প্র তি মা র বি ব র্ত ন
সোমনাথ দাস
বর্ষা আর শরৎ এখন মিলেমিশে একাকার। বিশ্ব উষ্ণায়নের কৃপাদৃষ্টিতে শহরবাসীর পক্ষে আর এই দু’টি ঋতুকে আলাদা করা সম্ভব নয়। তবে ভাদ্রের সমাপ্তি এবং আশ্বিনের সূচনা বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে এক অনাবিল আনন্দ। মা দুর্গার আগমনবার্তায় আমাদের হৃদয় নেচে ওঠে। বাঁশ পোঁতা, বাটাম কাটার শব্দ, ত্রিপলের সোঁদা গন্ধ, পটুয়াপাড়ায় কাঠামোয় খড় বাঁধা এবং মাটি মাখার কসরৎ—এই অনুভূতিগুলি এখনও পুজো পাগলদের মধ্যে প্রবলভাবেই রয়েছে। প্যান্ডেল হপিংয়ের প্রধান আকর্ষণ বিভিন্ন রকমের প্রতিমা দর্শন। সে থিমই হোক কিংবা সাবেকি। কোথাও সপরিবারে জগৎজননীকে দেখলে দু’হাত আপনাআপনি মিলে যায়। আবার কোথাও বা স্রষ্টার সৃষ্টি নন্দনতত্ত্বে ভরপুর। প্রতিমার বিবর্তন নিয়েই তাই এই প্রতিবেদন।
গোপেশ্বর পাল
সর্বজনীন পুজোর প্রারম্ভিক পর্বে প্রতিমা হতো একচালার। টানা চোখ, ডাকের সাজই ছিল তার আকর্ষণ। ১৯৩৮ সালে গোপেশ্বর পালের হাত ধরেই চালার সংখ্যা এক থেকে পাঁচ হয়। নেপথ্যে রয়েছে একটি দুর্ঘটনা। কুমোরটুলি সর্বজনীনের মণ্ডপে তখন চলে এসেছে একচালার মা দুর্গা। কিন্তু পঞ্চমীর দিনই ঘটে গেল মহাবিপত্তি। সন্ধ্যায় হঠাৎই মণ্ডপে আগুন লাগে। সব পুড়ে ছাই। অথচ পরের দিনই বোধন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছুটে গেলেন শিল্পী গোপেশ্বর পালের কাছে। বললেন, যেভাবে হোক এক রাতের মধ্যে ঠাকুর তৈরি করে দিতেই হবে। ঠিক হল, আলাদা আলাদা করে প্রতিমা গড়া হবে। গোপেশ্বর পাল দুর্গা প্রতিমা গড়লেন। আর অন্যান্য শিল্পীরা গড়লেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। একচালা ভেঙে তৈরি হল পাঁচ চালার ঠাকুর। এক রাতের মধ্যেই সব তৈরি। ষষ্ঠীর দিন মণ্ডপেই তৈরি শেষ হল প্রথম পাঁচ চালার ঠাকুর।
রমেশ পাল
চারের দশকের গোড়ায় ফরিদপুরের পালঙ থেকে কলকাতায় শিল্পের পাঠ নিতে এলেন রমেশচন্দ্র পাল। তিনি দাবি করতেন, প্রতিমার ব্যবসা করতে কলকাতায় আসেননি। কিছু সর্বজনীন কর্তার ভালোবাসার চাপে তাঁকে প্রতিমা গড়তে হতো। পাঁচ ও ছয়ের দশকে কলকাতা দমকল বাহিনীর পুজোর প্রতিমা গড়তেন ভাস্কর রমেশ পাল। দমকল ছাড়াও পার্ক সার্কাস ময়দান, খিদিরপুর যুবক সঙ্ঘ ও একডালিয়ার এভারগ্রিনের প্রতিমায় রূপদান করতেন তিনি। আবার রমেশ পাল কুমোরটুলিতে আসার ঠিক পরেই ঢাকা-বিক্রমপুরের গ্রামের মৃৎশিল্পী রাখালচন্দ্র পাল কুমোরটুলিতে আসেন। প্রাক-স্বাধীনতা যুগ... ১৯৪২-৪৩ সাল। সঙ্গে তাঁর চার ভাই—হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল ও মোহনবাঁশি। সেই সময় সর্বজনীন দুর্গাপুজোয় মারাত্মক জনপ্রিয় ছিল কৃষ্ণনগর-ঘুণীর ঘরানার প্রতিমা। তাই এপার বাংলার এই ঘরানাকে ছাপিয়ে ওপার বাংলার ঢাকা-বিক্রমপুর ঘরানার প্রতিমা জনপ্রিয় হতে প্রচুর সময় লেগে যায়।
অশোক গুপ্ত
