ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
মিশন চন্দ্রযান-২। ১৪ জুলাই রাত ২.৫১ মিনিট (সরকারিভাবে ১৫ জুলাই)। অতন্দ্রপ্রহরী বিশ্ব, জিএসএলভি (জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল, মার্ক থ্রি-এম ওয়ান) ‘বাহুবলী’ ঘাড়ে করে নিয়ে যাবে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ আর রোভার ‘প্রজ্ঞান’কে। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বাতিল হয়ে গেল উড়ান। ২২ জুলাই দুপুর ২.৪৩ মিনিটে পুনর্যাত্রা। কঠিন ও তরল জ্বালানি পেটে ভরে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস রিসার্চ সেন্টার থেকে কান ফাটানো আওয়াজে সোনালি সাদা ঘন মেঘের চামর দুলিয়ে আকাশে ডানা মেলল ‘বাহুবলী’। ৯৭৪ সেকেন্ডে চন্দ্রযান-২ ল্যান্ডার-রোভার সমেত পৌঁছে গেল পৃথিবীর কক্ষপথে।
ইসরোর চেয়ারম্যান কে সিভান এই ‘ফিফটিন মিনিটস অব টেরর’ ছিলেন বাকরুদ্ধ। সম্বিত ফিরল সকলের সমবেত করতালিতে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। ৭ সেপ্টেম্বর আবার ১৫ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস প্রহর গোনা। সেদিন ৬ হাজার ১২০ কিমি প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে অরবাইটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘প্রজ্ঞানকে’ (২৭ কেজি) কোলে নিয়ে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ (১.৪ টন) টলমল পায়ে চাঁদের দক্ষিণ-মেরুতে দুই জ্বালামুখ ‘মানজিনাস-সি’ ও ‘সিম্পেলিয়াস-এনের’ মাঝামাঝি খানিকটা সমতলভূমি খুঁজে নামার চেষ্টা করবে। ১০ মিনিট ৩০ সেকেন্ড ধরে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭.৪ কিমি উচ্চতায় পাক খাবে বিক্রম। গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৫২৬ কিমি। পরবর্তী ৩৮ সেকেন্ডে গতিবেগ কমে হবে ঘণ্টায় ৩৩১.২ কিমি, চাঁদের মাটি থেকে উচ্চতা দাঁড়াবে ৫ কিমি। পরের ৮৯ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার উচ্চতায় নেমে যাবে ‘বিক্রম’, ১২ সেকেন্ড চক্কর খেয়ে বোঝার চেষ্টা করবে কোথায় নামা সমীচীন। ৬৬ সেকেন্ডে পরে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে ১০০ মিটারে। আবারও ২৫ সেকেন্ড ঘুরপাক খেয়ে ‘বিক্রম’ ঠিক করবে কোথায় নামা নিরাপদ! ১০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছে ১৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করবে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। স্বয়ংক্রিয় ভাবে চারটি পা বেরোবে ‘বিক্রমের’। চতুষ্পদে সে থিতু হওয়ার চেষ্টা করবে চাঁদের মাটিতে। দীর্ঘযাত্রার ধকল সামলাতে বিশ্রাম নেবে ক্ষণকাল। চন্দ্র-ভূমি স্পর্শ করা মাত্র সেন্সর মারফৎ ‘বিক্রম’-এর হৃদপিণ্ড বা ইঞ্জিন চালু হবে। নানা আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে ১৫ মিনিট পরে ‘বিক্রম’ প্রথম ছবি পাঠাবে। শ্রীহরিকোটায় অভিভাবকরা বিচার-বিশ্লেষণ করবেন বিক্রম সঠিক জায়গায় অবতরণ করল কি না! ৪ ঘণ্টা পরে অতিসন্তর্পণে ‘প্রজ্ঞানকে’ ভূমিষ্ঠ করবে ‘বিক্রম’। ‘প্রজ্ঞান’ তার ৬ পায়ে (৬টি চাকা) বিপুল অনুসন্ধিৎসায় শুরু করবে তার চরৈবেতি।
