কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
পথ চলা শুরু
আশি বছরের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের পথ চলার গল্পটা স্বপ্নের মতো। প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রয়াত মরণচাঁদ সেন। ওঁর বাবা পেশায় শিক্ষক। মরণচাঁদবাবু ঢাকায় একটি ছোট সোনার দোকানে চাকরি করতেন। দোকানে ইরান থেকে আসা এক ইরানি ভদ্রলোক দোকানে একদিন ভুলবশত দুর্মূল্য বসরাই মুক্তোর প্যাকেট ফেলে যান। সেই মুক্তোর প্যাকেটটি মরণচাঁদবাবুর নজরে পড়ে। তখন সেই প্যাকেট মরণচাঁদবাবু দোকান কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে গেলে তাঁকে সেটি সিন্দুকে তুলে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। কয়েক মাস পর ইরানি ভদ্রলোক দোকানে এসে বলেন যে তাঁর দামী মুক্তোর প্যাকেটটি এখানেই খোয়া গিয়েছে। তখন দোকানের মালিক মরণচাঁদবাবু কে সেটি আনতে বলেন। ভদ্রলোক খুশি হয়ে মরণচাঁদবাবুকে নির্দেশ দেন যে ওই মুেক্তা দিয়ে তিনি যেন নতুন ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ১৯২৪ থেকে মরণচাঁদবাবু সাইকেলে চেপে বাড়ি বাড়ি ঘুরে থলে করে মণিরত্ন বিক্রি করতে আরম্ভ করেন। সেইসঙ্গে মণিরত্ন নিয়ে তিনি নানা চর্চা করতে থাকেন।
১৯২৯-১৯৩০ সালে ঢাকার ব্যবসায়িক সমাজ সংগঠন মরণচাঁদবাবুকে ‘জহুরি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর থেকে মরণচাঁদবাবু মনিরত্নের পাশাপাশি কারিগরদের দিয়ে নিজস্ব ডিজাইনের সোনার গয়না তৈরি করে বিক্রি করতেও শুরু করেন। ব্যবসায় কিছুটা সাফল্য এলে ১৯৩৮ বাংলাদেেশর ঢাকায় তাঁতী বাজারে খুব স্বল্প পরিসরে জায়গা নিয়ে তিনি সেনকো জুয়েলার্স নামে একটি শোরুম উদ্বোধন করেন। তখন রুপোর গয়নাও বিক্রি হতো। এরপর ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পূর্বে তিনি ও তাঁর পরিবার সকলে কলকাতায় চলে আসেন। ৩৭০ রবীন্দ্র সরণী এই ঠিকানায় চিৎপুরে সেন পরিবারের নিজস্ব বাসভবনের একতলায় ১৯৪৯-এ সেনকো জুয়েলার্স প্রাইভেট লিমিটেড নামে কলকাতায় প্রথম শোরুম উদ্বোধন করেন। এরপর ১৯৫০-এ আমর্হা স্ট স্ট্রিট ও বউবাজার সংযোগস্থলে বউবাজারের শোরুম উদ্বোধন হয়। পরবর্তী সময়ে এই ব্যবসায় তাঁর ছেলেরাও যুক্ত হন। এরপর ১৯৫৪-তে মরণচাঁদবাবু মারা যান। ১৯৪৯-১৯৫৭ এই সময়ে বউবাজারে চারটি বিভিন্ন নামে সেনকো শোরুম উদ্বোধন হয়। তবে সেনকোর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেনকো গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ডসের কোনও ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। ১৯৬৮-তে মরনচাঁদবাবুর চতুর্থ পুত্র প্রয়াত প্রভাতচন্দ্র সেন পৃথকভাবে ব্যবসার উদ্যোগ নেন। এইভাবে উনি প্রতিষ্ঠানের পথ চলা শুরু করলেন-বললেন সংস্থার চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর শংকর সেন।
ব্যবসায় অগ্রগতি
প্রগতিশীল প্রভাত চন্দ্র বাবু ছিলেন অত্যন্ত আদর্শ ও নিষ্ঠাবান, সৎ, পরিশ্রমী একজন মানুষ। তিনি বটানি অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। তিনি নিজের ব্যবসায় স্ত্রী মিনতি সেনকে সহযোগী হিসেবে যুক্ত করেন। ১৯৬৮-তে বউবাজারে সেনকো জুয়েলারি মিউজিয়াম, ১৯৭০-এ শ্যামবাজারে সেনকো জুয়েলারি মার্ট ও গড়িয়াহাটে ১৯৭১-১৯৭২ মধ্যে সেনকো জুয়েলারি মার্টের দ্বিতীয় শাখা উদ্বোধন হয়। এরপর ১৯৭৮-এ তাঁর একমাত্র সুযোগ্য পুত্র শংকর সেন এই ব্যবসায় যোগদান করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ। গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে বাবার এই ব্যবসায় তিনি যুক্ত হন। ১৯৮৮ পর্যন্ত প্রতাপচন্দ্রবাবু এবং শংকরবাবু যৌথভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যান। এরপর শঙ্করবাবু ও তাঁর স্ত্রী রঞ্জনা সেন ব্যবসার হাল ধরেন।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ
১৯৯৭ তে শংকরবাবু রবীন্দ্র সরোবরের কাছে মেনকা সিনেমা হলের কাছে সেনকো গোল্ড নামে একটি বুটিক শোরুম উদ্বোধন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ছয় মাসের মধ্যে ডাকাতি হয়ে গেলে দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৯৮ প্রভাতচন্দ্রবাবু চলে যান। এরপর শংকরবাবু ২০০১-এ বেহালায় সেনকো গোল্ড নামে একটি শোরুম খোলেন। ২০০৩-এ মৌলালিতে ছ’হাজার স্কোয়্যার ফুটের সেনকো গোল্ডের মেগা শপ খুলে যায়। পূর্ব ভারতে ২০০০ সালে সোনার ব্যবসায় প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি শুরু করেন এঁরা। দুর্গাপুরে প্রথম এই সংস্থার ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলে। বর্তমানে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সমেত দিিল্ল,মুম্বই, বেঙ্গালুরু হায়দ্রাবাদ, পুনে, ভুবনেশ্বর, পাটনা, গুয়াহাটি, রায়পুর, লখনউ, রাঁচি ইত্যাদি জায়গায় নিজস্ব শোরুম ও ফ্র্যাঞ্চাইজি সমেত এঁদের শোরুম সংখ্যা এখন ১০৮ টি। এছাড়া এঁদের গয়না মধ্য প্রাচ্যে ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হয়। ১৯৯৪ থেকে এই সংস্থার নাম হয় সেনকো গোল্ড প্রাইভেট লিমিটেড। ২০০৬ থেকে এঁদের পুরনো যত সংস্থা ছিল সব একসঙ্গে করে সেনকো গোল্ড প্রাইভেট লিমিটেড করা হয়। ২০০৮ থেকে সংস্থার নাম হল সেনকো গোল্ড লিমিটেড। এঁদের ব্র্যান্ডের নাম সেনকো গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ডস। ২০০৮-এ শংকরবাবুর পুত্র শুভঙ্কর সেন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। শুভঙ্কর অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন। এরপর এম বি এ পাশ করেন।
ডিজাইনের নানা রকম
প্রথমে স্বর্গীয় মরণচাঁদবাবু ও পরে তাঁর পুত্র প্রভাতচন্দ্রবাবু নিজেই অলংকার ডিজাইন করতেন। এরপর অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে পাশ করা শংকরবাবু ডিজাইন করতেন। এরপর দু’জন ডিজাইনার নিয়োগ করা হয়। ২০০৮-এ যখন শুভঙ্কর যুক্ত হন, তখন থেকেই ব্যবসার অন্যান্য দিকের পাশাপাশি ডিজাইনের দিকটাও তিনি খেয়াল রাখতেন। এখন শুভঙ্কর ও তাঁর স্ত্রী জয়িতা সেনের অধীনে ১২জন ডিজাইনার রয়েছে। প্রথম থেকেই এঁদের লক্ষ্য ছিল যাতে মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে সোনার গয়না গ্রহণীয় হয়। এছাড়াও বিয়ের কনেকে যাতে দেখতে ভরাট লাগে সেজন্য চোখে ভারী অথচ হালকা ওজনের গয়না তৈরি করাও এঁদের বিশেষত্ব।
সিগনেচার প্রোডাক্ট
এঁদের সোনা, হীরে,প্লাটিনাম গয়না তো আছেই। পাশাপাশি রুপোর এবং ফ্যাশন জুয়েলারি এঁদের অত্যন্ত জনপ্রিয়। ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন নামী দামি ব্র্যান্ডের হীরের গয়না এই সংস্থায় পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে হীরের বেশিরভাগ ব্র্যান্ড বন্ধ হয়ে গেলে এঁরা নিজস্ব হীরের ব্র্যান্ড ‘পারফেক্ট লাভ’ লঞ্চ করেন। এখান থেকে হীরের গয়না কিনলে সার্টিফিকেট সমেত পাবেন। এঁদের অ্যান্টিক ডিজাইনের গয়না আকর্ষণীয়। এঁদের ডিজাইনার রুপোর গয়না থেকে ফ্যাশন জুয়েলারিতে স্বকীয়তা রয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সম্প্রতি ১২৯/১ বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে (বউবাজার) সাত হাজার স্কোয়্যার ফুটের একটি মেগাশপ খুলে গেল। এছাড়াও এই বছরে হাতিবাগানে আরেকটি মেগাশপ উদ্বোধন হবে। এই দু’টি ছাড়াও চন্ডিগড়, এলাহাবাদ এবং লখনউতে এঁদের শোরুম খুলবে। রুপোর গয়নার ডিজাইনে আরও নতুনত্ব আনা হবে।
কর্মসংস্থান
যে ১০-১২ জন কর্মী নিয়ে প্রথম এই সংস্থার জয়যাত্রা শুরু হয়, আজ তাদের প্রত্যক্ষ কর্মীর সংখ্যা ১৪৫০ জন। এছাড়াও পরোক্ষভাবে রয়েছেন আরও ৫০০ থেকে ৬০০ জন কর্মী। সংস্থার অগ্রগতির সঙ্গে এখানে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
চলচ্চিত্রে গয়না স্পনসর
শংকরবাবুর আমল থেকেই চলচ্চিত্রের জন্য এই সংস্থা ব্র্যান্ডিং আর গয়না স্পনসর করেন। ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ ছবি দিয়ে তা শুরু। হিন্দি ছবি পিকু, তুমহারি সুলু, বেগমজান ছবিতেও এঁরা গয়না স্পনসর করেছেন। বিদ্যা বালন অভিনীত আগামী ছবি শকুন্তলা দেবী-র জন্য এঁরা ব্র্যান্ডিং, গয়না স্পনসর করেছেন। এছাড়া উইন্ডোজ প্রোডাকশনের বহু জনপ্রিয় ছবিতে এঁরা সংস্থার ব্র্যান্ডিং ও স্পনসর করেছেন।
চৈতালি দত্ত