কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
মিষ্টি খেতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা এসবের পরোয়া করেন না। কেউ কেউ আছেন, যাঁদের মিষ্টি হলেই হল। এক পেট খাওয়ার পর জল গেলার অবস্থা নেই, কিন্তু শেষ পাতে মিষ্টি চাইই চাই। রেস্তরাঁয় খেতে গিয়েছি এক দূতাবাসের আধিকারিকের সঙ্গে। স্টার্টারে চার রকমের কাবাব, মেন কোর্সে বিরিয়ানি, চাপ... গলা পর্যন্ত ঠেসে দেওয়ার পর যখন প্লেট খালি হল, মনে হচ্ছিল এবার একটু বাইরের হাওয়া দরকার। উনি কিন্তু আনচান করছিলেন। ওয়েটার প্লেট তুলতে এলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডেজার্টে কিছু আছে ভাই?’
—‘হ্যাঁ স্যর, ফিরনি আছে।’
—‘বাঃ বাঃ, তিনটে দাও।’
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে প্রশ্ন করলাম, ‘তিনটে কেন?’ বললেন, ‘কেন? তুমি খাবে না?’ অঙ্কটা পরিষ্কার হল না। বললাম, ‘তাহলে তো দু’টো হল...!’ একগাল হেসে বললেন, ‘আরে না, তুমি একটা, আমি দু’টো। বিরিয়ানির উপর ভালো একটা প্রলেপ তো চাই নাকি!’ রাতের খাবারের শেষে তাঁকে চকোলেট হলেও সাপ্লাই দিতে হবে। গরমকালে আম হলে তো কেয়াবাত! তবে সেটা ভালো হিমসাগর... নাহলে বলবেন, ‘ধুস, ল্যাংড়া, ফজলি আবার আম নাকি?’ আর এসবের কিছুই না হলে?... মনে অভাব নিয়ে ঘুম হয়? শোনা যায়, রামমোহন রায় একটা গোটা পাঁঠা খাওয়ার পর এক কেজি মতো রাবড়ি খেয়ে নিতেন। রামমোহন না হোক, এনাকে শুধু মোহনের তকমা তো দেওয়াই যেতে পারে।
কাঁচা মিষ্টি, ভাজা মিষ্টি, রসের মিষ্টি, শুকনো মিষ্টি, জলভরা মিষ্টি, টাটকা মিষ্টি, বাসি মিষ্টি... বলতে গেল হাঁফ ধরে যাবে। কিন্তু মিষ্টিখাইয়েদের রসনার তৃপ্তি হবে না। এক দাদাকে দেখেছি, প্রবল সংযমী। সঙ্কটমোচনের পুজো দিয়ে লাড্ডু পর্যন্ত একটু খুঁটে খান। কিন্তু সত্যিকারের ভালো রসগোল্লা পেলে আর সংযমের তোয়াক্কা নেই। খান দু’য়েক অন্তত। এবং সেটা তিনি কখনওই রস চিপে খাবেন না। অর্থাৎ, ঐতিহ্য তিনি বজায় রেখেছেন। কারণ, অতীতের বিয়েবাড়িতে যাঁরা রসগোল্লার রস ফেলে খেতেন, তাঁদের মোটেই ‘খাইয়ে’ উপাধি দেওয়া হতো না। রস সমেত না হলে আর রসগোল্লা কীসের? দাদা কিন্তু সেই ক্যাটিগরির। তখন অবশ্য অন্য জমানা ছিল। পরিবেশনের ছেলেটি মিষ্টি দিতে এলে বলা হতো, ‘বালতিটা নামিয়ে রেখে যা...’। এবং এই অর্ডার এক-দু’জন নয়, অনেকের থেকেই পাওয়া যেত। ‘কেউ কহে দৈ আন কেহ হাঁকে লুচি’ কেস আর কি! আসলে ক্যালরি মেপে খাওয়ার রেওয়াজটা তখন ছিল না। আর ছিল না ভেজালও। তাই তাঁরা খেতেন। হজমও করতেন। আবার ‘খাইয়ে’রা শুধু মিষ্টি খেয়েই নাম কিনতেন, তা নয়। মাংসও তাঁরা এক বালতিই খেতেন। আর তারপর কিলোখানেকের দইয়ের হাঁড়ি। তাতে ফেলা থাকত কড়াপাকের সন্দেশ। উফ্ফ্... অমৃতসম। কড়াপাকের সন্দেশ থেকে মনে পড়ল স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কথা। এক ধামা (বেতের ঝুড়ি) কড়াপাকের সন্দেশ হেলায় খেতে পারতেন আশুতোষবাবু।
আবার যুগান্তরে আসা যাক। কলেজ জমানার এক বান্ধবীর সঙ্গে বেরিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম এক অনন্য থিম। এমনিতে সে মিষ্টি খুব একটা খায় না। কিন্তু মন খারাপ হলে অন্য সমীকরণ। সে ছিল তেমনই একদিন। বড্ড মন খারাপ। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও কাজ দিল না। হাল ছেড়ে শেষে বললাম, ‘কী হলে তোর মন খারাপ কাটবে বল তো?’