জন্মশতবর্ষে (জন্ম ১২ আগস্ট, ২০১৯) বিক্রম সারাভাইকে শ্রদ্ধা জানাতে চন্দ্রযান ২’র ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছে ‘বিক্রম’। ভারতের মহাকাশ গবেষণার পথিকৃৎ, ইসরোর প্রথম চেয়ারম্যান বিক্রম আম্বালাল সারাভাই। ভারতের প্রথম মহাকাশ উড়ান তাঁর সৌজন্যেই। সারাভাইয়ের প্রজ্ঞা-পাণ্ডিত্য-দূরদর্শিতা শুরুতেই ভারতকে মহাকাশ বিজ্ঞানে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি বেলুন ও ছোটখাট রকেটের মহাকাশে পাড়ি জমানোর মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ভারতের মহাকাশ অণ্বেষণ পর্ব। সারাভাইয়ের হাত ধরে ১৯৪৭ সালের ১১ নভেম্বর, মহাকাশ গবেষণার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় আমেদাবাদের ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ বা ‘পিআরএল’-এ।
বিক্রম ও মহাকাশ
আমেদাবাদের এক অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়িক পরিবারে ১৯১৯ সালের ১২ই অগস্ট আট ভাইবোনের সংসারে বিক্রমের জন্ম। ১৯৩৭ সালে প্রথাগত পড়াশোনা শেষে বিক্রম পাড়ি জমালেন কেমব্রিজের সেন্ট জনস কলেজে। ১৯৪০ সালে অঙ্ক ও বিজ্ঞানে ‘ট্রাইপস’ ডিগ্রি লাভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ভারতে ফিরে এলেন বিক্রম। সোজা চলে গেলেন ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রামনের কাছে। সেখানেই পরিচয় হোমি ভাবার সঙ্গে। বিক্রম তখন ‘কসমিক রে’ বা মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণায় নাওয়াখাওয়া ভুলেছেন। মহাজাগতিক রশ্মি পাকড়াও করতে ‘ন্যারো অ্যাঙ্গেল টেলিস্কোপ’ বসিয়েছিলেন কোদাইকানাল, তিরুবনন্তপুরম ও গুলমার্গে। ১৯৪৭ সালে ‘কসমিক রে ইনভেস্টিগেশন ইন ট্রপিকাল ল্যাটিচিউড’ তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি এনে দিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ। জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী। কেমব্রিজেরই ‘হ্যারো’তে জওহরলালের পড়াশোনা। পরিচয় ছিল সারাভাইয়ের সঙ্গেও। বিজ্ঞান প্রযুক্তি ছাড়া ভারতকে যে এক পা’ও এগনো যাবে না, নেহেরু-সারাভাই দু’জনেই তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
দরিদ্র ভারতে ‘মহাজাগতিক রশ্মি’ অশ্বডিম্ব ছাড়া কোনও হিতই যে সাধন করতে পারবে না, সেটা সত্বর উপলব্ধি করেই বিক্রম মনোনিবেশ করলেন কৃষি/বয়নশিল্পের উন্নতিতে। গান্ধীজির শিষ্য। শান্তি-অহিংসা তাঁর আরাধ্য। ভারতে ‘পাগোয়াস সোসাইটির’ গোড়াপত্তন তিনিই করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই পথচলা শুরু ‘আমেদাবাদ টেক্সটাইল ইন্ড্রাস্ট্রিজ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন’-এর। এরপর ১৯৫০ সালে সারাভাই কেমিক্যালস, ১৯৫৫’তে সুহৃদ গাইগি লিমিটেড, স্বস্তিক অয়েলস মিলস, ১৯৫৮’তে সারাভাই-মার্ক লিমিটেড ও কলকাতার সারাভাই ফার্মাসিউটিক্যালস। বরোদায় ‘সারাভাই রিসার্চ সেন্টার’ আর ১৯৬০ সালে ‘অপারেশনস রিসার্চ গ্রুপ’ বিক্রমেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। বহুকাল ঔপনিবেশিক শাসনে কাটানোর পর চিটচিটে এক হীনমন্যতা আঠার মতো সেঁটে ছিল ভারতের জনগণমনে। ১৯৬০-এ বিক্রম রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘পিসফুল ইউজেস অব আউটার স্পেস’ কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। আমেরিকান নীতিনির্ধারকরা বিক্রমের মধ্যে একইসঙ্গে ধুরন্ধর ব্যবসায়ী ও এক সফল মহাকাশ বিজ্ঞানীকে খুঁজে পেয়েছিল। তখনই তিনি ‘এমআইটি’র ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ভারতের মার্কিন দূতাবাস তাঁর সম্পর্কে ছিল বরাবরই উচ্ছ্বসিত। ১৯৬০-এ চীনের পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরই ভারত ঝাঁপাল রকেট তৈরিতে। নাসার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভাবা ও সারাভাই সলিড কন্ট্রোলড অরবাইটাল ইউটিলিটি টেস্ট সিস্টেম (SCOUT) রকেট জোগাড়ে তৎপর হন। হাল্কা উপগ্রহকে কক্ষপথে স্থাপন করার লঞ্চ ভেহিকেল ‘স্কাউট’।
