কর্মক্ষেত্রে অশান্তি সম্ভাবনা। মাতৃস্থানীয় কারও শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতি। প্রেমে সফলতা। বাহন ক্রয়-বিক্রয়ের যোগ। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় উন্নতি।প্রতিকার— ... বিশদ
তাপস সেন পৃথিবী বিখ্যাত আলোকশিল্পী, আলোর যাদুকর। থিয়েটার করতে আসার পর এই নামটা প্রায়ই শুনতাম। দূর থেকে তাঁকে দেখতাম.. শুনতাম তিনি খুব রাগী। সেটা ১৯৮৯-৯০ সাল, সুযোগ এল তাঁকে কাছ থেকে দেখবার। আমরা, অর্থাৎ নান্দীপট সেবার ‘শ্বেতসন্ত্রাস’ নাটক প্রযোজনা করবে, নির্দেশনা করবেন বিভাস চক্রবর্তী। বিভাসদা বললেন, এই নাটকে আলো করবেন তাপস সেন, তোমরা তাপসদাকে গিয়ে বলো। সেই প্রথম আমরা তাপসদার নাকতলার বাড়িতে গেলাম। কিন্তু নান্দীপট শুনে খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না, নাটকটিও তাঁর খুব একটা পছন্দ হলো না। উনি বললেন, দেখো আমরা যুদ্ধের ভয়াবহতা কী তা দেখিনি। তাই এ নাটক এখানে দর্শকদের ভালো লাগবে না। তবু, বিভাস (চক্রবর্তী) নির্দেশনা দেবে যখন, আমি কাজ করব। তবে আমি যেদিন যেদিন রিহার্সালে যাব, তোমরা আমার ড্রাইভারের কাছে গাড়ির তেলের টাকা দিয়ে দেবে। এছাড়া উনি কোনও পারিশ্রমিকের কথা বললেন না।
শুরু হলো মহলা... উনি অ্যাকাডেমিতে স্টেজ রিহার্সালে এলেন। আমাদের পরিশ্রম ও ব্যবহারে উনি কখন যেন আমাদের অভিবাবক হয়ে গেলেন। ওই নাটকে মঞ্চ ও পোশাকের দায়িত্বে ছিলেন মনু দত্ত। কিন্তু রিহার্সালের সময় মনুদার অনেক কাজই অসম্পূর্ণ ছিল। এদিকে আমাদের টাকা ও সময় চলে যাচ্ছে। উনি একদিন প্রচণ্ড রেগে গেলেন। বললেন, একটা কাগজ দাও তো। উনি ওখানে বসেই মনুদাকে চিঠি লিখলেন খুব কড়া ভাষায়... ‘এই ছেলেগুলো টাকা ধার করে বহু কষ্ট করে একটা ভালো কাজ করার চেষ্টা করছে, অ্যাকাডেমি ভাড়া নিয়ে রিহার্সাল দিচ্ছে, আমি, বিভাস বসে আছি আর তোমার দেখা নেই!!’ তারপরেই মনুদা তাড়াতাড়ি সব কাজ ফেলে আমাদের কাজ শেষ করলেন।
তারপর তখন ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ নাটক নেমে গেছে, চারিদিকে খুব প্রশংসা হচ্ছে, বেশ কিছু ‘কল-শো’ ও হচ্ছে। এই সময়, একদিন টিভিতে তাপস সেনের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান। সাক্ষাৎকারে উনি আমাদের সম্বন্ধে খুব প্রশংসা করলেন। সেটি আমাদের পরম প্রাপ্তি।
এর কিছুদিন পর শুনলাম তাপসদা অসুস্থ। দলের পাঁচুগোপালের বাইক ছিল। ওকে সঙ্গে নিয়ে একদিন খুব সকালে তাপসদার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। উদ্দেশ্য, তাপসদা তো আমাদের থেকে কোনও টাকা নেননি, এই সময়ে যদি কিছু টাকা ওনাকে দেওয়া যায়। বাড়ি গিয়ে দরজায় বেল বাজাতেই স্বয়ং তাপসদা দরজা খুলে দিলেন এবং ফিস ফিস করে বললেন ভেতরে আসতে। তখন বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। তাই কারোও যাতে অসুবিধা না হয় সেইজন্য একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে সদ্য বিদেশ থেকে আনা একটি বই পড়ছিলেন। আমরা কিছু বলার আগেই উনি ঐ বইয়ের পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে বিদেশে আলোর ব্যাপারে নতুন কী কী আবিষ্কার হয়েছে , তা বোঝাতে লাগলেন। কখন যে তিন ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে তা আমরা বুঝতেই পারিনি। সেদিন আমার আর অফিস যাওয়া হলো না, কিন্তু যা শিখলাম, তা আজও আমার চলার পথের পাথেয় হয়ে আছে। চলে আসার সময় যখন একটা খাম ওনার হাতে দিলাম, উনি বললেন- এটা কী? আমরা বললাম সামান্য কিছু টাকা আছে ওতে। আমরা এইটুকুই দিতে পারছি। তাপসদা খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমি কি তোমাদের কাছে টাকা চেয়েছি? কত কষ্ট করে তোমরা থিয়েটার করো আমি দেখিনি? আমরা বললাম শ্বেতসন্ত্রাস প্রযোজনা করে আমরা সব ধার মেটাতে পেরেছি। এই সামান্য টাকা আপনাকে প্রণামী হিসাবে দিচ্ছি। আর আপনার এখন শরীর খারাপ, এখন তো দরকার। তখন উনি সেই টাকা গ্রহণ করলেন। এই আমাদের তাপসদা।
উনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, তার একটা ঘটনা বলি। একদিন সকালে আমি বাজারে গিয়েছি। তখন তো মোবাইল ফোনের চল ছিল না। বাজার থেকে আসতে আমার স্ত্রী (রিংকু) বলল, তাপসদা ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিলেন, তুমি এখনই ওনাকে ফোন করো। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ফোন করলাম। উনি বললেন, ‘শোনো, তুমি তো জানো আমি নালন্দায় গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলো বিভাস (চক্রবর্তী), প্রণব বসু (ফোটোগ্রাফার) ও আরও দুজন। তা আসার সময় গাড়িতে আমার শরীর খারাপ হয়ে যায়। আমার বমি, পায়খানা হয়। কাপড়চোপড় সব নষ্ট হয়ে যায়। তারপর নতুন পাজামা, পাঞ্জাবি কিনে বাড়ি এসেছি। বুঝলাম তাপসদার শরীর খুব খারাপ। বললাম, আমি এখনই যাচ্ছি আপনার কাছে। উনি বললেন, ‘তুমি আসবে কী ! আমি এখনই বোম্বে যাচ্ছি, দুপুর ৩টেয় ফ্লাইট। এই হচ্ছে তাপসদা। কাজপাগল, সরল, সাধারণ এক মানুষ, যিনি বিশ্ববিখ্যাত আলোকশিল্পী।
আরও একবার। তাপসদার শরীর তখন খুব খারাপ, ক্যাথিটার নিয়ে চলতে হয়। ওনাকে মৌলালির কাছে একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন ওনার সারা শরীর স্ক্যান করতে হবে। আমি, জয় (তাপসদার ছেলে) আর সৌমেন রায়চৌধুরী নার্সিংহোম থেকে ওনাকে ‘ইকো’ –তে নিয়ে এলাম স্ক্যান করাবো বলে। ২টো বেজে গিয়েছে। উনিও বেশ কষ্ট পাচ্ছেন। বারবার আমাদের বলছেন, ‘আর কতক্ষণ?’ আমরাও স্টাফেদের তাড়া দিচ্ছি, কিন্তু দেরি হচ্ছেই। এরপর প্রায় ৩টের সময় তাপসদাকে স্ক্যান করাতে নিয়ে যাওয়া হলো। তার শরীর থেকে সমস্ত ফরেন এলিমেন্টস খুলে ফেলতে হবে। এমন কি ক্যাথিটারও। ওটা খুলতে উনি খুব কষ্ট পেলেন, চিৎকার করলেন, রাগ করলেন। অবশেষে স্ক্যান হলো। উনি তো তখন প্রচণ্ড উত্তেজিত কষ্ট পেয়ে। আমাদের খুব বকলেন, যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। বহু কষ্টে ওনাকে ঠান্ডা করে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসালাম। বললাম, চলুন, আপনাকে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়ে আসি। উনি বললেন, ‘না, আমি এখন যাবো না। আমাকে তোমরা অ্যাকাডেমিতে নিয়ে চলো। আজ নান্দীকারের ‘চোখ গেলো’ নাটকের দ্বিতীয় অভিনয়। এর আগের শো-তে লাইটের অনেক গন্ডগোল হয়েছে, সেগুলো ঠিক করতে হবে। আমি না গেলে চলবে না। যন্ত্রণা কাতর তাপসদা অ্যাকাডেমিতে এলেন, সমস্ত আলো ঠিকমতো অ্যাডজাস্ট করে, ভালো করে বুঝিয়ে তারপর নার্সিংহোমে ফিরলেন। এসব এখন ভাবাই যায় না। নাটকের প্রতি, কাজের প্রতি কী ভীষণ দায়িত্ববোধ! তাই তো তাঁর জগৎজোড়া নাম।
একবার নাট্য অ্যাকাডেমিতে আলোর বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণ শিবির হবে। প্রশিক্ষক তাপস সেন। সবাইকে আবেদন করার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। সেই বিজ্ঞাপন দেখে আমিও আবেদন করলাম। যথাসময়ে ইন্টারভিউতে ডাকা হলো। ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন কুমার রায়, বিভাস চক্রবর্তী ও তাপসদা স্বয়ং। আমাকে দেখে তাপসদা বললেন, ‘তুমি এসেছো কেন?’ আমি বললাম, শিখতে চাই। সত্যি কথা, নাটকের আলোর কাজ শেখার আমার খুব ইচ্ছে প্রথম থেকেই ছিল। নানা রকম প্রশ্ন হলো। সবশেষে বেশ কিছু পেইন্টিংয়ের ফোটো স্লাইড প্রোজেক্টরে দেখানো হলো এবং বলতে বলা হলো কোনটা কার আঁকা? বেশ কিছু পারলাম না। তখন উনি বললেন, নাটকে আলোর কাজ করতে হলে, বিশ্বের বিখ্যাত সব শিল্পীর আঁকা পেইন্টিং দেখা অভ্যাস করো। তাহলে বুঝতে পারবে কীভাবে কীভাবে লাইট দিয়ে স্টেজ ডেপ্থ বোঝান যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই ওয়ার্কশপ নাট্য অ্যাকাডেমি করতে পারলেন না। তাপসদা খুব রাগ করেছিলেন এই ওয়ার্কশপটা না হওয়াতে। উনি একটা মঞ্চ চেয়েছিলেন সাতদিনের জন্য, আর কিছু না। সেটা হলে আজ আমরা আরও খানিকটা শিক্ষিত হতে পারতাম। এইরকম শিক্ষক পেয়েও আমরা সেই সুযোগ হারালাম।
তাপসদার মতো শিক্ষক, সহানুভূতিশীল অথচ দৃঢ়চেতা মানুষ আজ বড় বিরল। তাপসদাকে আজ বড় প্রয়োজন।