—‘মিষ্টি খাওয়াবি? তাহলে হবে।’
—‘চল, তাই হোক।’
ভবানীপুরের বড়সড় একটা দোকানে ঢুকে বললাম, ‘কী খাবি বল?’ এবার সে শুরু করল। যেটা দেখে ভালো লাগছে, সেটাই একটা... কখনও দু’টো করে। খাওয়া শেষ করে যখন প্রশান্তির একগাল হাসি দিল, ততক্ষণে বিল হয়েছে ২৬০ টাকা। আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগের কথা। তখন খুব ভালো মিষ্টি কিন্তু ১০-১২ টাকায় পাওয়া যেত। তাহলেই বুঝুন!
আছেন এক অধ্যাপক বন্ধু। মিষ্টি তাঁর প্যাশন। অ্যাডভেঞ্চার। তিনি রাত দু’টোয় ঘুম ভেঙে উঠে ফ্রিজে অনুসন্ধান চালান... মিষ্টি তাঁর রাখাই থাকে। রাতের জন্য। ছুটির দিনে বউ-ছেলে ঘুমোচ্ছে। তাঁর হঠাৎই মনে পড়েছে নতুন গুড়ের কথা। জামা-প্যান্ট চাপিয়ে সোজা স্টেশন। ট্রেন ধরে বারুইপুর। নতুন গুড়ের মাখা সন্দেশ... বেশিটাই খেলেন। কিছুটা আনলেন বাড়ির জন্য। প্রশ্নমাখা চোখে তাকালে উত্তর, ‘আরে, ভরদুপুরে বাড়ি কেটে পালিয়েছি, কিছু তো উৎকোচ দিতে হবে?’
—‘বউদি এই উৎকোচে খুশি হয়?’
—‘হয়, হয়... সঙ্গগুণ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! আর খুশি না হলেই বা কী, আমি তো আছি!’ পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ে গেল তাঁর... ‘আরে শুনেছ, চিনার পার্কের কাছে একটা নাকি দারুণ মিষ্টির দোকান হয়েছে। চলো, একদিন যাই...।’
—‘তা যাওয়া যেতেই পারে। কবে যাবে বলো?’
—‘একদিন দুপুরে চলো!’
—‘দুপুরে?’
—‘হুমম, সেদিন আর লাঞ্চ করব না। ওখানেই যা খাওয়ার খেয়ে নেব। বেশ কয়েক রকম না খেলে সার্টিফিকেট দেব কী করে?’
সত্যিই তো! এমন ভোজনরসিকদের সার্টিফিকেট না পেলে কি আর নতুন দোকান জাতে ওঠে?
বাঙালি মানে লাড্ডু নয়, দরবেশ। বাঙালি মানে বাজার করতে বেরিয়ে থলে বগলে চেপে খান চারেক জিলিপি। বাঙালি মানে নেমন্তন্ন বাড়িতে গিয়ে ১১টার সময় ‘ব্রেকফাস্টে’ ছ’টা অমৃতির পর লাঞ্চে ইলিশ, পাঁঠার মাংস। এই কসমোপলিটন যুগেও। আগের দিনে মরশুম এলেই বাঙালি রোজ পাড়ার দোকানে খোঁজ নিত, ‘ওরে, নলেন এল রে?’ কিংবা মুড়কির মোয়া। ভাজা ভেটকি নাই বা হল। শীতে মোয়া চাই। আর তা যদি কণকচূড় খইয়ের ‘অরিজিনাল’ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আবার সেই বাবুই বড়দিনের আগে দাঁড়াতেন গ্রেট ইস্টার্নের লাইনে। কেককাহিনীর জাত্যাভিমান এখন অবশ্য অতীতেই পড়ে আছে। এই জমানায় কেক তৈরির সাম্রাজ্য বহুবিস্তৃত। তাই আজ আর সেই অর্থে কেকের ব্র্যান্ড খুব একটা দেখা হয় না। একটু ভালো হলেই হল... কিন্তু দু’টুকরো চাই। অন্তত পঁচিশের সকালে। নলেনকেও আমরা ভুলিনি। হ্যাঁ, উৎসাহে ভাটা পড়েছে বইকি। তাও বাড়ির কর্তা যখন অফিস ফেরত প্লাস্টিকের প্যাকেটে নতুন ঝোলা গুড় নিয়ে বাড়ি ফেরেন, গিন্নির মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা। ‘আজ তাহলে রাতে রুটি তো?’ প্রশ্নের সঙ্গে উড়ে আসে একচিলতে হাসিও। কর্তার মুখেও যুদ্ধজয়ের এক্সপ্রেশন... ‘চলতে পারে। আর না হলে কাল তো রোববার... সকালে না হয় একটু পাউরুটি নিয়ে আসব!’
সত্যি... বাঙালি রসনা ভুলতে পারবে না। সুকুমার রায়ও না। কবেই না তিনি লিখে গিয়েছেন... ‘কিন্তু সবার চাইতে ভাল—পাউরুটি আর ঝোলা গুড়।’