যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
খোলা চুল, শাঁখা সিঁদুর— আর পাঁচজন বাঙালি গৃহিণীর সঙ্গে কবিতার পার্থক্য নেই। পার্থক্য নেই সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলির গৃহবধূদের সঙ্গেও। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ নিয়ে তাঁদের বাস। সংসারে নিত্য অভাবের আনাগোনা। এর মধ্যেও যখন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যকে বাঘে ধরে, তখন দৈনন্দিনের লড়াই আরও কঠিন হয়ে যায়। ঠিক যেমন হয়েছে কবিতারও।
বাঘের খপ্পরে
বাংলাদেশের মেয়ে কবিতা। বিয়ের পর স্বামী খগেন মণ্ডলের সঙ্গে চলে আসেন ঝড়খালি। সে প্রায় ২৫ বছর বা তারও আগের কথা। সেসব আর ভালো করে মনেও পড়ে না তাঁর। বছর চারেক আগে খগেনকে বাঘে ধরে। নদীর ধারে জাল ফেলে মাছ ধরতেন খগেন। আর তাতেই এল বিপদ। ‘বিয়ের পর প্রথম এখানে এসে ভয় ভয় করত। বাঘে ধরা লোককে দেখতে গিয়েছি কতবার! তখন পাকা রাস্তাও ছিল না। মাটির রাস্তা। বাঘ খাঁচায় ধরেছিল, দেখেছি। খাঁচার ভিতর থেকেই থাবা মেরেছিল একটা ছেলেকে। আমার স্বামী নদীর সাইডে মাছ ধরার জন্য ফাঁস ফাঁস জাল পাতত। সেই জাল পাততে গিয়েই বাঘে ধরেছিল। সেদিন ছয়জন লোক ছিল। ওকে ছেড়ে দিল। ভাগ্যের ব্যাপার! আর একজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেদিনই। যাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার বউ ছিল না। একটা মেয়ে আর একটা ছেলে ছিল। বউ আগে মারা গিয়েছিল। ছেলেটা বাংলাদেশে আছে, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে’, পড়ন্ত বিকেলে দাওয়ায় বসে সেদিনের ঘটনা শোনাচ্ছিলেন কবিতা।
সংসার সীমান্তে
বহু ধার দেনা করে খগেনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন কবিতা। কিন্তু পরিবারের একমাত্র রোজগেরে অচল হয়ে পড়লে সংসার তো চলে না। দু’বেলা খাওয়াও জুটত না তাঁদের। কোনওদিন রোজগার করবেন, এমনটা ভাবেনইনি কবিতা। বাধ্য হয়ে রোজগারের সন্ধানে বেরতে হয় তাঁকে। ‘সরকার থেকে কিছু দিয়েছে। গ্রামের লোকের থেকে ধার নিয়েছি। ওরা বলল, ‘ঋণ কী করে শোধ করবা? চোখে তো দেখতি পায় না স্বামী।’ আমাকে এটাও বলল, ‘চলো দুটো রান্না করতে তো পারবা। দুটো পাতা তো তুলে দিতে পারবা’। খগেন কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর গত দু’বছর ধরে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলে মিড ডে মিলের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন কবিতা। দুই মেয়ে এক ছেলে দম্পতির। বড়মেয়ে বিয়ের পর সোনারপুরে থেকে লোকের বাড়ি কাজ করে। তার ছেলে অর্থাৎ নাতি থাকে কবিতার কাছে। ছোট মেয়ে স্নাতক স্তরের পড়া শেষ করেছে। ‘একটু সুস্থ হওয়ার পরে উনি বাইরে চাষের কাজে যান। টুকটাক ওতেই যা চলে। আর আয় করার লোক নেই। ছেলের বিয়ে দিলাম। বউ নিয়ে হাঁটা দিল। আমার স্বামী এক চোখে দেখে না। আমি বলি ধার শোধ হওয়া পর্যন্ত কাজ করো, তারপর বসে খাবে,’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে কবিতার।
বাড়ির পাশেই খাল। তারপরই বিদ্যেধরী নদী। নাতিকে নিয়ে একাই ঘর আগলে থাকেন, বাঘের ভয় করে না? ম্লান হেসে জবাব দিলেন, ‘এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখন আর কোনও অসুবিধে হয় না। আগে বাঘ নদীর দিক দিয়ে উঠত। এখন আর ওঠে না। মানুষজন বসবাস করছে তো। বাঘ এখন কম আসে।’
নতুন জীবন
সত্যিই তো, ভয় পেলে চলবে কেন? শিয়রে শমন যাঁদের, বাঘের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা তো তাঁদের বেঁচে থাকার আর এক নাম। কুলতলি থানার অন্তর্গত ভুবনেশ্বরী পঞ্চায়েতের ভুরভুরিয়া গ্রামের জ্যোৎস্না শী তেমনই এক সাহসিনীর নাম। কবিতার মতোই সাধারণ ঘরের বউ। সাহসে ভর করে তিনিই স্বামীকে দিয়েছেন নতুন জীবন।
