কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
য় একশো বছর আগের কথা। আজকের নিউ মার্কেট তখন হগ সাহেবের বাজার। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সেখানে উপচে পড়ত ভিড়। কেক পেস্ট্রির গন্ধে ম ম করত চারদিক। গোলাপ আর মরশুমি ফুলে রঙিন হয়ে থাকতো ফুল বাজার। সাহেবসুবোদের হাপি নিউ ইয়ার আপ্লুত করত সেকালের বাঙালি ব্যবসায়ীদের। তবে বাংলা নববর্ষের দিন সাহেব মেমসাহেবদের আন্তরিক শুভেচ্ছায় শুধু আপ্লুত নয় বিগলিত হতেন বাঙালি বিক্রেতারা —বলছিলেন নিউ মার্কেটের শতাব্দী প্রাচীন প্রতিষ্ঠান দি রয়াল স্টোরের অজয়কুমার শ। বললেন, বাবার কাছে গল্প শুনেছি নববর্ষের দিন ফিটন গাড়ি চড়ে হগ মার্কেটে আসতেন সাহেব মেমরা। সাহেবরা স্যুট বুট পরলেও মেমরা সেদিন আসতেন লাল পাড় তাঁতের শাড়ি পরে। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলতেন শুভ নববর্ষ। সঙ্গে উপহার আনতেন বিক্রেতার জন্যে। এমনই মধুর ছিল ক্রেতা বিক্রেতার সম্পর্ক।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। শুধু মাধ্যমটা বদলেছে। ধরনটা বদলেছে —বললেন সেনকো গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ডস-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শঙ্কর সেন। মনে পড়ছে পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখন আমি বেশ ছোটই। ফাল্গুন মাসের শুরু থেকেই তোড়জোড় চলত। কার্ড ছাপানো হতো হাজার দুয়েক। কর্মচারীরা জাবদা খাতা থেকে খদ্দরের নাম ঠিকানা লিখে স্ট্যাম্প লাগিয়ে জিপিও’তে পোস্ট করে আসতেন। নববর্ষের কয়েক দিন আগে থেকে ভিয়েন বসত। মিষ্টি তৈরি হতো, যেন মেয়ের বিয়ের আয়োজন। খুব বড় ক্যালেন্ডারের অর্ডার দেওয়া হতো। তখন এখানে ছাপা হতো না। মাদ্রাজ থেকে ছেপে আসতো। সে ভারী মজার দিন ছিল। এখনও আমাদের সব শোরুম থেকে ফোন করে এসএমএস করে আমন্ত্রণ জানানো হয় ক্রেতাদের। মালিক কর্মচারি মিলে আমাদের সেনকো পরিবার। আমরা সবাই একসঙ্গে আপ্যায়ন করি সবাইকে। করোনা মোকাবিলাতেও আমরা একযোগে কাজ করছি। সারা ভারতে আমাদের যত শোরুম আছে সব কর্মী তাঁদের একদিনের বেতন দিয়েছেন। আমাদের পক্ষ থেকে দেড় কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। নতুন বছর যেন মহামারীমুক্ত হয় সেই প্রার্থনা করি মহাপ্রভুর কাছে।
শ্যামসুন্দর কোং জুয়েলার্সের প্রাণপুরুষ রূপক সাহার মন পড়ে আছে স্বর্ণশিল্পের সেই সব কারিগরের কাছে, যাঁদের হাতের ছোঁয়ায় এক একটি গয়না হয়ে ওঠে ভাস্কর্য। ত্রিপুরার আগরতলায় তাঁর কারিগরদের বাস। তাঁদের সাধ্যমতো সাহায্য তো করছেনই, তাছাড়া ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ সাহায্য করেছেন। এবার নববর্ষটা এভাবেই কেটে যাচ্ছে তাঁর।
নববর্ষের প্রসঙ্গ উঠতেই অঞ্জলি জুয়েলার্সের কর্ণধার অনন্যা চৌধুরী চলে গেলেন নস্টালজিয়ায়। বললেন, কী জানি কেন আজ মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার কথা। বছরে একটা দিনই ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন বাবা। আমাদের পৈতৃক দোকানে সেদিন সাজো সাজো রব। সকালে পুজো হতো। আমরা নতুন জামা পরে চলে যেতাম। বেলফুলের মালা দিয়ে দোকান সাজানো হতো। রুপোর রেকাবিতে মিষ্টি দেওয়া হতো। রুপোর পানদানিতে মিঠে পান থাকতো, আর দেওয়া হতো দই গোলাপের সুগন্ধি দিয়ে তৈরি ঘোলের শরবত। সকাল থেকে পরিবেশন