বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রতি বছর কয়েকদিনের জন্য যাত্রাগানের আসর বসত। বিশেষ করে রথযাত্রার সময় হতো পালাগান। তিনি ছিলেন তখনকার পালাগানের বিশেষ অনুরাগী। তখন যাত্রাপালায় বদন অধিকারীর খুব সুখ্যাতি। তিনি দূতী সেজে আসরে এসে গানে গানে মানুষকে আনন্দে ভরিয়ে দিতেন। প্রতি বছর চাটুজ্জেদের বাড়িতে তাঁর ছিল বাঁধা আসর। বদন যখন নেচে নেচে গান করতেন তখন যাদবচন্দ্রের ছেলেরা তাঁর পাশে বসে সেই পালাগান উপভোগ করতেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ছেলেবেলায় তিনি শুনেছিলেন বদন অধিকারীর গান। বড় হয়ে শুনতেন বদনের শিষ্য গোবিন্দ অধিকারীর গান। সেই স্মৃতিকেই তিনি তাঁর উপন্যাসে অন্যভাবে এনেছিলেন। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে হরিদাসী বৈষ্ণবীর ছদ্মবেশে দেবেন্দ্র মেয়েদের অন্দরে গিয়ে গান শুনিয়ে আসত। কেউ বলতেন, গোবিন্দ অধিকারীর গান শোনাতে। আবার কেউ বা অনুরোধ করতেন গোপাল উড়ের গান শোনাতে। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় সেকালের যাত্রা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলি অনেকাংশে যাত্রার ইতিহাসকে ধরে রেখেছে।
বদন তখন বাংলাকে তাঁর পালাগানে মাতিয়ে রেখেছেন। তাঁর গান বাঁধার কেরামতি ছিল একেবারে অন্য ধরনের। অশ্লীলতা বিমুক্ত পালা রচনা করে তিনি এক সর্বজনীন আসরের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। নবরূপে তিনি আসরে আনলেন কালীয়দমন পালাকে। রাধা সেজে বদন গান ধরতেন—
‘কুঞ্জে কুঞ্জে বুলি বুলি বনফল আনিলাম তুলি,/ গাঁথিলাম হার মনের মতো সাজাইলাম থরে থরে। / সকলি হইল বৃথা, তারে এখন পাব কোথা / মনে ছিল কত কথা কহিতাম শ্যাম নটবরে।’
দুচোখ বয়ে যায় রাধিকার। কোথা শ্যাম, কোথা শ্যাম! দর্শকরা আকুল। তাঁরাও ভেসে যান চোখের জলে। আত্মহারা দর্শকরা কেউ পয়সা ছুঁড়ে দেন, কেউ গায়ের চাদর উপহার দেন। কোথাও কোথাও চিকের আড়ালে বসে পালা দেখতে দেখতে অভিভূত মেয়েরা হাতের চুড়ি, কানের দুল খুলে উপহার স্বরূপ ছুঁড়ে দিতেন বদনের দিকে।
বদন ছিলেন হাওড়ার শালিখার বাসিন্দা। অল্প বয়সেই দলের সঙ্গে থেকে থেকে মানুষের ভালোলাগার নাড়িনক্ষত্র সব রপ্ত করেছিলেন। বিরহ এবং ভাব সম্মিলনের বিভিন্ন গানে তিনি তাঁর ‘ওস্তাদী’ দেখিয়েছিলেন। বিদ্যাপতির মৈথিলি ভাষায় লেখা বহু পদকে ভেঙে তিনি সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে নবরূপে রচনা করেছিলেন।
বদনের মৃত্যুর পর তাঁর দলের হাল ধরলেন তাঁর ছেলে ক্ষেত্র। কিন্তু তিনি তেমন যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না। তাই বদন অধিকারীর দল আর বেশি এগতে পারেনি। তবে বদনের উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন তাঁর এক শিষ্য গোবিন্দ অধিকারী। তাঁর জন্ম মোটামুটি বাংলা ১২০১ থেকে ১২০৫ সালের মধ্যে। সুকুমার সেন মহাশয় তাঁকে সেই সময়কার একজন অগ্রগণ্য বলে উল্লেখ করেছেন। গোবিন্দ অধিকারী ছিলেন বৈরাগী। পাঠশালার শিক্ষা তিনি তেমনভাবে