বাঘের সঙ্গে কুস্তি
২০২১-এর ৩ এপ্রিলের কথা বলতে গিয়ে এখনও জ্যোৎস্নার গলা কেঁপে ওঠে। বাঘের সঙ্গে খালি হাতে কুস্তি করে স্বামী শঙ্কর শীকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। ‘সেদিন ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। শনিবার ছিল। নৌকো দাঁড় বেয়ে এক, দেড় ঘণ্টা যেতে হয়েছিল। কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলাম। কাঁকড়া ধরার জাল ফেলে দিয়েছি নৌকোতে বসে বসেই। ছোট্ট খাল। উনি বললেন, তুমি নৌকোয় বসে থাকো। আমি গিয়ে দেখে আসি কেউ যদি ওখানে জাল ফেলে, সেদিন তাহলে আর আমাদের কাঁকড়া হবে না। আমি বললাম, দাঁড়াও, আমি তোমার সঙ্গে যাব। উনি তখন সামনে সামনে গেলেন, আমি পিছনে। খানিকটা গিয়ে বললেন, চলো কেউ মনে হয় ফেলেনি। আমরা তাহলে খালে জাল ফেলি। আমরা জাল নিতে ফিরছি, উল্টো হয়ে। আমি তখন সামনে, উনি আমার পিছনে পড়ে গিয়েছেন। তখন জঙ্গলের ভিতর থেকে বাঘ ঝাঁপ দিয়েছে। বুঝতে পারিনি ঝোপের কাছে বাঘ বসেছিল’, বললেন জ্যোৎস্না।
‘আমি ঘুরে দেখি ওঁকে বাঘ কামড় দিয়েছে। মাথাটাই কামড় দেবে ভেবেছিল। কিন্তু কাঁধে কামড় মেরেছে। টেনে নিয়ে যাবে। আমি তখন ঘুরে বাঘের কাঁধের উপর বসে আধ ঘণ্টা কুস্তি করেছি। কিছুতেই ছাড়ছে না। এমন কামড় মারছে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। আর আমিও ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। যখন কিছুতেই হয় না বাঘের কানের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে টান দিয়েছি। তখন ছেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে গর্জন করছে। ওঁকে টেনে তখন পাঁজা করে তুলেছি কোনওরকমে’, বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন জ্যোৎস্না।
হাল ছেড়ো না
কোনওমতে খালের মুখের একটি ভটভটি ধরে পাড়ে ফেরেন জ্যোৎস্না। স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। তারপর একে একে কলকাতার দু’টি বেসরকারি হাসপাতালে শঙ্করকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সব জায়গাতেই এক উত্তর। ‘এই রোগী বাঁচবে না!’ কিন্তু হাল ছাড়েননি জ্যোৎস্না। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করে গিয়েছেন প্রতিনিয়ত। ‘আমি বাঘ মারিনি। কানে আঙুল দিয়ে ছাড়িয়েছি। মা ক্ষমতা দিয়েছিল। আমার হাতে কোনও অস্ত্র ছিল না। ওকে আমি বাঁচাবই। বাঁ দিকের কাঁধটা পচে গিয়েছিল। গলার কাছের হাড়টা ভেঙে দিয়েছিল। এখনও যন্ত্রণা আছে। ডাক্তার বলেছে এখনও তিন বছর ওষুধ খাওয়াতে হবে। না হলে ক্যান্সার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবে একবছর ওষুধ খেয়েছে’, বললেন জ্যোৎস্না। সরকারি সাহায্য পেয়েছেন কিছুটা। বেসরকারি উদ্যোগেও কিছু সাহায্য পেয়েছে এই পরিবার। কিন্তু রোগীর চিকিৎসা করে, দৈনন্দিনের সংসার চালানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ জ্যোৎস্না। বাঘের মুখ থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন স্বামীকে। তাঁকে ধরে রাখার চেষ্টা তো তাঁকে করতেই হবে।
জ্যোৎস্নার পরিবারে বাঘের আক্রমণ এ প্রথমবার নয়। ‘আমার দুই মেয়ে। বড় জামাইকেও বাঘে ধরেছিল। তাকে আর বাঁচাতে পারিনি। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি আবার। নাতনি আমার কাছেই থাকে। ছোট মেয়ের বিয়ে হয়নি’, ক্লান্ত স্বরে বললেন তিনি। মেয়ের সর্বনাশ তিনি আটকাতে পারেননি। পরিবারের কর্তার সে সর্বনাশ জ্যোৎস্না হতে দেবেন না। সীমানার শেষপ্রান্তে পড়ে থাকা কবিতা, জ্যোৎস্নাদের এটাই জীবন। এটাই দৈনন্দিন। এটাই লড়াই করে বাঁচা। আর এটাই সংসার।