গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
অটোরিকশায় ডিপ্লোম্যাটদের নম্বর প্লেট! এমনও হয়? হ্যাঁ রাজধানী দিল্লির রাস্তাঘাটে কিন্তু এমনটা দেখা যাচ্ছে প্রায়শই। কীভাবে? সেখানকার মার্কিন দূতাবাসের তিন মহিলা কূটনীতিক মজেছেন তিন চাকার জাদুতে। মাঝেমাঝেই তাই তাঁদের প্রিয় ‘টুকটুক’ (অটোর ডাকনাম) চোখে পড়ছে রাজধানীর রাজপথে।
অ্যান মেসন, শারিন জে কিটারম্যান এবং রুথ হোমবার্গ— তিন মার্কিন মহিলা কূটনীতিক কিনে ফেলেছেন তিনটি অটো। স্টিয়ারিং কিন্তু তাঁদেরই হাতে। ভারতের রাজধানী শহরের ঐতিহ্য হাতেগরম চেখে দেখার জন্য এই অভিনব পথই বেছে নিয়েছেন তাঁরা। আর শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়, রোজকার যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবেও টুকটুক-ই ব্যবহার করছেন তাঁরা।
অ্যান তাঁর নিজের টুকটুকের নাম দিয়েছেন কিট। গত দু’বছর ধরে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এই অটো ব্যবহার করছেন তিনি। আর পছন্দমতো এটা-ওটা নানা সুন্দর জিনিস দিয়ে সাজিয়ে নিয়েছেন নিজের বাহনকে। ‘পুরো ব্যাপারটাই এখন খুব ঝলমলে,’ হাসতে হাসতে বলেন অ্যান। তাঁর মিশকালো অটোর সাজগোজ দেখে তাক লেগে যায়। অটোর দু’দিক দিয়েই দরজা রয়েছে। সিট-এর দু’ধারে ঝোলানো রয়েছে চিতাবাঘের চামড়ার ছাপওয়ালা লম্বা পর্দা। স্টিয়ারিংয়ের কাছাকাছি নিজের সুবিধার জন্য একটা ফ্যান লাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। শত হলেও দিল্লির গরম বলে কথা! অটোর মাথার দিকে আছে পোর্টেবল ব্লুটুথ স্পিকার। অটোর চাকা এগলে দিলখুশ করা গান বাজে অন্দরে। ‘কখনও যদি আমার অটোয় আরও কেউ চড়েন, সে কথা ভেবে রেখেছি ছোট টিস্যু বক্সও। আর ফোন-হোল্ডার তো আছেই। ম্যাপ ছাড়া আমি হারিয়ে যাব!’ হাসতে হাসতে বলেন মেসন।
অন্য কূটনীতিক শারিন জে কিটারম্যান আবার তাঁর অটোরিকশার বাইরের সাজসজ্জা নিয়ে বেশি ভেবেছেন। তিনি ঘুরে বেড়ান একটা মিষ্টি গোলাপি অটো নিয়ে যার সারা গায়ে ছোট ছোট ফুল আঁকা। এমনিতে গোলাপি নাকি শারিনের প্রিয় রঙের তালিকায় নেই। কিন্তু গোলাপি অটো দেখে কেমন যেন মনটা ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ওটাই চোখ টেনেছিল সবকিছুর মধ্যে। তাই আর দেরি করেননি সেটিকে আপন করে নিতে। তাঁর কথায়, ‘গোলাপি রংটা যেন আমার সঙ্গে কথা বলছিল। আমার মনমতো গোলাপি রংটা পাওয়ার জন্য তাই আমায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল।’
শারিন কিটারম্যানের পিঙ্ক অটো রাস্তায় বেরলে চোখে পড়তে বাধ্য। তাঁর অটোর দু’ধারে রয়েছে রংবেরঙের ট্যাসেল। উইন্ডশিল্ডে আটকানো রয়েছে আমেরিকা এবং ভারতের পতাকা, একেবারে পাক্কা কুটনীতিকের স্টাইলে। শারিন বলেন, ‘একটা ছোট্ট যান, কিন্তু তাকে অবহেলা করতে পারবে না কেউ। কূটনীতিক হলেও আমি চাইতাম একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে। আর একজন নারী হিসেবে বলতে পারি এটা একটা অন্যরকমের স্বাধীনতা।’
রুথ হোমবার্গ অটোরিকশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে হেঁটেছেন চিরাচরিত পথে। কালো-হলুদরঙা বাহন তাঁর। রংচঙে ঝকঝকে ব্যাপারস্যাপার থেকে তিনি কিছুটা দূরেই। তবে এ যানকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে কোনও ব্যত্যয় হয়নি। গত এক বছর ধরে দিল্লির রাস্তায় ছুটছে তাঁর তিন চাকা। রুথ বলেন, ‘অটো নিয়ে এইভাবে যেতে বেশ মজা লাগে। আর ড্রাইভ করতে আমি এমনিও ভালোবাসি। এখানে ব্যস্ত ট্র্যাফিকের মধ্যে ফাঁক গলে বেরতেও দিব্যি লাগে। জ্যাম পেরিয়ে এগিয়ে যেতে অটোরিকশার জুড়ি মেলা ভার। খুবই নির্ভরযোগ্য এবং সুবিধেজনক যান।’
ভিড়ের মধ্যে গলে বেরিয়ে গিয়ে অটো চালানোর মজা যেমন আছে, তার সঙ্গে এই কূটনীতিকদের কাছে উপরি পাওনা, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ। গাড়িতে গেলে যে সুযোগ কোনওভাবেই পাওয়া যেত না। উৎসাহে ফুটতে থাকা শারিন যেমন বলেন, ‘আমার অটোর গোলাপি রং তো লোকজনের চোখে পড়েই। একবার এক থ্রি-স্টার আর্মি জেনারেল তাঁর গাড়ির জানলার কাচ নামিয়ে আমায় হাত নেড়েছেন। আর একবার অ্যান্টিক সিলভার একটা অ্যাম্বাসাডরের এক যাত্রী আমার অটো দেখে কাছে এসে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘দেখতে এলাম কে চালাচ্ছে এই সুন্দর অটোরিকশা!’ তাই হাত নেড়ে অভিবাদন, হাততালি আর নানারকম প্রশ্ন— সব সঙ্গে করেই চলছে তিন ইয়ারি অটো। মেসন যেমন বলছিলেন, ‘অনেক সময় বহু মানুষ আমাদের দিকে ফিরে ফিরে দেখেন। কেউ কেউ চলে আসেন একটু অটো চড়বেন বলে! বাধ্য হয়ে বলতে হয়, না চড়া যাবে না। তাতে একটু ধন্দে পড়ে যান অনেকে, অনেকে আবার হাসতে শুরু করেন। আমার তখন মনে হয় আমাদের কি খুব মজার লাগছে দেখতে!’
