাছতলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকতে জন্মেছে? এদের যে যখন কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে, তখন তার উদ্যম দেখে লোকে অবাক হবে। এদের কাছে কাজ কি করে করতে হয়, তা শেখ। এই দেখ, আমার আদেশ পালন করতে ত্রিগুণাতীত সাধনভজন ধ্যানধারণা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে কাজে নেমেছে। এ কি কম sacrifice (স্বার্থত্যাগ)-এর কথা! আমার প্রতি কতটা ভালবাসা থেকে এ কর্মপ্রবৃত্তি এসেছে বল দেখি! Success (কাজ হাসিল) করে তবে ছাড়বে!! তোদের কি এমন রোক্ আছে?
শিষ্য। কিন্তু মহাশয়, গেরুয়াপরা সন্ন্যাসীর—গৃহীদের দ্বারে দ্বারে ঐরূপে ঘোরা আমাদের চক্ষে কেমন কেমন ঠেকে!
স্বামীজী। কেন? পত্রের প্রচার তো গৃহীদেরই কল্যাণের জন্য। দেশে নবভাবপ্রচারের দ্বারা জনসাধারণের কল্যাণ সাধিত হবে। এই ফলাকাঙ্ক্ষারহিত কর্ম বুঝি তুই সাধন-ভজনের চেয়ে কম মনে করছিস? আমাদের উদ্দেশ্য জীবের হিতসাধন। এই পত্রের আয় দ্বারা টাকা জমাবার মতলব আমাদের নেই। আমরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, মাগছেলে নেই যে, তাদের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে। Success (কাজ হাসিল) হয় তো এর income (আয়টা) সমস্তই জীবসেবা-কল্পে ব্যয়িত হবে। স্থানে স্থানে সঙ্ঘ-গঠন, সেবাশ্রম-স্থাপন, আরও কত কি হিতকর কাজে এর উদ্বৃত্ত অর্থের সদ্ব্যয় হতে পারবে। আমরা তো গৃহীদের মতো নিজেদের রোজগারের মতলব এঁটে কাজ করছি না। শুধু পরহিতেই আমাদের সকল movement (কাজকর্ম)— এটা জেনে রাখবি।
শিষ্য। তাহা হইলেও সকলে এভাব লইতে পারিবে না।
স্বামীজী। নাই বা পারলে। তাতে আমাদের এল গেল কি? আমরা criticism (সমালোচনা) গণ্য করে কাজে অগ্রসর হইনি।
শিষ্য। মহাশয়, এই পত্র ১৫ দিন অন্তর বাহির হইবে; আমাদের ইচ্ছা সাপ্তাহিক হয়।
স্বামীজী। তা তো বটে, কিন্তু fund (টাকা) কোথায়? ঠাকুরের ইচ্ছায় টাকার যোগাড় হলে এটাকে পরে দৈনিকও করা যেতে পারে। রোজ লক্ষ কপি ছেপে কলকাতার গলিতে গলিতে free distribution (বিনামূল্যে বিতরণ) করা যেতে পারে।
শিষ্য। আপনার এ সঙ্কল্প বড়ই উত্তম।
স্বামীজী। আমার ইচ্ছে হয়, কাগজটাকে পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তোকে editor (সম্পাদক) করে দেবো। কোন বিষয়কে প্রথমটা পায়ে দাঁড় করাবার শক্তি তোদের এখনও হয়নি। সেটা করতে এই-সব সর্বত্যাগী সাধুরাই সক্ষম। এরা কাজ করে করে মরে যাবে, তবু হটবার ছেলে নয়। তোরা একটু বাধা পেলে, একটু criticism (সমালোচনা) শুনলেই দুনিয়া আঁধার দেখিস!