করতে করতে নিজেও এত শরবত খেয়ে ফেলতাম যে বাড়ি ফিরে কিছু খেতে পারতাম না। মায়ের কাছে বকুনি খেতাম। চৈত্রমাস পড়লেই মনে পড়ে বাবার কথাগুলো— খদ্দের লক্ষ্মী। ওঁদের কখনও অবহেলা করবে না। সবসময় যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে। নতুন বছরে আমন্ত্রণ জানাবে। এইবার তার ব্যতিক্রম হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বাড়িতেই থাকতে হবে সবাইকে। আমি জানি আমাদের ক্রেতারা আমাদের সঙ্গেই আছেন। দেবতার চরণে মিনতি করি, পৃথিবী থেকে সব কালিমা দূর করে দাও। নতুন বছর যেন রোগমুক্ত হয়। আলোর পথ দেখাও আমাদের।
আলোর সন্ধানে ঈশ্বরের মুখ চেয়ে বসে আছেন প্রবীণ তাঁত বস্ত্র ব্যবসায়ী অলোককুমার দত্ত। নববর্ষের প্রসঙ্গ উঠতেই যেন একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন, দেখুন এমনিতেই তাঁতশিল্পীদের অভাবের শেষ নেই। হস্তচালিত তাঁতে কাপড় বোনেন যাঁরা, তাঁরা একটি কাপড়ে একশো দেড়শো টাকা মজুরি পান। চৈত্রমাসে একটু বেশি বিক্রিবাটা হয়। তাই তাঁতিদের আয় বাড়ে। এইসময় মহাজনও সারা বছরের প্রাপ্য মিটিয়ে দেন। এবার ওঁরা খুব কষ্টে আছেন। তাই যতটা পারছি ওঁদের সাহায্য করছি। বাবা বলতেন খদ্দের যেমন লক্ষ্মী, তেমন তাঁতশিল্পীরাও লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে কখনও অনাদর করতে নেই। নববর্ষের আয়োজনে তো অনেক টাকা খরচ হতোই, এবার না হয় সেই টাকা আমার তাঁতশিল্পীদের দেবো। কিছুটা তো সাহায্য হবে। আটাত্তর সালে যখন বন্যা হয়েছিল তখন বাবা বেশ কয়েকটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বাবার সময় নববর্ষের দিন খুব ঘটা করে পুজো হতো। রুপোর বড়ো বগি থালায় গণেশ ঠাকুরকে বসানো হতো। সকাল থেকেই বনেদি বাড়ির কর্তারা আসতেন গিন্নিদের নিয়ে। তখন আঁশ পাড়, মাছ পাড়, মেম ডুরে, আয়না চেক এইসব শাড়ির খুব কদর ছিল। গিন্নিমারা পছন্দ করতেন। কর্তারা টাকা দিতেন। সেই টাকা রুপোর থালায় গণেশের পায়ের কাছে রুপোর টাকা চাপা দিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল আমাদের। অতিথিদের গায়ে গোলাপ জল দিয়ে বরণ করা হতো। মিষ্টি শরবত মিঠে পান দিতাম। বাবা যেমন প্রত্যেকের বাড়ির কুশল সংবাদ নিতেন, ক্রেতারাও আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। একেবারে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন ক্রেতা বিক্রেতা।
একই কথার অনুরণন শোনা গেল পি সি চন্দ্র জুয়েলার্স-এর অন্যতম কর্ণধার শুভ্র চন্দ্রের কণ্ঠে। আগে প্রত্যেকে প্রত্যেককে পার্সোনালি চিনতেন। আন্তরিকতা ছিল ক্রেতা বিক্রেতার সম্পর্কে। এখনও যে সেই সম্পর্ক একেবারে নেই তা নয়। তাই নববর্ষের দিন তাঁদের প্রতিটি শোরুমে উপচে পড়ে ভিড়। যেন মিলন মেলা। বিকিকিনির পাশপাশি চলে কুশল বিনিময় মিষ্টিমুখ। সব থেকে বড়ো কথা বছরে এই একটা দিন তাঁদের গৃহদেবতা শ্রীসত্যনারায়ণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন শোরুমে। পুজো পাঠ হয়। এবার মহামারীর কারণে গৃহদেবতার পুজো বাড়িতেই হবে। তাঁর কাছে প্রার্থনা একটাই, জগৎ ও জীবনকে রক্ষা করো প্রভু। মুক্তির পথ দেখাও। এ বছর নববর্ষে উত্সবের আয়োজন করা গেল না ঠিকই, তবে আসছে বছর নিশ্চয়ই হবে।
কবির কথায় —
আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে,
আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে।