যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
দুর্গাপুজোর রীতি ও পদ্ধতিগুলো আমরা পুরাণ পরবর্তীকাল থেকেই খুঁজে পাই। এবং সেখানে আমরা দেখি ষষ্ঠীর দিন যখন বেলগাছের তলায় দেবী দুর্গার বোধন হয় সেখানে নবপত্রিকা রাখা থাকে। হলুদ সুতো ও শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে ন’টি গাছের কাণ্ডকে একত্রিত করা থাকে। তাকেই দুর্গার প্রতীক হিসেবে মানা হয়। কিন্তু কেন নবপত্রিকাকে দুর্গার প্রতীক রূপে ধরা হয় তার বিশ্লেষণ করতে গেলে নবপত্রিকার মূলে যেতে হবে, জানালেন পুরোহিত নন্দিনী ভৌমিক। তিনি বললেন, ‘এখন আমরা এই নবপত্রিকাকে কলাবউ নামে চিনি। তারও আবার একটা কারণ রয়েছে, যে ন’টি গাছের উল্লেখ নবপত্রিকায় করা হয়েছে তার মধ্যে কলাগাছটিই সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য বলে একে কলাবউ বলা হয়। কিন্তু আসলে কোন কোন গাছ নবপত্রিকার মধ্যে রয়েছে তা একটু না জানলে দেবী দুর্গার সঙ্গে নবপত্রিকাকে মেলানো যাবে না।
নবপত্রিকা অর্থাৎ, কলা, হলুদ, জয়ন্তী (জায়ফল), বেল, ডালিম, অশোক, মান, ধান, কচু। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝবেন এই যে ন’টি গাছের সঙ্গে একটা সুষম আহারের যোগ রয়েছে। ধান অর্থাৎ ভাত। এছাড়া আছে দু’টি সব্জি— কচু ও মানকচু। এই দু’টির মধ্যে আয়রন বেশি আছে বলেই হয়তো এই দু’টিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে যে এই দু’টি গাছের খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি হয় বলেও এদের ধরা হয়েছে। তারপর রয়েছে দু’টি মশলা হলুদ ও জায়ফল। সেক্ষেত্রেও কিন্তু একটা সমতা বজায় রাখা হয়েছে। হলুদ বাঙালির সব রান্নাতেই ব্যবহৃত হয়। পুরাণের যুগ থেকেই আমরা তাকে অ্যান্টিসেপ্টিক বলেও মানি। আর বাঙালির মুখে সুস্বাদু খাবার একটু বেশিই রোচে। তাই অন্য মশলাটি জায়ফল। তারপর কিছু ফলের কথা দেওয়া রয়েছে, কলা, বেল ও ডালিম। এই ফলগুলো সবই আমাদের শরীরের পক্ষে খুব উপকারী। বিশেষত ডালিম মহিলাদের জন্য বিশেষ উপকারী বলে ধরা হয়, কারণ এই ফল খেলে রক্তবৃদ্ধি হয়। এবং সবশেষে অশোকের কথায় আসা যাক। সুষম আহার খাওয়ার পরও যদি কারও কোনও ঘাটতি থাকে, কোনও অসুখ করে তাহলে অশোক রাখা হয়েছে, যা সর্বরোগরহিতা। এই গাছটি ঔষধির কাজ করে। তাই এই নবপত্রিকার মধ্য একটা সুষম আহারের সমাহার পাওয়া যায়। এবং সেই কারণেই একে মা দুর্গার সঙ্গে এক করা হয়। মা যেমন আমাদের সব দুঃখ, শোক নাশ করেন, আমাদের ভালো রাখেন ঠিক তেমন ভাবেই নবপত্রিকাও আমাদের আগলে রাখে। আর সেই কারণেই নবপত্রিকাকে দেবী দুর্গা আখ্যা দেওয়া হয়।’
এখন প্রশ্ন হল শ্বেত অপরাজিতা দিয়ে নবপত্রিকাকে বাঁধা হয় কেন? এই বন্ধনের সঙ্গেও কিন্তু দেবীর অন্তরঙ্গ যোগ রয়েছে। অপরাজিতা ফুল ও লতা শিব এবং দুর্গার অত্যন্ত প্রিয় হিসেবে বর্ণিত, জানালেন নন্দিনী। তিনি বললেন, নীল অপরাজিতা ফুলকে নীলকণ্ঠও বলা হয়। শিবের নামেই তার নামকরণ। আর সেই ফুলেরই আর এক ধরন শ্বেত অপরাজিতা। তার সঙ্গেও দেবী দুর্গার যোগ রয়েছে। দুর্গাপুজোয় অপরাজিতা ফুল লাগে। দশমীতে অপরাজিতা পুজো হয়। ফলে দেবী দুর্গা এবং অপরাজিতা ফুল ও লতা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এই লতাটি নবপত্রিকা বাঁধার জন্য ব্যবহৃত হয়। আর হলুদ সুতোর ব্যবহারের তাৎপর্যও রয়েছে। আমাদের ধর্ম অনুযায়ী মঙ্গলদায়ী রং এটি। বিয়ের কার্ডে আগেকার দিনে হলুদের ফোঁটা লাগানো হতো। বিয়ের আচারের অন্যতম গাত্রহরিদ্রা বা গায়ে হলুদ। ফলে এই রংটি আমাদের ক্ষেত্রে শুভ। এছাড়াও হলুদ স্বাস্থ্যের প্রতীক। ফলে তার ব্যবহার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এবার সপ্তমীর কথায় এলেন নন্দিনী। এখনকার রীতি অনুযায়ী সপ্তমীর সকালে কলাবউ স্নান একটা বড় অনুষ্ঠান, বললেন তিনি। আসলে দেবীর মহাস্নান দুর্গাপুজোর একটা বড় অংশ। তা রোজকার পুজোপদ্ধতির মধ্যেই রয়েছে। সেভাবেই নবপত্রিকা স্নানও দুর্গাপুজোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিটি গাছের জন্যই আলাদা স্নান মন্ত্র রয়েছে। জলশঙ্খ দিয়ে নবপত্রিকার স্নান করানোর সময় সেই মন্ত্র পড়া হয়। তবে এখন অবশ্য পুরোটাই কলাবউ স্নানে রূপান্তরিত। স্নানের পর নবপত্রিকার একটু সাজগোজেরও উল্লেখ রয়েছে পুরাণ পরবর্তী বিভিন্ন গ্রন্থে। দেবী দুর্গাকে তো আমরা কন্যা রূপে আরাধনা করি, বাড়ির মেয়েকে যেমন সাজানোর রীতি থাকে ঠিক তেমনই নবপত্রিকার সাজের উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং এই যে সাজ এটা কিন্তু বিবাহিত বউয়ের মতোই সাজ। তাতে লাল পাড় শাড়ি, ঘোমটা সবই দেখা যায়। আর যেহেতু কলাগাছটাই এই নবপত্রিকার মূল ও একমাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেহেতু তাকে লাল পাড় শাড়ি পরিয়ে সাজানোর মাধ্যমে বউয়ের আদল দেওয়া হয়। সেটাই বাঙালি রীতি মতে কলাবউ। এটা সম্পূর্ণ লোকাচার। নবপত্রিকা কিন্তু আদৌ গণেশের বউ নয়। পুরাণ পরবর্তী মত অনুযায়ী এটি ন’টি গাছ যাদের দেবীর পাশে রাখা হয় পুজো দেওয়ার জন্য। এবং নবপত্রিকা দেবী দুর্গা বলেই এই পুজো দেওয়ার রীতি উল্লেখ করা হয়েছে। মা আমাদের পুষ্টিদাত্রী, আর সেখানেও গাছের সঙ্গে মায়ের একটা বড় মিল রয়েছে। গাছ থেকেই যেহেতু আমরা পুষ্টি পাই, তাই তাকেই দেবীমাতৃকা রূপে পুজো করা হয়। পুজো চলাকালীনও কিন্তু নবপত্রিকার আলাদা আলাদা পুজো রয়েছে। প্রতিটি গাছকে দেবী দুর্গার এক এক রূপ হিসেবে কল্পনা করে পুজো করা হয়। কলা গাছে রয়েছেন ব্রহ্মাণী, হলুদ গাছে রয়েছেন দুর্গা, জয়ন্তী গাছে রয়েছেন কার্তিকী, বেল গাছে রয়েছেন শিবা, ডালিম