শিষ্য। সেদিন দেখলাম, স্বামী ত্রিগুণাতীত প্রেসে ঠাকুরের ছবি পূজা করিয়া তবে কাজ আরম্ভ করিলেন এবং কার্যের সফলতার জন্য আপনার কৃপা প্রার্থনা করিলেন।
স্বামীজী। আমাদের center (কেন্দ্র) তো ঠাকুরই। আমরা এক একজন সেই জ্যোতিঃকেন্দ্রের এক-একটি ray (কিরণ)। ঠাকুরের পূজা করে কাজটা আরম্ভ করেছে— বেশ করেছে। কই আমায় তো পূজার কথা কিছু বললে না।
শিষ্য। মহাশয়, তিনি আপনাকে ভয় করেন। ত্রিগুণাতীত স্বামী আমায় কল্য বলিলেন, তুই আগে স্বামীজীর কাছে গিয়ে জেনে আয়, পত্রের ১ম সংখ্যা বিষয়ে তিনি কি অভিমত প্রকাশ করেছেন, তারপর আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব।
স্বামীজী। তুই গিয়ে বলিস, আমি তার কাজে খুব খুশি হয়েছি। তাকে আমার স্নেহাশীর্বাদ জানাবি। আর তোরা প্রত্যেকে যতটা পারবি, তাকে সাহায্য করিস, ওতে ঠাকুরের কাজই করা হবে।...
‘উদ্বোধনে’ সাধারণকে কেবল positive ideas (গঠনমূলক ভাব) দিতে হবে। Negative thought (নেতিবাচক ভাব) মানুষকে weak (দুর্বল) করে দেয়।... positive ideas (গঠনমূলক ভাবগুলি) দিতে পারলে সাধারণে মানুষ হয়ে উঠবে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে।...ভ্রমপ্রমাদ দেখালে মানুষের feeling wounded (মনে আঘাত দেওয়া) হয়। ঠাকুরকে দেখেছি— যাদের আমরা হেয় মনে করতুম, তাদেরও তিনি উৎসাহ দিয়ে জীবনের মতি-গতি ফিরিয়ে দিতেন। তাঁর শিক্ষা দেওয়ার রকমটা অদ্ভুত!... সেই জন্য বেদ-বেদান্তের উচ্চ উচ্চ ভাবগুলি সাদা কথায় মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। সদাচার, সদ্ব্যবহার ও বিদ্যা শিক্ষা দিয়ে ব্রাহ্মণ ও চণ্ডালকে এক ভূমিতে দাঁড় করাতে হবে। ‘উদ্বোধন’ কাগজে এইসব লিখে আবালবৃদ্ধবনিতাকে তোল দেখি। তবে জানব— তোর বেদ-বেদান্ত পড়া সার্থক হয়েছে। কি বলিস— পারবি?’’
* ‘উদ্বোধন’ ও বঙ্গসমাজ
চলিত ভাষায় বাংলা সাহিত্যের আজকের যে রূপ, তাঁর পিছনে স্বামীজির লেখা রচনাগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। একথা আজ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সাহিত্যিক কুমুদবন্ধু সেনের স্মৃতিকথাতে জ্বলজ্বল করছে তারই একটি বলিষ্ঠ স্বীকৃতি। তিনি লিখছেন, ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশের কিছুদিন পর স্বর্গীয় রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় রাত্রি আটটার সময় লেখকের নিকট আসিয়া ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থখানি চাহিলেন। লেখক বলিলেন: কেন যখন আমি কতবার আপনাকে উহা পড়িবার জন্য সাধিয়াছি, প্রাণবন্ত জীবন্ত ভাষায় চলিত বাংলায় স্বামীজী বঙ্গসাহিত্যের কেমন নবরূপ দিয়াছেন তাহা পড়িয়া দেখুন— বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও আপনি পড়িতে চাহেন নাই। আজ হঠাৎ কি প্রয়োজন হইল?’ দীনেশচন্দ্র বলিলেন: ‘আমি এইমাত্র রবিবাবুর নিকট থেকে তোমার নিকট এসেছি। আজ রবিবাবু বিবেকানন্দের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বইখানির অত্যন্ত প্রশংসা করছিলেন। আমি উহা পড়ি নাই শুনিয়া তিনি বিস্মিত হলেন। তিনি বললেন: ‘আপনি এখুনি গিয়ে বিবেকানন্দের এই বইখানি পড়বেন। চলিত বাংলা কেমন জীবন্ত প্রাণময়রূপে প্রকাশিত হতে পারে তা পড়লে বুঝবেন। যেমন ভাব, তেমনি ভাষা, তেমনি সূক্ষ্ম উদারদৃষ্টি আর পূর্ব পশ্চিমের সমন্বয়ের আদর্শ দেখে অবাক হতে হয়।’ এছাড়া তিনি আরো শতমুখে প্রশংসা করতে লাগলেন। বইখানি লইয়া দীনেশবাবু চলিয়া গেলেন। এই চলিতভাষার ধারা স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিভা-গোমুখী হইতে নিঃসৃত হইয়াছে। বহুপূর্বে ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় চলিত ভাষা ছিল— তাহা ব্যঙ্গ রঙ্গ-তামাশা। গভীর চিন্তা ও সাহিত্যিক মাধুর্যে মণ্ডিত হইয়া স্বামীজীর প্রাণস্পর্শী চলিত ভাষা ‘উদ্বোধন’-এ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হইয়াছে।’
বিগত একশো বছরে বাংলা সাহিত্যের যে সমস্ত দিকপালদের লেখা ‘উদ্বোধন’-এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শ্রীঅরবিন্দ, নজরুল ইসলাম, বিনয়কুমার সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, এস. ওয়াজেদ আলি, সজনীকান্ত দাস, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, বনফুল, জীবনানন্দ দাশ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, আশাপূর্ণা দেবী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রেজাউল করিম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এই ঐতিহ্য বজায় রেখে বর্তমানকালের প্রথিতযশা বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, কবি ও লেখক-লেখিকাদের সাদর অবদানে আজও সমৃদ্ধ হচ্ছে বাঙালির গর্ব এই পত্রিকাটি।
* চরৈবেতি
শতাধিক বছর নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশের সৌভাগ্য নিয়ে ‘উদ্বোধন’-এর প্রেরণাময় এই যাত্রা আজও সমান গতিতে এগিয়ে চলেছে। ‘উদ্বোধন’-এর একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য— তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। একটি ধর্মীয় সংগঠনের মুখপত্র হয়েও ‘উদ্বোধন’ তার মহান প্রতিষ্ঠাতার নির্দেশ অনুসারে তার এই বৈশিষ্ট্য শতবর্ষ ধরে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। স্বামী বিবেকানন্দের আরও ইচ্ছা ছিল, ‘উদ্বোধন’-এর বিষয়বস্তু যেন কেবল ধর্মসংক্রান্ত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ না থাকে। একারণে, মানব জীবনের সার্বিক উন্নয়নের দিকে লক্ষ রেখে ইতিহাস, শিল্প, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, পরিবেশ, ভ্রমণ, লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণামূলক ইতিবাচক লেখা ‘উদ্বোধন’-এর সেই জন্মলগ্ন থেকেই প্রকাশিত হয়ে আসছে।
একথা ভুললে চলবে না যে, জাতি গঠনের এই মহতী কর্মে শুধু সন্ন্যাসীরাই নন, এই দীর্ঘ শতাধিক বছর ধরে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ, সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী ভক্তেরা এগিয়ে এসেছেন। তাদের শ্রদ্ধাপূর্ণ অবদান ‘উদ্বোধন’-এর সম্পদ। সকলের মিলিত শুভেচ্ছায় বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ‘উদ্বোধন’-এর পাঠকসংখ্যা নিয়ত বর্ধমান। বিশেষত ইন্টারনেটের সৌজন্যে বিশ্বের সকল প্রান্তেই ‘উদ্বোধন’ তার প্রাণদায়ী, বলদায়ী বার্তা নিয়ে আজ পৌঁছে যাচ্ছে। ভারতের সনাতন ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে ‘উদ্বোধন’ শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্ত উদারতা, স্বামী বিবেকানন্দের সর্বজীবে সমমর্মিতা আর শ্রীমা সারদার স্নেহধারারূপ পরমান্ন অক্লান্তভাবে বিতরণ করে চলেছে। তাই তার এত সমাদর।