কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
অবশেষে টুটুলের লাগাতার সাধ্যসাধনার ফল ফলল। মেয়ে তানিয়া বিয়েতে রাজি হল। টুটুলের বিয়ে হয়েছিল বাইশে আর তানিয়ার বত্রিশ। তো? টুটুলের মায়ের তো ষোলোতে আর দিদিমার বিয়ে হয়েছিল পুতুল খেলতে খেলতে এগারোতে। এখন তো মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবে বিয়ের পিঁড়িতে বসা। টুটুলদের আমল হলে আত্মীয়দের কান-ফিসফিস খেলা চলত ‘আহা! কত বয়স হল, বিয়ে হচ্ছে না গো মেয়েটার।’ তানিয়ার বেলায় তারা সাহস পায়নি। টুটুল গ্যাঁটসে বলেছিল, ‘মেয়ে এখন বিয়ে করবে না।’ তানিয়ার ইনকাম বছরে ত্রিশ লক্ষ। তার মতামতের মূল্য আছে বইকি। আজকাল আবার মেয়েরা অবাঙালি বা বিদেশি পাত্রের দিকে খুব ঝুঁকছে। তানিয়ার অবশ্য বাঙালি ছেলেতেই আগ্রহ। লাভ ম্যারেজের ঠেলায় অধুনা বাপমায়েদের পাত্রপাত্রী নির্বাচনের হ্যাপা কমেছে কিন্তু টুটুল মহা গাড্ডায় পড়েছে। চেনাজানা এলিজিবল ব্যাচেলররা প্রেমের টোপে ফটাফট ইতিমধ্যে ছিপে গেঁথে গিয়েছে। কাগজের বিজ্ঞাপন আর বিয়ের সাইটগুলো ছেঁচেও মণিমুক্তো কিছুই জুটল না। তখনই করিতকর্মা তানিয়া ডেটিং অ্যাপে হবু জামাই সুনন্দকে আবিষ্কার করে ফেলল। সুনন্দরা পশ্চিমবঙ্গের সাহা। তানিয়ারা ময়মনসিংহের ব্রাহ্মণ। তানিয়ার তাতে কিছু যায় আসে না। অসবর্ণ আর ঘটি-বাঙালের বিয়ে তো এখন জলভাত। সুনন্দ সুদর্শন, ডাক্তার। বেশ স্মার্ট। পরিবারটি উচ্চশিক্ষিত, সেগুলোই আসল।
কনে-দেখার বিরক্তিকর পর্ব আজকালকার মেয়েরা এড়িয়ে যাচ্ছে। টুটুলকে তো কনে-দেখা সেশনে শো পিসের মতো যাচাই করা হয়েছিল। অতএব চলল তানিয়াদের বছরব্যাপী ডেটিং, চ্যাটিং, ভিডিওকল, পছন্দ-অপছন্দের আপডেট। মন জানাজানি শেষে টুটুল আর হবু শাশুড়িকে নিয়ে তানিয়া দিল খুলে এন্তার বিয়ের বাজার করে ফেলল। ইশ! টুটুলের বৌভাতের বেনারসিটার কী ভীষণ ক্যাটকেটে রং ছিল! তখন থোড়াই শাশুড়িরা হবু বউমাকে নিয়ে বিয়ের বাজার করতেন! তানিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গির বদলে বিয়ের রীতিতে পরিবর্তন আসছে। যেমন বিয়ের পর তানিয়া-সুনন্দ আলাদা ফ্ল্যাটে নিজেদের কেনা পছন্দের আসবাবে নতুন সংসার সাজাবে। মেয়েরা যদি পরিবার ছাড়তে পারে ছেলেরা কেন পারবে না? টুটুলরা ছিল জবুথবু, কলের পুতুল— তাদের গাদা গাদা পাশ বিয়ের কোয়ালিফিকেশন ছাড়া কোনও কম্মে লাগেনি। স্বাবলম্বী তানিয়া তো আর বরের উপর বোঝা হবে না! তানিয়াকে লেখাপড়া শেখাতেও পরিবারকে যথেষ্ট খরচ করতে হয়েছে। এর উপর কন্যাপক্ষের উপর পণ-যৌতুক, খাট-পালঙ্ক, দেনা-পাওনার চাপ? চলবে না। বুঝদার পাত্রপক্ষ মেনে নিয়েছে। তানিয়া মোটেই অকারণ গাদাগুচ্ছের কাপড়জামা কেনার পক্ষপাতী নয়। তাল তাল সোনায়ও রুচি নেই। ম্যাচিং জুয়েলারি যতটুকু মানানসই। অফহোয়াইট আর লাল জারদৌসি শাড়ি, ঘোমটা অবশ্য লালই পছন্দ। বাঙালি-অবাঙালি মিলেমিশে
কনের সাজ।
পরিণত তানিয়া নিজের পছন্দে বিয়ের প্ল্যানিংয়ের সিংহভাগ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। রোজগেরে মেয়ে নিজের শখ-আহ্লাদ পূরণে খোলা হাত। আগে বিয়েতে অবাঙালিদের মতো কাছা খুলে খরচ করার রেওয়াজ ছিল না। তাতেই বাবার উপর চাপ পড়ছে ভেবে টুটুল বিয়েতে লজ্জা-সঙ্কোচে গুটিয়ে ছিল। তানিয়ার সে দায় নেই। তাছাড়া ডিজিটাল পৃথিবীর অভিনব সব আইডিয়ার খোঁজ তানিয়ার একদম হাতের মুঠোয়। বিয়ের কার্ডের অর্ডার গেল বেঙ্গালুরুতে! ভাবা যায়? সবাই মিলে ঘরে বসেই অনলাইনে কার্ড পছন্দ, ক্যুরিয়ারে যথাসময় বাড়িতেই ডেলিভারি! অনলাইনে কার্ডের কী বৈচিত্র্য! যারা বিদেশে তাদের আবার ই-কার্ড পাঠানো হল। টুটুল ঘেমেনেয়ে বাবার সঙ্গে বউবাজার ঘুরে লাল-সোনালি পাল্কি আঁকা তার বিয়ের কার্ড কিনেছিল। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামক সংস্থাটির সঙ্গেও টুটুলের এই প্রথম মোলাকাত। এতে পরিশ্রমের ঝক্কি অনেকটাই কমল। অভ্যর্থনা থেকে শুরু করে নিমন্ত্রিতদের দেখভালের দায়িত্ব সবই ম্যানেজ করবে এরা। এরপর তানিয়া আর সুনন্দ মাতল যুগলে প্রি-ওয়েডিং সেশনের ছবি তোলায়। দু’জনে ক্ষণে ক্ষণে পোশাক পাল্টে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ভিডিও তুলল। বাপের জন্মে এমন কাণ্ড দেখেনি টুটুল। তবে দিশি আইবুড়োভাতের পাশাপাশি ব্রাইডাল শাওয়ারের মেমসাহেবিপনাটুকু মন্দ লাগেনি। দুই ডজন স্বদেশি-বিদেশি বন্ধু হুমড়ি খেয়ে তানিয়ার কোর্মা-কালিয়া, মুড়িঘণ্ট সাঁটানোর ছবি তুলল। টুটুলের বিয়েতে বন্ধু এসেছিল আঙুলেগোনা। তারপর তানিয়া আবার বায়না ধরল সঙ্গীতানুষ্ঠানের। বাপরে! সে কী নাচাগানা-খানাপিনা! ভাবী শ্বশুর, শাশুড়ির সঙ্গেও নাচল মেয়ে। জেঠুর গজগজানি, ‘যত্ত সব নর্থ ইন্ডিয়ান কালচার!’ বললে হবে? আজকাল বাঙালি-অবাঙালি মিলেমিশে খিচুড়ি বিয়ের এত বাড়বাড়ন্ত যে অনুষ্ঠানে ফিউশন অপ্রতিরোধ্য। মেনুতেও তো মোগলাই-পাঞ্জাবি-চীনা-বাঙালি পদের সহাবস্থান। দহি বড়া-ফুচকা-চাট পাশাপাশি এক লাইনে। হোটেলের মতো বুফে বা গোলটেবিল ঘিরে আড্ডা সহযোগে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। টুটুলের বিয়ের ভিয়েন, লম্বা রিকেটি টেবিল, নুন-লেবু, লুচি-বেগুনভাজা, দই-পান্তুয়া... ভ্যানিশ!
