সম্প্রতি ‘দৃষ্টি এখন’ প্রযোজিত পোস্ট মডার্ন অ্যাবসার্ড নাটক ‘দ্য ডার্কনেস ডিগার’ মঞ্চস্থ হল মুক্তাঙ্গন প্রেক্ষাগৃহে অভিষেক দেবরায়ের রচনা ও নির্দেশনায়। নাটকে দুটিমাত্র চরিত্র, সুদীপ (পলাশ হালদার) ও শুভঙ্কর (নাট্যকার-নির্দেশক নিজে)। সুদীপ এক বিষণ্ণ, ব্যর্থ প্রেমিক, যে এক সময় প্রেমিকাকে ‘স্ত্রী’ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি নিজেরই অক্ষমতার কারণে। ফলে, প্রেমিকা পরস্ত্রী হয়ে যায়। সুদীপ একলা বসে বসে নিঃসঙ্গতার একমাত্র ‘সঙ্গী’ ধূমপানকেই আশ্রয় করে। সেই স্থানে একদিন হঠাৎই এসে পড়ে শুভঙ্কর। সে একজন সফল ব্যবসায়ী। কারণ, তার মোবাইলে কথা বলতে বলতেই সে ব্যস্ততার সঙ্গেই দর্শকাসনের ভেতর দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। হঠাৎই তার চোখ যায় নিরুত্তাপ, ধূমপানরত সুদীপের দিকে। অচেনা এই মানুষটির সঙ্গেই সে কথায় মেতে ওঠে। যদিও সুদীপের দিক থেকে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ পায় না। শুভঙ্করের কথার মধ্যে কিছু অস্থিরতা প্রকাশ পায় যেমন— ‘শিল্পী হতে গেলে ব্যবসায়ী হতে হয়’, ‘বেইমানি মিথ্যেবাদিতার ভণ্ডামির মধ্যে বেঁচে আছি মনে হয়’, ‘জীবনটা যেন গোলকধাঁধা একবার ঢুকে পড়লে বেরনোর উপায়ই থাকে না’ ইত্যাদি। এই সংলাপগুলি বলতে বলতে সে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সুদীপের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে খেতে থাকে। তারপর হঠাৎই শুভঙ্কর সুদীপকে খেলতে বাধ্য করে এক অদ্ভুত খেলা যার নাম ‘দ্য ডার্কনেস ডিগার’ যেখানে আলো পৌঁছয় না, মানুষের মনের সেইখানটা খুঁড়ে বার করতে চাওয়ার খেলা যে খেলার মজা হল শুভঙ্করের ভাষায়— ‘যে খেলায় আপনি জিতলে আমি আপনি, আমি জিতেলে আপনি আমি, দু’জনেই হারলে আপনি আপনি, আমি আমি।’ সুদীপের মনের অন্ধকার খুঁড়ে কিছু বের করার আগেই শুভঙ্কর নিজের মনের অন্ধকারে থাকা কথা নিজেই জানিয়ে দেয় সুদীপকে— তার স্ত্রীকে সে ভালোবাসে তবে সম্মান বা বিশ্বাস করতে পারে না যেহেতু তাদের প্রথম সন্তান জন্মের সময় সে জানতে পারে প্রাক্তন প্রেমিকের সন্তানকে এক সময় গর্ভপাত করিয়েছিল তার স্ত্রী। খেলার নিয়মানুযায়ী সুদীপকেও তো ‘খনন’ করতে হত শুভঙ্করের মন, তা কিন্তু সুদীপ করেনি। সে শুধু তার নিজের অক্ষমতার কথা জানায়, যে জন্য সে তার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারেনি। কিন্তু এটুকুর জন্য তাহলে এত আয়োজনের, ‘ডার্কনেস ডিগার’ খেলায় অংশ নেওয়ার কোনও দরকার ছিল কি? শেষমেশ তাই খেলাটি একপেশে হয়ে তাৎপর্যই হারিয়ে ফেলে। ‘অ্যাবসার্ড’ ড্রামার কিছু নিজস্ব পরিভাষা আছে—মানবজগতের দৃশ্যমান রূপকল্পকে অতিক্রম করে যেখানে এক অদৃশ্য অনুভবগ্রাহ্য জগতের সত্যকে প্রকাশ করা হয়। প্রত্যক্ষর মাটি থেকে দর্শক নিজেই আবিষ্কার করতে করতে অপ্রত্যক্ষের মানসলোকে যত পৌঁছতে থাকবে ততই অ্যাবসার্ড নাটক হয়ে উঠবে সার্থক।
মঞ্চটিকেও সক্রিয় সঙ্গত দিতে হয় এমনভাবে যেখানে থাকবে অব্যক্ত কোনও জগতে প্রবেশের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত! আলোর পরিকল্পনা হবে এমন যেখানে থাকবে ব্যঞ্জনা। প্রত্যাশা জাগিয়েও ‘দ্য ডার্কনেস ডিগার’ কিন্তু তেমন কোথাও দর্শককে পৌঁছে দিতে পারল না! নির্দেশক তিনটি বসার জায়গা ব্যবহার করেছেন। তার মধ্যে দুটিকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকেছেন, তৃতীয় বেঞ্চটি কিন্তু অনাবৃতই থেকেছে বাস্তব নাটকের মতোই প্রকট ভাবে। ‘অন্ধকার’ যেখানে এই নাটকে একটি ‘চরিত্র’ তাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কত অভিনব ভাবেই না আলোর পরিকল্পনা করা যেতে পারত! স্থানটিকে, মানুষের ধোঁয়াটে মনের উৎসস্থল বোঝানোর জন্য কি শুধু প্যাকেট ভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া ছড়ানোই একমাত্র রাস্তা ছিল? অভিনয়ে ‘পজ অ্যাকটিং’ ব্যবহার করার সময় দুই অভিনেতাই অযথা এত বেশি তাকে দীর্ঘায়িত করেছেন যে তাঁরা সংলাপ ভুলে গেছেন কি না এই সংশয় এক এক সময় দেখা দিচ্ছিল দর্শক মনে! তবে, অভিনয়ে দু’জনেই ছিলেন স্বচ্ছন্দ। পুরো নাটকটি জুড়ে দুটি চরিত্র কখনও বসে কখনও দাঁড়িয়ে সংলাপ বলে গিয়েছেন, কিন্তু এই একঘেয়েমি বা ‘মনোটনি’ কাটাতে তাঁদের ‘বাচিক’ অভিনয়ের পাশাপাশি যদি ‘আঙ্গিক’ অভিনয়েরও কিছু নিদর্শন পাওয়া যেত তাহলে ভালো লাগত। সেদিন প্রেক্ষাগৃহে দর্শক উপস্থিতির হারও অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ছিল।
চকিতা চট্টোপাধ্যায়