গাছে রয়েছেন রক্তদন্তিকা, অশোক গাছে রয়েছেন শোকরহিতা, মান গাছে রয়েছেন চামুণ্ডা, ধান গাছে লক্ষ্মী এবং কচু গাছে রয়েছেন কালিকা। দুর্গার এই ন’টি রূপ কল্পনা করা হয় বলেই নবপত্রিকা সাক্ষাৎ দুর্গা। পুজোর প্রতিদিন যতবার দেবী দুর্গার ষোড়শোপচার পুজো হয় ততবারই নবপত্রিকার পঞ্চোপচার পুজো হয়। দীপ, ধূপ, গন্ধ, পুষ্প ও নৈবেদ্য সাজিয়ে সেই পুজো করার রীতি রয়েছে। সেটা নবমী পর্যন্ত করা হয়।
নবপত্রিকার এই যে কলাবউ হয়ে ওঠা, সেটা ঠিক কবে এবং কেন তা সঠিক বলা যায় না, জানালেন নন্দিনী ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘কলাবউ নিয়ে একটা অনুমান শুধু করা হয়। বাঙালির দুর্গাপুজোর সূচনা তো জমিদারদের হাত ধরে, সেখানেই নবপত্রিকা থেকে কলাবউয়ের রূপান্তর বিশেষভাবে চোখে পড়ে। কলাগাছ সবচেয়ে বড় এবং কলাপাতা একটু নুইয়ে থাকে। অনেকটা ঘোমটা দেওয়া নববধূর মতো। সেই থেকেই কলাবউয়ের প্রচলন। আর যেহেতু নবপত্রিকা গণেশের পাশে, দেবী দুর্গার ডান দিকে অবস্থান করেন, তাই হয়তো গণেশের বউ হিসেবে তাকে কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে। এটা একটা ভ্রান্ত অভ্যাসও বলা যেতে পারে।’ দুর্গাপুজো ঘিরে বাঙালিরা একটা ঘরোয়া আবহ তৈরি করেছি। দুর্গা আমাদের বাড়ির মেয়ে। পুজোর চারদিন সে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসে, ছেলেমেয়ে নিয়ে। এই যে পারিবারিক একটা চিত্র, এর সঙ্গেও কলাবউ দারুণ খাপ খেয়ে গিয়েছে। আর সেই কারণেও হয়তো আমরা নবপত্রিকাকে কলাবউয়ে রূপান্তরিত করতে দ্বিধা করিনি। এর মধ্যে একটা আদুরে ব্যপার আছে। দুর্গাপুজো বাঙালির মিলন উৎসব। পারিবারিক মিলনক্ষেত্র তৈরি হয় দুর্গাপুজোকে ঘিরে। সারা বছর যে যেখানেই থাকুক না কেন, পুজোর সময় সকলে একত্রিত হয়। এই যে মিলনোৎসবের আবহাওয়া সেখানেও মায়ের এই চার সন্তান এবং পুত্রবধূ নিয়ে মর্ত্যে বিরাজ করাটা যেন ভীষণ মানানসই হয়ে গিয়েছে। এইসব কারণেই হয়তো নবপত্রিকা আমাদের কল্পনায় কলাবউ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে একটা আকর্ষণ, একান্নবর্তী পরিবারের প্রতি আমাদের ভালোবাসা সবকিছুই যেন জড়িয়ে রয়েছে। তবে এগুলো সবই আমাদের অনুমান মাত্র। এর কোনও প্রমাণ কিন্তু আমাদের কাছে নেই।
দুর্গাপুজোর মাধ্যমে বাঙালি জীবনে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। মহামিলনের উৎসব এই পুজো। এর মধ্যে দিয়েই আমরা মাতৃ আরাধনা করি। দেবী দুর্গার রূপমাধুরী আমাদের মনে আনন্দ জাগিয়ে তোলে। একই সঙ্গে নিজেদের সমর্পণ করি মায়ের পায়ে। যিনি আমাদের রক্ষা করেন, আমাদের দুঃখ দূর করেন, সব অসুখ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন, তিনিই তো দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী।