পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
পাথুরে পথ। পাথুরে ঠান্ডা। গাড়ি যেখানে থামবে সেখান থেকে আন্দাজ সাড়ে আটশো মিটার চড়াই হেঁটে উঠতে হবে। পথে তিনবার পায়ের নীচে বয়ে চলা জলধারা কুমিরডাঙা খেলতে ডাকবে আপনাকে। চারপাশ ঘিরে রয়েছে দীর্ঘদেহী গাছের দল। ঠিক যেন মাথায় পূর্বজদের স্নেহাশিস। নিস্তব্ধ বনপথে দূর থেকে শোনা জলের শব্দই আপনার পথপ্রদর্শক। ছোট্ট ট্রেক শেষে আপনি যে অনন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন, মাথা উঁচু করে যাকে দেখবেন, তার ভারি আহ্লাদী একটা নাম রয়েছে— ঝিকিরা। তারও যে আপনাকে ভালো লেগেছে তা সে বুঝিয়ে দেবে ঝরে পড়া জল দিয়ে। ভিজিয়ে দেবে আপনাকে।
ছোট্ট ছুটির গন্তব্য ছিল মেঘতাবুরু, কিরিবুরু, সারান্ডা। নামের মধ্যেই জড়িয়ে রোমাঞ্চ। এই সফরে সবচেয়ে যাকে ভালো লাগল, সেই ঝিকিরার কথা আগেই বলেছি। এক ঝর্ণার নাম। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সফরের দ্বিতীয় দিনে। প্রথম দিনের রোমাঞ্চও কিছু কম ছিল না। হাওড়া থেকে সকালের জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে চড়ে দুপুর নাগাদ পৌঁছলাম বরবিল স্টেশন। মিনিট দশেকের দূরত্বে দিন দুয়েকের আবাস। মধ্যাহ্নভোজ সেরে বেরলাম। সারথি লক্ষ্মণ স্থানীয়। কম কথার মানুষ। প্রথমে নিয়ে গেলেন মুর্গা মহাদেব মন্দির দর্শনে। সেখানেও অপেক্ষা করছিল এক অপূর্ব ঝর্ণা। রয়েছে স্নানের ব্যবস্থাও। স্নান সেরে পুজো দিতে পারেন। বিকেলটা কাটল মৃগসিংহ গ্রামের পথ ধরে গিয়ে বৈতরণী নদীর কাছে। পাথরের উপর এক বিরাটাকার পায়ের মাপের গর্ত দেখিয়ে লক্ষ্মণ জানালেন, সেটা নাকি শ্রীরামচন্দ্রের পা! এমন এক আশ্চর্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ‘লক্ষ্মণ’ আক্ষরিক অর্থেই যোগ্য ব্যক্তি। ঝুপ করে নেমে আসা আঁধার নয়, ধীরে ধীরে মরে আসা আলোতে উঁচু টিলার উপর পা ছড়িয়ে বসে থাকা যায় অনেকক্ষণ। মাঝে বয়ে যাচ্ছে ঝর্ণা। ওপারে পিকনিক করতে আসা একদল হুল্লোড়ে তখন মনখারাপ করে বসে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে যে!
ওড়িশার এই অংশ খনিজ পদার্থের জন্য বিখ্যাত। আকরিক লোহা, ম্যাগনেশিয়ামের মতো বহু খনিজের খনি ঘিরে রেখেছে সারান্ডাকে। লাল হয়ে থাকা পথের ধুলো তার সাক্ষী। দ্বিতীয় দিন প্রাতঃরাশের পর মধ্যাহ্নভোজ সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। জঙ্গুলে পথ ধরে পৌঁছে গেলাম জটেশ্বর মন্দির। সেখানেও এক ঝর্ণাভরা স্নান অপেক্ষায়। মিনিট পনেরো হেঁটে গেলেই এক অপূর্ব লেক। স্থানীয়দের কাছে জটেশ্বর লেক নামেই তার পরিচিতি। লেকের কাছে পৌঁছনোর হাঁটা পথে নির্জনতা বন্ধু হবে। ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গী তখন জলের গান। এরপর গন্তব্য কারো নদী। জলে ভাসছে শ্যাম্পুর প্যাকেট। পাড়ে পড়ে রয়েছে তথাকথিত সভ্যতার ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক। প্রকৃতি বোধহয় বুঝতে পেরেছিল এসব দেখে মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই এর পরের গন্তব্য ঝিকিরাকে মন ভালো করার সব উপচারে সাজিয়েছে যত্ন করে। ঝিকিরা থেকে ফিরে গাড়ির বনেটকে টেবিল বানিয়ে সেরে ফেললাম মধ্যাহ্ণভোজ।
সারান্ডার জঙ্গলের ভিতরে ঘুরতে গেলে একটা গোটা দিন সময় লেগে যায়। সেক্ষেত্রে বাকি দর্শনীয় স্থান আর যাওয়া যায় না। তিনদিন হাতে সময় থাকলে মোটামুটি ঘুরে ফেলা যায় সবটাই। হাতে সময় কম থাকার কারণেই ‘বাফার জোন’ বেছে নিয়েছিলাম। সে জঙ্গলও প্রাণের আরাম দিয়েছে ভরপুর। দুপুর যখন বিকেলের সঙ্গে আসনপিঁড়ি হয়ে গল্প করতে বসে তখন ফুলবাড়ি শাল জঙ্গলে গাছের সঙ্গে রোদ্দুরের সোহাগ দেখছিলাম। ঘন জঙ্গল নয়। তাই রোদের আনাগোনা রয়েছে। স্বপ্নেশ্বর শিব মন্দিরের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। জঙ্গলের মধ্যে একলা মন্দির। সামনে ধুনির ধোঁয়া আর গেরুয়া বসন তিন সন্ন্যাসীর উপস্থিতি এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। হালকা পাথুরে পথ ভেঙে পৌঁছলাম পুন্ডুল ঝর্ণায়। জল শুকিয়ে পাথর ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। মন দিয়ে সেদিনের কাজের হিসেব মিলিয়ে নিচ্ছে দুই বক। সফরের শেষ গন্তব্য মেঘতাবুরু সানসেট পয়েন্ট। পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ যেন পোস্টকার্ডে আঁকা ছবির মতো। সত্যিই সেখানে পৌঁছে মনে হবে ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো...।’
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে বরবিল স্টেশনে নেমে ঘুরুন।
কোথায় থাকবেন: বরবিল থেকে ১০-১৫ মিনিটের দূরত্বে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। পকেট বুঝে নিজের পছন্দমতো বেছে নিন। থাকা, খাওয়া, গাড়ি সবই প্যাকেজে পাবেন। দু’দিনের জন্য মাথাপিছু খরচ ৭৫০০ টাকা। আবার হোটেলে পৌঁছে আলাদা করে গাড়ির ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।