হোমবার্গও উৎসাহীদের নজর আর প্রশ্নের মুখে পড়েছেন অসংখ্যবার। তিনি জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘ট্র্যাফিক সিগন্যালে একদিন আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন ওঁরা। সিগন্যালে অনেকে নানা জিনিস বেচতে এগিয়ে আসেন গাড়ির দিকে। তাঁরা সবাই এগিয়ে এসে কথা বলেন। জানতে চান, কেন আমি অটো চালাচ্ছি, আমার ভালো লাগছে কি না, বা এটা কি খুব কঠিন কাজ— এসব নানাবিধ প্রশ্ন! বেশ ভালোই লাগে দিল্লির পথচলতি এমন আলাপচারিতা।’ কিন্তু দিল্লির যানজটে অটো চালানো সত্যিই বেশ কঠিন একটা কাজ নয় কি? অ্যান কিন্তু এতদিনে কৌশলটা বুঝে গিয়েছেন। তিনি জানেন, দিল্লির রাস্তা হর্ন বাজানোর ভাষাটা খুব ভালো বোঝে। তাঁর কথায়, ‘ট্র্যাফিকের একটা ছন্দ আছে। একটা হর্ন জানান দেয় আপনি কোথায় আছেন, আর একটা বলে আপনি সেই জায়গার অংশ কি না...। সেই ভাষা বুঝে নিয়ে ছন্দ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’ হর্ন বাজানোর পক্ষপাতী হোমবার্গও। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমার ট্রিক জানতে চান? খুব করে হর্ন দিই। কখনও এইটা বোঝাতে যে আমার বাহনটা খুবই ছোট্ট। কখনও আবার আমার আশপাশের হর্ন থেকে বুঝতে পারি যে ওঁরা আমার কাছেই আসতে চাইছেন। আমি ওঁদের দিকে তাকিয়ে হাসি, ওঁরা হ্যালো বলেন। আমেরিকার থেকে পুরো ব্যাপারটাই আলাদা এখানে। ওখানে তো হর্ন দেব, এটা ভাবতেই পারি না!’
মজা থাকলেও ছোট্ট তিন চাকা নিয়ে যানজট কেটে বেরিয়ে আসা কি চাট্টিখানি কথা? তারপর চারপাশে যদি থাকে বিশাল বিশাল চার চাকার দাপট। মাথা ঠান্ডা রেখে এগনো বেশ বড়সড় চ্যালেঞ্জ। শারিন বলেন, ‘আমি আশপাশে বড় বড় গাড়ি দেখে ঘাবড়ে যাই না। বড় বড় ট্রাকের মাঝখান দিয়ে গলে ঠিক বেরিয়ে আসি।’ নিজের দেশে মানে মার্কিন মুলুকে ছোট্ট প্লেন চালানোর দক্ষতা রয়েছে তাঁর পকেটে।
তবে ভারতের মতো দেশে কূটনীতিকরা সাধারণ মানুষের যান অর্থাৎ অটোরিকশা বেছে নিয়েছেন শুধুই মজা করতে, এমনটা ভাবলে ভুল করবেন। তাঁরা চান একটা বার্তা দিতে। অ্যান বলেন, ‘আমার জীবনের একটা বড় লক্ষ্য নারীর ক্ষমতায়ন। আমার দুই মেয়ে। একজন আমার সঙ্গে দিল্লিতেই থাকে। ও আমার মতো অটোটা নিয়ে চালায় মাঝে মাঝে। এটা নিয়ে কোনও প্রশ্নই ছিল না। ও যখন অটো নিয়ে বেরয়, ওর বয়সি মেয়েদের দেখায়, আমার খুব ভালো লাগে, গর্ব অনুভব করি। আমি যদি চালাতে পারি, ও কেন পারবে না?’