হাতেপায়ে জমজমাট মেহেন্দি এঁকে তানিয়া আবার মহিলা পুরোহিতের একটি দলকে বৈদিক মতে বিয়ের ভার দিয়ে জেঠুকে তাতিয়ে তুলেছে। কন্যা ‘সম্প্রদান’-এও তানিয়ার ঘোরতর আপত্তি। একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে এভাবে হাতবদল করার কনসেপ্টটা যথেষ্ট অপমানজনক। তার থেকে পাত্রপাত্রীর পারস্পরিক ‘আত্মনিবেদন’ ধরনের নতুন রীতির প্রবর্তন অনেক যুক্তিসঙ্গত ও যুগোপযোগী। তানিয়ার জেহাদ— বর গোত্র ছাড়বে না, ও কেন ছাড়বে? এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র প্রজাপতি ব্রহ্মাই বোধকরি জানেন! তানিয়া পদবি পরিবর্তনও করবে না। বড়জোর দু’টি পদবি থাকবে হাত ধরাধরি। উপরন্তু মেয়ের গোঁ, সম্প্রদান টুটুল করবে। জেঠু ফায়ার। টুটুল একে মহিলা, তায় বিধবা! মা নাকি মেয়ের বিয়ে দেখলেই অমঙ্গল! শুনে তানিয়ার কী অভিমান, ‘মায়ের চেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী আমার আর কে আছে? একাই তো পাঁচ বছর থেকে টেনেটুনে এত বড়টা করলেন মহিলা!’ মেয়ের গলা ধরে এলে জেঠু রণে ভঙ্গ দিলেন। বিয়ের আগে ম্যারেজ রেজিস্ট্রার এলেন। সইসাবুদের বিয়েটা আজকাল মাস্ট। টুটুলদের আমলে অগ্নিসাক্ষীই যথেষ্ট ছিল।
গায়ে হলুদের ‘থিমে’ নিমন্ত্রিতরাও হলুদ বস্ত্রে হলুদ ফুলে সেজেগুজে হইচই ফেলে দিল। লাল-হলুদ জামদানিতে, ফুলের অলঙ্কারে, খোঁপার কাঁটা, বিছা, নূপুরে অপরূপা তানিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত ভিডিওবন্দি হতে থাকল। মেকআপহীন, লাল পাড় কোরা শাড়িতে টুটুলের তো গায়ে হলুদের একটাই সাদাকালো ছবি সম্বল। মেয়ের বেলায় উঠোনের লাল-সাদা ম্যারাপ ভুলে প্রশস্ত, সুসজ্জিত হল ও ফুলের বাহারি গেট। পাশের লনে স্বপ্নিল লাইটিংয়ে স্ন্যাক্স আর মকটেলের লোভনীয় হাতছানি। সাশ্রয় ও সময়াভাবের জন্য দু’পক্ষ মিলে একটা বড় অনুষ্ঠানের চলও আজকাল হয়েছে। ভিডিওতে তানিয়ার ফেলে আসা জীবনের মনকেমন উপস্থাপনাও অভিনব। সত্যি বলতে, টুটুলের মনে হচ্ছে তানিয়াদের প্রজন্মের বিয়ে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল ও উপভোগ্য। সানাইয়ের সুরে, রজনীগন্ধার আবেশে, উলু, শঙ্খধ্বনিতে রাজেন্দ্রাণীর মতো দেখাচ্ছিল পার্লারসজ্জিত তানিয়াকে। টুটুলকে সাজিয়েছিল বড়দি। তখন কনে আর তত্ত্ব সাজানোর পারিবারিক দক্ষতার কদর ছিল। তানিয়ার তত্ত্বে পেশাদারি নিপুণতা।
সারাদিন নির্জলা উপবাসও করেনি তানিয়া। সাতপাকে পিঁড়ি চেপে নয়, হেঁটেই ঘুরেছে। গৌরীদানের আমলে শিশুকন্যাকে যে ভাবে ঘোরাত, আজকের পরিণত মেয়েরা সেটা পছন্দ করবে কেন? পুরোহিতরা বৈদিক মন্ত্রকে বাংলায় বিশ্লেষণ করে বিবাহিত জীবনের যৌথ দায়িত্ব ও ‘যদিদং হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম’-কে হৃদয়ে একেবারে গেঁথে দিলেন। টুটুলের বাবা নাকি মন্ত্র ঠিকঠাক বলতেই পারেননি, বোঝা তো দূরের কথা। অভ্যাগতদের ফুলবর্ষণে নববিবাহিতদের আশীর্বাদও অভিনব।
তানিয়া শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় মায়ের আঁচলে চাল ছোড়ার প্রসঙ্গে বেঁকে বসল। বলল, মায়ের ঋণশোধ করার চেষ্টা ধৃষ্টতা। টুটুল মনে মনে মেয়ের সাহসের প্রশংসা করল। টুটুল তো প্রতিবাদ করার কথা ভাবেইনি। মায়ের জন্য ‘দাসী’ আনার কথা তানিয়ার বর মুখেই আনেনি আর নববধূকে বরের পা ধুইয়ে প্রণাম করতেও কেউ বলেনি। মা-ঠাকুরমাদের মতো স্বামীর সঙ্গে বয়সের বিরাট ব্যবধান নেই। তাই স্বামীরা তানিয়াদের গুরুজন কম হন, বন্ধু বেশি।
শুধু কি তাই? তানিয়া আর বর পরস্পরের হাতে ভাতকাপড় তুলে দিয়ে ভরণপোষণের দায়িত্বও ভাগাভাগি করে নিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ জীবনযাপনের অঙ্গীকারে দাঁড়িপাল্লার ওজনে দু’জনেরই সমান সম্মান ও মর্যাদা পাওয়া উচিত।
আধুনিক প্রজন্মের স্বাবলম্বী, প্রাপ্তবয়স্ক, ব্যাক্তিত্বময়ী মেয়েদের বিয়ের আচারবিচারের পরিবর্তনের যৌক্তিক দাবিগুলি সমাজের মেনে নেওয়া দরকার। কারণ পুরনো কিছু কিছু ধারণার বিবর্তনের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে সভ্যতার অগ্রগতির মূলমন্ত্র!