১৯৬১’র আমেরিকান বসন্ত। বিক্রম পড়াচ্ছেন এমআইটিতে। সেখানেই আলাপ বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ ব্রুনো রসেইয়ের সঙ্গে। আলাপ হল আইওয়ার জেমস ভ্যান অ্যালেন ও শিকাগোর জে এ সিম্পসন এবং পি মেয়ারের সঙ্গে। আড্ডাচ্ছলে বিক্রম তাঁর মনের কথা ব্যক্ত করলেন। কীভাবে ভারতে শুরু করা যায় মহাকাশ চর্চা? নুন আনতে পান্তা ফুরনো সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশ। মহাকাশ গবেষণার বিপুল খরচ জোগাড় হবে কীভাবে? কোমর বেঁধে নামলেন বিক্রমসহ চার তরুণ তুর্কি। তাঁদের প্রবল পরাক্রমে নতজানু ‘নাসা’ সর্বতোভাবে ভারতকে সাহায্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নাসার সহায়তায় আমেদাবাদের পিআরএল, বোম্বের টিআইএফআর ও টাটা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে জোরকদমে শুরু হল মহাকাশ চর্চা ও অনুসন্ধান।
গবেষণার দিকনির্ণয়
নাসার সঙ্গে যৌথ কারিগরি সহায়তায় ঠিক হল ভারত মূলতঃ ভূচুম্বকত্ব, সোলার রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি, ৩০—১৫০ কিমি ঊর্ধ্বে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ, চৌম্বকক্ষেত্রে বিকিরিত তড়িদায়িত কণিকা আর ইলেকট্রো জেট গবেষণায় মনোনিবেশ করবে। পৃথিবীবিখ্যাত আবহবিজ্ঞানী হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটির লরেন্স কাহিলের সঙ্গে তখনই পরিচয় বিক্রমের। পরিচয় থেকে সখ্যতা। কাহিল পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার ভারতেও আসেন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই শুরু হল ভারতের সাউন্ডিং রকেট উৎক্ষেপণের প্রাথমিক প্রস্তুতি। বায়ুমণ্ডলের ৮০—১৬০ কিমি উচ্চতায় আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতির হদিশ পেতে কঠিন জ্বালানিতে ধাবমান সাউন্ডিং রকেটের কোনও বিকল্প নেই। ১৯৬১’র জুলাইতে নাসা সারাভাইকে একটি চিঠি পাঠিয়ে জানাল মউ স্বাক্ষরিত হবে নাসা ও আমেদাবাদের পিআরএলের মধ্যে। মহাশূন্যে ভ্রাম্যমাণ ‘গামা রে-ইলেভেন’ উপগ্রহ মারফত আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যাদি মিলছিল, ভারত তার সবটাই ব্যবহার করতে পারবে। ১৯৬১’র ৬ সেপ্টেম্বর, বিশ্বে সর্বপ্রথম, ‘পিআরএলের’ ঘরে পৌঁছল নাসার ‘টেলিমেট্রি রিসিভিং ফেসিলিটি’। ভারতে নাসার প্রথম পদার্পণ এই যন্ত্রটির মাধ্যমেই। ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জিতে বিক্রম সারাভাইয়ের চেয়ারম্যানশিপে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ’ (INCOSPAR) তৈরির অনুমোদন দিল মন্ত্রিসভার সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসরি কমিটি। এর প্রথম বৈঠক হয় ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২। বিক্ষিপ্ত, অগোছালো মহাকাশচর্চাকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে তৈরি হল ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরো।
থুম্বার জন্মবৃত্তান্ত
রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘কমিটি অন দি পিসফুল ইউজেস অব আউটার স্পেস’ সাউন্ডিং রকেট উৎক্ষেপণে দক্ষিণ গোলার্ধে বহুদিন ধরেই একটা যুতসই জায়গার খোঁজ করছিল। সারাভাইয়ের মনে হয়েছিল ভারতের মতো গরীব দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস খুবই জরুরি। তাতে চাষবাসের যেমন সুবিধা হবে, তেমনি বন্যা-খরায় অহেতুক জীবনহানিও অনেকটা আটকানো সম্ভব। সেইজন্য ভূপৃষ্ঠের ৪০—২০০ কিমি ঊর্ধ্বে আয়নোস্ফিয়ারে নিপুণ নজরদারি প্রয়োজন। বেলুনের পক্ষে যে উচ্চতায় নজরদারি অসম্ভব, আবার উপগ্রহের সাবলীল প্রদক্ষিণেও এই উচ্চতা ঝুঁকির। মুশকিল আসান করতে পারে একমাত্র সাউন্ডিং রকেট। শুরু হল অনুসন্ধান, ভারতের জিও ম্যাগনেটিক ইকয়েটরের, যেখান থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে সাউন্ডিং রকেট। কেরল উপকূল আদর্শ জায়গা বলে বিবেচিত হল। ই ভি চিটনিসের নেতৃত্বে গোটা অনুসন্ধান পর্বটা চলেছিল। কারণ বিষুব অঞ্চলের ঠিক কোন জায়গা রকেট উৎক্ষেপণের পক্ষে আদর্শ, তা খুঁজে বের করার জন্য তিনিই ছিলেন যোগ্যতম ব্যক্তি। কোচিন-আলেপ্পি-কুইলন-ত্রিবান্দ্রম-কেপ কমোরিনে (কন্যাকুমারিকা) তন্নতন্ন করে খোঁজ চলেছিল। থুম্বা ছাড়াও আরও কিছু জায়গা পরিদর্শকদের মনে ধরেছিল। যদিও ‘ম্যাগনেটিক ইকয়েটরের’ অধিষ্ঠান ছিল থুম্বা থেকে ৩২ কিমি দূরে কুইলনে। কিন্তু কুইলনকে বাছলে বহু মানুষকে বাস্তুচ্যূত হতে হতো। অগত্যা থুম্বা। ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৩। ত্রিবান্দ্রম বিমানবন্দরে অপেক্ষমান বিক্রম। হঠাৎই দেখা ভারতের প্রথম মহাকাশ উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের দুই প্রবাদপ্রতীম স্থপতি—আর ডি জন ও চিটনিসের সঙ্গে। তাঁদের দু’জনকেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘থুম্বা’কে রকেট উৎক্ষেপণের উপযোগী করে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে অনুরোধ করলেন সারাভাই। একেবারে সাধারণ পোশাকে মৃদুভাষী বিক্রমকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা জন সারাজীবনেও ভুলতে পারেননি। ৫৫০ একর জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছিল থুম্বা। থুম্বা ইকয়েটরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন বা TERLS কেরলবাসীর নয়নের মনি হয়ে উঠল অচিরেই।
প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ
সরেজমিনে সাউন্ডিং রকেট উৎক্ষেপণের খুঁটিনাটি পরিদর্শনে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে বেল্টসভিলের ‘গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে’ সটান হাজির বিক্রম। রকেট লঞ্চিং, পেলোড অ্যাসেম্বলি, রেঞ্জ সেফটি, ডপলার প্রযুক্তিতে রকেটৈর গতিবিধির হদিশ ও অ্যাঙ্গেল ট্র্যাকিং—সবটাই তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল ‘রেঞ্জ টাইমিং সিস্টেমে’। নভেম্বর ২১, ১৯৬৩। প্রথম সাউন্ডিং রকেট ‘নাইকি অ্যাপাচি’ টার্লস থেকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাশূন্যে পাড়ি দিল। সূর্যাস্তের ঠিক ২ মিনিট পরে রক্তাভ আকাশে ভেসে থাকা সোডিয়াম ভেপারের ছবি তুলবে ভারতের প্রথম স্বল্পপাল্লার রকেট। রকেটের পেলোড নাসা নির্ধারণ করেনি। এই ভার পড়েছিল ফ্রান্সের সেন্টার ন্যাশনাল ডি ইটিউডস স্পেটিয়ালিসের বিজ্ঞানী জে ই ব্লামন্টের উপর। নাসার কাছ থেকে পেলোড নেওয়ার জন্য যে পয়সার দরকার, ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারে তখন তা ছিল না। কম পয়সায় ফ্রান্সের কাছ থেকে যে পেলোড মিলবে, সে বুদ্ধি সারাভাইয়ের নাসার সতীর্থরাই তাঁকে দিয়েছিলেন। বায়ুমণ্ডলের ৮০ কিমি উপরে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতির অনুসন্ধানই ছিল পেলোডের নির্দিষ্ট কাজ। আয়নোস্ফিয়ার নয়, থার্মোস্ফিয়ার সম্বন্ধেও যা অনেক অজানা তথ্য জোগাবে।