১৯৫৬ সালে জগৎ মুখার্জি পার্কের পুজোয় অশোক গুপ্ত নামে এক শিল্পী আর্টের দুর্গা প্রতিমা প্রথম প্রচলন করেন। আর ১৯৭৫ সালে চিত্রকর নীরদ মজুমদারের হাতের ছোঁয়ায় ভবানীপুর বকুলবাগানে আর্টের দুর্গা প্রতিমার এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়। পরবর্তীকালে আমরা এই আর্টের প্রতিমাকেই থিমের প্রতিমা হিসেবে চিহ্নিত করেছি।
উত্তর কলকাতার বাগবাজারের জগৎ মুখার্জি পার্কে অশোক গুপ্ত একটু অন্যরকম আর্টের প্রতিমা গড়তেন। তিনি ছিলেন বনেদি বাড়ির (অবিনাশ কবিরাজ বাড়ির) ছেলে। বাড়ির অমতে প্রতিমা বানানোর কাজ শিখতে গিয়ে গৃহত্যাগী হন এবং প্রখ্যাত ভাস্কর সুনীল পালের কাছে আশ্রয় নেন। ১৯৫৯ সালে প্রথমবার কুমোরটুলি থেকে একটি কাঠামো নিয়ে আসার পর তা ভেঙে অশোক গুপ্ত নিজেই প্রতিমা তৈরি শুরু করেন। তবে কিছু কিছু বিষয় তাঁকে বরাবর বিতর্কিত করে তোলে। যেমন সিংহর বদলে তাঁর দুর্গার বাহন ছিল বাঘ। বারবার উনি মা দুর্গার ফর্ম ভেঙ্গে সাধারণ মানুষের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি থার্মোকলের প্রতিমাও বানান রাজবল্লভ পাড়ায় সারঙ্গ নামক একটি সর্বজনীন দুর্গাপুজোর জন্য। তখনও কিন্তু আমাদের কলকাতার মানুষ থার্মোকলের নাম খুব একটা শোনেননি।
অশোক গুপ্তের জন্যই অস্ত্রবিহীন দুর্গা দেখতে পেয়েছিলেন পুজো অনুরাগীরা। সবকিছুর ব্যবহার প্রতীকী। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় থিমের প্রতিমার এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়। ইন্ডিয়ান মাইথলজির সঙ্গে পশ্চিমী সংস্কৃতির একটা মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যেত তাঁর কাজে, হাইরিলিফ পেন্টিংয়ের সঙ্গে নানারকম রঙের অকল্পনীয় ব্যবহার... যা কি না সেই সময় ভাবাই যেত না। প্রচারবিমুখ শিল্পী অশোক গুপ্তর মনের জোর ও সাহস ছিল মারাত্মক, বাগবাজার সর্বজনীনের জনপ্রিয় সাবেকি দুর্গাপ্রতিমা থেকে মাত্র ৩০০ মিটারের মধ্যে জগৎ মুখার্জি পার্কে থিমের প্রতিমা বানানো চাট্টিখানি কথা নয়! তাও আবার ছয়ের দশকে। অশোক গুপ্ত রবীন্দ্র সঙ্গীতের খুব ভক্ত ছিলেন, তাই প্রতিমা বানানোর সময় সারাদিন চলত দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট। তিনি যখন প্রতিমা বানাতেন, সত্যজিৎ রায় এসে দিনের পর দিন বসে থাকতেন... শুধু ওঁর কাজ দেখার জন্য।
অলোক সেন ও
মোহনবাঁশি রুদ্র পাল
অলোক সেনের কথা না বললে বিবর্তন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর অলোক সেন সাতের দশকে অন্যরকম আর্টের প্রতিমা গড়তেন। সামাজিক অনাচার, রাজনৈতিক হত্যা, শাসকের অত্যাচার নিয়ে প্রতীকী অসুর গড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মা দুর্গার সন্তান কার্তিক নেই, সেখানে দাঁড়িয়ে সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজির গায়ে পুরোপুরি সামরিক পোশাক। আর সবুজ-রঙা অসুরের বদলে একজন ইংরেজ মিলিটারি। ঠিক এই সময় কলকাতার দুর্গাপুজোতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটায় ভবানীপুর বকুলবাগান সর্বজনীন। ১৯৭৫ সালে থিমের প্রতিমা গড়েন চিত্রকর নীরদ মজুমদার। তারপর থেকে কুমোরটুলির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বকুলবাগানের প্রতিমা নির্মাণ এসে পড়ে নামজাদা শিল্পীদের হাতে। বিকাশ ভট্টাচার্য, ইশা মহম্মদ, শানু লাহিড়ি, মীরা মুখোপাধ্যায়ের মতো নামজাদা শিল্পীরা থিমের প্রতিমা গড়েন। বর্তমানে কুমোরটুলি প্রতিমা শিল্পীদের মধ্য সবচেয়ে বেশি যাঁর অবদান, তিনি হলেন বিক্রমপুর ঘরানার কিংবদন্তি শিল্পী মোহনবাঁশি রুদ্র পাল। চারের দশকের শুরুর দিকটায় রাখাল, নেপাল ও মোহনবাঁশি ভাইয়েরা একসঙ্গে ‘রাখাল চন্দ্র পাল এন্ড ব্রাদার্স’-এর ব্যানারে ঠাকুর গড়তেন। এঁদের হাত ধরেই ঢাকা-বিক্রমপুর ঘরানার শিল্প ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় লেগে যায় ওপার বাংলার এই ঘরানাকে জনপ্রিয় করে তুলতে। আটের দশকের শুরুতে ভাইদের ব্যবসা আলাদা হয়ে যায়, রাখাল, নেপাল পাল ও মোহনবাঁশি পৃথক ব্যানারে প্রতিমা বানানো শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে ঢাকা-বিক্রমপুর ঘরানা সুপরিচিত হতে থাকে। পরপর চার বছর এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান পুরস্কার পেয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠে আদি বালিগঞ্জ সর্বজনীন। মোট পাঁচবার তারা এই শারদ সম্মান লাভ করে। আদি বালিগঞ্জ বরাবর একটু অন্য ধাঁচের মণ্ডপ তৈরি করত, আর ওদের প্রতিমা গড়তেন ঢাকা-বিক্রমপুর ঘরানার শিল্পী মোহনবাঁশি রুদ্র পাল। তাঁর সুযোগ্য পুত্র প্রদীপ রুদ্র পালও অনবদ্য শিল্পী। তেলেঙ্গাবাগানের প্রতিমায় তাঁর বিভিন্ন ধরনের কাজ এখনও পুজো-পাগলদের চোখে ভাসে।
সনাতন দিন্দা ও ভবতোষ সুতার
১৯৯৮ এবং ২০০০—এই দু’টি বছরও প্রতিমা বিবর্তনের ইতিহাসে আলাদা জায়গা পাবে। কারণ, সনাতন দিন্দা এবং ভবতোষ সুতারের আবির্ভাব। ‘রুদ্র পাল’ জমানার রমরমার মধ্যেই এই দুই শিল্পী নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। হাতিবাগান সর্বজনীনে পথ চলা শুরু হয়েছিল সনাতনের। এর দু’বছর পরে বড়িশার একটি ক্লাবে প্রথম প্রতিমা গড়েন ভবতোষ। বর্তমানে এই দু’জনের সৃষ্টি দেখতে পুজোপ্রেমীরা উপচে পড়েন। প্রথম বছর সনাতন করেছিলেন গণেশজননী। এরপর তাঁকে আর থামতে হয়নি। একাধিক পদ্মের উপর প্রতিমা, কিংবা চম্বাদেবী বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। এরপর নলিনী সরকার স্ট্রিট, চেতলা অগ্রণী ও ৯৫ পল্লিতে সনাতনী প্রতিমা উৎকর্ষের অন্যতম উদাহরণ। পাশাপাশি বড়িশার সৃষ্টি এবং নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ, চেতলা অগ্রণীতে ভবতোষ সুতার বছরের পর বছর ভারতের বিভিন্ন শিল্পকে তাঁর প্রতিমায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ২০০০ সালে হাতিবাগান সর্বজনীনে প্রথম এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান পান সনাতন দিন্দা। আর চার বছর পরে এককভাবে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর পুরস্কারে ভূষিত হন ভবতোষ সুতার।
লেখক: দুর্গাপুজো গবেষক
29th September, 2019