পাননি। কিন্তু অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আয়ত্ত করেছিলেন শাস্ত্র। ছেলেবেলায় সেই যে গানের দলে ঢুকে পড়লেন, আর তাঁর কোথাও যাওয়া হল না। বদনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে নিজেই তৈরি করেছিলেন নতুন দল। সেই দলের পালা দেখতে লোকে তখন দশ-বিশ ক্রোশ দূর থেকে হেঁটে চলে আসতেন। তিনি যখন জরি বসানো লাল শাড়ি আর গয়না পরে মেয়ে সেজে আসরে দাঁড়াতেন, তখন নাকি দর্শকরা দৃষ্টি ফেরাতে পারতেন না। গা ভর্তি গয়না পরে তিনি অভিনয় করতেন। শোনা যায়, সেসব নাকি আসল সোনার গয়না। দলের অন্য শিল্পীরা, যাঁরা মহিলার ভূমিকায় অভিনয় করতেন, তাঁরা পরতেন কলাপাতার গয়না। একবার তিনি আসরে নামার আগে মেক আপ করছিলেন। তখন হাতের বাউটি পরার সময় সেটির কাঠিটি যেন কোথায় ছিটকে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি মেক আপের জন্য তিনি স্থানীয় একটি ছেলেকে বললেন, ‘বাবা একটা ঝাঁটার কাঠি আনতে পারবি?’ ছেলেটি গিয়ে আসরের পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধাকে বলল, ‘ওরা একটা ঝাঁটার কাঠি চাইছে।’ সেকথা শুনে বৃদ্ধা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘বেরো এখান থেকে, ঝাঁটার কাঠি চাইতে এসেছে।’ ছেলেটি গিয়ে গোবিন্দ অধিকারীকে সেকথা জানায়। গোবিন্দ কোনওরকমে হাতের বাউটি পরে আসরে নামেন। সেদিন তাঁর গান শুনে আসরে বসে সেই বৃদ্ধা ঝরঝর করে কেঁদেছিলেন। তারপর পালা শেষ হলে বাড়ি থেকে একটি ঝাঁটা নিয়ে এসে সেটি গোবিন্দ অধিকারীর হাতে তুলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমায় ক্ষমা কোরো বাবাঠাকুর। আমি বুঝতে পারিনি। তুমি একটা কাঠি চেয়েছিলে। আমি তখন দিইনি। এখন পাশ্চিত্তির করলাম। তোমার হাতে পুরো ঝাঁটাটাই দিলাম।’
গোবিন্দ অধিকারীকে ঝাঁটা দিচ্ছে দেখে আসরে দর্শকরা হাঁ হাঁ করে উঠলেন। গোবিন্দ সকলকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা উতলা হবেন না। এ আমার পুরস্কার। এই ঝাঁটা প্রদানের মধ্যে কোনওরকম ব্যঙ্গ বা অশ্রদ্ধা নেই। এ হল এক গুণমুগ্ধের আন্তরিক পুরস্কার। আমি এটি আনন্দিত চিত্তে গ্রহণ করলাম।’
এর কয়েক দশক পরে আমরা দেখতে পাই, বাংলা রঙ্গমঞ্চের একেবারে গোড়ায় ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয়ের সময় দর্শকাসনে বসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফীর নীলকর সাহেবের চরিত্রে অভিনয় দেখে মঞ্চে তাঁর দিকে পায়ের জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। অর্ধেন্দুশেখরও গোবিন্দ অধিকারীর মতো বলেছিলেন, ‘এ আমার পুরস্কার।’
গোবিন্দ অধিকারীকে এমন কিছু আহা মরি দেখতে ছিল না। খুব দীর্ঘ তিনি ছিলেন না। গায়ের রং ছিল শ্যামবর্ণ। মাথার মাঝখানে ছিল টাক। পিছনে কিন্তু ছিল ঢেউ খেলানো বাবরি চুল। কিন্তু গলাটি ছিল সুমধুর। একবার তিনি আসরে গান করছেন, সেদিন দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত পাঁচালিকার দাশরথী রায়। আসর শেষে তিনি গোবিন্দের
গানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। গোবিন্দ বললেন, ‘আজ গলাটা বিশেষ সুবিধার ছিল না।’ সেকথা শুনে দাশরথী বলেছিলেন, ‘আপনার এই ভাঙা গলার কাছাকাছিও কেউ পৌঁছতে পারবে না।
আর একটি কাহিনী জানা যায়। সেদিন ছিল রথযাত্রার উৎসব। সেদিন রাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে গোবিন্দ অধিকারীর আসর বসবে। বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকজন বন্ধুও এসেছেন তাঁদের বাড়িতে। দুপুরে আলোচনার মধ্যে এক বন্ধু বললেন, ‘দুর দুর, বাংলাদেশের গান আবার শোনা যায় নাকি!’ বঙ্কিমচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এমন কথা বলছেন কেন?’ সেই বন্ধু বললেন, ‘ভালো গান গাইতে জানেন, বাংলাদেশে এমন কেউ আছেন নাকি?’
বঙ্কিমচন্দ্র সেকথা শুনে বললেন, ‘আপনি কীর্তন শুনেছেন?’ সেই বন্ধুটি বললেন, না, তিনি কীর্তন শোনেননি, তবে ভজন শুনেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে বললেন, ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন।’ এরপর তিনি একজনকে বললেন, সেখানে যেন গোবিন্দ অধিকারীকে ডেকে আনা হয়। একটু পরে গোবিন্দ সেই মজলিশে এসে উপস্থিত হলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তখন তাঁকে একটি গান গাওয়ার অনুরোধ করলেন। গোবিন্দ ভালো করে বসে গান ধরলেন, ‘প্রিয়ে চারুশিলে মুরু ময়ি মানমনিদানম..’ গান এগিয়ে চলে। বঙ্কিমচন্দ্র ভাবতন্ময় হয়ে চোখ বোঁজেন। অন্যরাও গানের দোলায় ভাসতে লাগলেন। আর সেই বন্ধু মুখের ভাব ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। অবিশ্বাস থেকে বিশ্বাসে, অশ্রদ্ধা থেকে ভালোলাগায় তিনি একটু একটু করে ডুবে যেতে লাগলেন। তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন না, কখন যে তাঁর দু চোখ বেয়ে নেমেছে জলের ধারা। গান শেষ হল। সেই বন্ধু হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে বললেন, ‘আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এখন স্বীকার করতে আমি বাধ্য যে এমন গান আমি কোনওদিন শুনিনি।’ তখন মুচকি হাসছেন বঙ্কিমচন্দ্র।
যাত্রায় গোবিন্দ অধিকারী একটি যুগ। যেমন খ্যাতি তিনি অর্জন করেছিলেন, তেমন পয়সাও রোজগার করেছিলেন। তাই দিয়ে একটি জমিদারিও কিনেছিলেন।
একসময় নিজের জন্মভিটে হুগলি জেলার খানাকুলের কাছে জাঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে চলে এলেন শালিখায়। তাঁর গুরুর বাড়ির কাছাকাছি বাস করতে লাগলেন। সম্ভবত ১৮৭২ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু রেখে গেলেন উত্তরাধিকার। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, ঢ্যামনা গোপাল, শ্রীবাস দাস, ভজরাম ঘোষ, গদাধর দাস প্রমুখ।
যাত্রার পাশাপাশি তখন কলকাতায় জেগে উঠছে নাট্য সংস্কৃতি। ইংরেজ ঘরানায় নাট্যমঞ্চ তৈরি করে অভিনয়ের ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। কিন্ত সেখানেও বিভিন্ন নাটকে দেখা গেল
যাত্রার প্রভাব। প্রাথমিক স্তরের মঞ্চ-নাটকের আখ্যানও ঋণী ছিল যাত্রার কাছে।