কাঁটায় কাঁটায় ভোর ৬.২৩ মিনিট, সাদা ধোঁয়ার মেঘ-পাহাড়ের আড়ালে ‘নাইকি আপাচি’ ছিটকে বেরোল থুম্বা রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে। পেলোড ঘাড়ে নিয়ে উঠে গেল পৃথিবীর বায়ুস্তর ছাড়িয়ে ৮০ কিমির বেশি উঁচুতে। উচ্ছ্বসিত হোমি ভাবা বললেন, ‘নাসার হাত ধরেই ভারতের মহাকাশ যাত্রা শুরু হল।’ বিক্রম তখন উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে একটু দূরে সমুদ্রের ধারে কেরলের রাজ্যপাল ও অন্য অতিথিদের সঙ্গে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছেন উজ্জ্বল কমলা মেঘের চন্দ্রাতপে ঢেকে যাওয়া বিশ্বচরাচর। কারও মুখে কোনও কথা নেই। আর্নল্ড ফ্রাটকিন, নাসার এদ বিসেল, রবার্ট কনরাড, জ্যাক ব্ল্যামন্টরা দাঁড়িয়ে উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে। বিক্রম স্বগতোক্তির ঢঙে বলে উঠলেন, ‘ভারতের মহাকাশ যুগের সূচনা হল থুম্বা থেকে।’ ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮। টার্লসকে ইন্দিরা গান্ধীর পৌরোহিত্যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের হাতে সমর্পণ করা হল। তাদের তত্ত্বাবধানে সমগ্র বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরবর্তীকালে যা ব্যবহৃত হবে। বিক্রম তখনও মগ্ন সাউন্ডিং রকেট তৈরির প্রকৌশলে। তিনি বুঝেছিলেন মহাকাশে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে সাউন্ডিং রকেট ভারতকে নিজেকেই তৈরি করতে হবে। তাঁর সেই সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফল আজকের ‘চন্দ্রযান-২’। মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে বিক্রমের চেয়ারম্যানশিপে ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে সম্পন্ন হল ভিয়েনা কনফারেন্স। সেই প্রথম বিক্রমের বক্তব্য থেকে সারা পৃথিবী জানতে পারল ‘রিমোট সেন্সিং’-এর অপরিসীম গুরুত্ব। বৃষ্টিপাত, ভূমিক্ষয়, ভূগর্ভস্থ জল, বনভূমির বিস্তার, সমুদ্রে মাছের ঝাঁক—সবেরই নিখুঁত দিশারি ‘রিমোট সেন্সিং’। বিশ্বশান্তির অক্লান্ত প্রচারক, মনেপ্রাণে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ও পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী হওয়ার কারণেই ১৯৭০ সালে তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এজেন্সিরর জেনারেল কনফারেন্সের অবিসংবাদী সভাপতি নির্বাচিত হন। সারা বিশ্বেই অত্যন্ত সম্মানীয়-সমাদৃত ছিলেন বিক্রম।
নিঃসঙ্গ বিক্রম
আমেদাবাদের উসমানাপুরে, সবরমতী নদীর ধারে বিক্রম-মৃণালিনীর স্বপ্নের মঞ্জিল ‘চিদম্বরম’। মধুর কলতানে আজান আর মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি যুগপৎ ভেসে আসে। মৃণালিনীর বাবা, সুব্বারামা স্বামীনাধন ছিলেন সেইসময়ের নামী ব্যারিস্টার। বোন লক্ষ্মী সেহগল, নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের মহিলা ব্রিগেডের সক্রিয় সেনানী। মৃণালিনী বরাবরই দৃঢ়চেতা, অন্তর্লীন-আত্মমুখী। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা। তারপর মুথুকুমারা ও মীনাক্ষী সুন্দরম পিল্লাইয়ের কাছে ধ্রুপদী নৃত্যের কঠোর তালিম। উটিতে টেনিস কোর্টে মৃণালিনীর সঙ্গে আলাপ বিক্রমের। বয়সে বিক্রমের থেকে এক বছরের বড় ছিলেন মৃণালিনী। বিক্রমের নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই, নৃত্যে মৃণালিনীও ততোধিক ব্যস্ত। দু’জনেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিয়ে করবেন না। কিন্তু ছ’মাসও কাটল না। প্রেমের জোয়ারে ভেসে ১৯৪২ সালে সাতপাকে বাঁধা পড়লেন বিক্রম-মৃণালিনী। যৌথ পরিবারে বিক্রম-মৃণালিনীর ব্যক্তিগত কোনও মূহূর্ত নিভৃতে কাটানোর উপায় ছিল না। ‘চিদম্বরম’ তৈরি সেই কারণেই। প্রথম পুত্র কার্তিকেয়, দ্বিতীয় কন্যা মল্লিকা। বিক্রমের বোন মৃদুলার সঙ্গে ভীষণ মিল মল্লিকার। অকুতোভয় মৃদুলা ১৯৪৬ সালের কুখ্যাত ‘নোয়াখালি’ দাঙ্গার সময় গান্ধীজির সঙ্গে পাড়ি জমিয়েছিলেন নোয়াখালিতে। পুত্র-কন্যা দু’জনেই পেশাগত জগতে চূড়ান্ত সফল। মৃণালিনী একটা নীল রঙের পরচুলা পরে নানারকম অদ্ভুত সাজে সাজতে ভালোবাসতেন। ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করলেও, নজরদারিতে খামতি ছিল না কখনও। ঘরবাড়ি সাজানো থেকে সাজপোশাক—সবেতেই নিখুঁত পারিপাট্য ও রুচির পরিশীলিত ছাপ লেগে থাকত। নৃত্যের অভিঘাতেই মৃণালিনী ক্রমশ মজেছিলেন কৃষ্ণ-প্রেমে। ডুবে যাচ্ছিলেন কৃষ্ণ-সুধারসে। ব্যক্তিগত জীবনে বিক্রমের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। ভয়ানক ব্যস্ত বিক্রম, সারা পৃথিবীতে চরকিপাক খেতে খেতে ক্রমশ নিজের সংসার থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। তারই মধ্যে মৃণালিনীর বন্ধু কমলা চৌধুরীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বিক্রমের। তৃষিত হৃদয়ে অপরিসীম একাকীত্ব আর খ্যাতির বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে বিক্রম আশ্রয় খুঁজছিলেন কমলার সান্নিধ্যে। রূপে-গুণে অনন্যা, বিড়ম্বিত কমলা ত্রিকোণ সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে দিল্লি ডিসিএমে চাকরি নিলেন। কিন্তু কমলাকে আমেদাবাদে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর বিক্রম তাঁকে ‘পিআরএলের’ অধিকর্তার পদ প্রদান করলেন। লন্ডনের ‘টাভিসস্টক ইনস্টিটিউটের’ সঙ্গে কথা বলে ওরকমই আর একটি প্রতিষ্ঠান খুলতে চাইলেন আমেদাবাদে। তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের শাখা খুলতে উদ্যোগী হলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কমলা আর বিক্রমের সম্পর্ক ছিল মধুর। ফলে আমেদাবাদে দ্বিতীয় আইআইএম খোলার ব্যাপারে সবরকম সরকারি সহায়তা বিক্রম অতি সহজেই পেলেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া আমেদাবাদ আইআইএমকে সবরকম সাহায্য করবে। কিন্তু কমলা-বিক্রমের প্রেমকাহিনী পল্লবিত হতেই এবং অন্যান্য কিছু কারণে ক্যালিফোর্নিয়া আহমেদাবাদ আইআইএম থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। কিন্তু বিক্রমের সঙ্গে সুমধুর সম্পর্কের সুবাদে এগিয়ে আসে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল। বিক্রম আমেদাবাদ আইআইএমের প্রথম ডিরেক্টর, কমলা হলেন রিসার্চ ডিরেক্টর। কমলার সঙ্গে আলোচনা না করে আইআইএমের কোনও সিদ্ধান্ত বিক্রম কখনও নেননি।
তারপর হঠাৎই এল সেই অশুভ দিন। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। কাজপাগল বিক্রম মগ্ন থুম্বাতে। হঠাৎই বুকে চিনচিনে ব্যথা, চিকিৎসার সুযোগও মিলল না। মাত্র ৫২ বছর বয়সে আচম্বিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন অমিত সম্ভাবনাময় যুগপুরুষ বিক্রম সারাভাই। পাড়ি জমালেন তাঁর সাধের মহাকাশে। চিরসখা তারাদের মাঝে। তাঁর মৃত্যু ঘিরেও সেইসময় নানা রহস্য দানা বেঁধেছিল। মহাকাশে ভারত আজ যখন সাফল্যের ডানা ঝাপটাচ্ছে, তখন সুদূর কোনও নীহারিকাপুঞ্জের আড়াল থেকে হয়তো ক্ষণজন্মা বিক্রম মিটিমিটি হাসছেন।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস