যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
তিন এক্কে তিন
দূরে একটা বোর্ডের উপর কতগুলো গোল দাগ কাটা। এক একটা দাগের নম্বর এক এক রকম। মাঝে একটা ছোট্ট কালো বিন্দু। ডানকুনির ক্লাবে তখন পিন পতনের নৈঃশব্দ্য। ৫০ মিটার রাইফেলের ট্র্যাকে একটা নতুন মেয়ে দাঁড়িয়ে। লক্ষ্য সামনের বোর্ডের ওই মাঝখানের বিন্দু। বছর নয়েক বয়স হবে। তবে তার চোখে সাফল্যের খিদে একেবারে পরিণত বয়সের। এক-দুই-তিন করে পাঁচটা গুলি ছুড়ল মেয়েটি। প্রথম দিনই তিন তিনটে গুলি সে বিঁধিয়ে ফেলল একেবারে মূল লক্ষ্যের গায়ে। অভিজ্ঞতা বলতে থিওরিটুকু জানা আর শ্রীরামপুরের ক্লাবে মাস কয়েক হাত মকশো।
শ্যুটার মেহুলি ঘোষের শুরু আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই। তবে তাঁর উড়ানটা আর পাঁচজনের মতো নয় মোটেই। শ্রীরামপুর-ডানকুনি হয়ে, মেয়েটার পা বাড়তে বাড়তে রাজ্য-প্রদেশ-দেশ ছাপিয়ে ছুঁয়ে ফেলেছে বিশ্বকাপের আসর। আর দক্ষিণ কোরিয়ার এয়ার রাইফেল রুমে লক্ষ্যে অবিচল থেকে ভারতের জন্য তিনি এনে দিয়েছেন স্বর্ণপদক। গোটা দুনিয়ায় ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে এক্কেবারে একনম্বরে এই বঙ্গতনয়া!
শ্যুটিংয়ের ভূত
‘ডানকুনির ক্লাবে যখন ভর্তি হই, তখন নেহাতই শিশু। কোন ক্লাস হবে? ক্লাস ফোর-ফাইভ।’ হায়দরাবাদে ‘গগন নারাং গান ফর গ্লোরি অ্যাকাডেমি’ থেকে ফোনে ছোটবেলার কথা বলতে বলতে কোথাও যেন স্মৃতিমেদুর মেহুলি! ‘ক্লাস টু-থ্রি-তে যখন পড়ি, তখন টিভিতে সামার ওলিম্পিকস দেখেছিলাম। অভিনব বিন্দ্রা নামের একেবারে অচেনা একজন নাকি সোনা পেয়েছেন! তারপর সারা দেশে জুড়ে তাঁকে নিয়ে কত হইচই! বাবা বললেন, অভিনব শ্যুটার। বন্দুক ছুড়ে সোনা এনেছেন দেশের ঘরে। আমার তো এদিকে বন্দুক গুলি এসবে খুব উৎসাহ। সব দুষ্টুলোকেদের হিরোরা বন্দুক দিয়েই মেরে ফেলে দেখেছি গল্পে! আমিও বায়না জুড়লাম, শ্যুটার হব।’ এদিকে মেয়ে শ্যুটার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, এ কথা শুনে তো অবাক বৈদ্যবাটির নিমাই ঘোষ। ভাবছেন, শ্যুটিংয়ের ভূত আবার কবে মাথায় চাপল! মেয়েকে বরং উল্টো চাপে রাখতে বলেছিলেন, ‘এবছর রেজাল্ট আগে ভালো করে দেখাও, তারপর ওসব হবে!’ ভেবেছিলেন একরত্তির সাময়িক খেয়াল, দিন কয়েক গেলেই অন্য নেশায় মেতে উঠবে। বন্দুকবাজ হওয়ার বাসনা ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু ভাবনার হাওয়া বাস্তবের পালে শক্তি জোগাল না মোটেই। বরং ভালো রেজাল্টের পরেই শুরু হল মেয়ের দ্বিগুণ বেগে বায়না, ‘এবার আমাকে শ্যুটিংয়ে ভর্তি করে দেবে তো?’ একরত্তি মেয়ের জেদ ও বায়নাকে আর বিপথগামী করেননি বাবা। খুঁজেপেতে শ্রীরামপুরের এক ক্লাবে ভর্তি করে দেন মেহুলিকে। খোঁজ পান মেয়েরই স্কুলের এক সহপাঠীর কাছ থেকে। তবে তিনি তখন নেহাতই একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী। এয়ার রাইফেলের দাম শুনেই গলা শুকিয়ে যায় যে কোনও মধ্যবিত্ত ঘরে। সেই খেলাকে আপন করতে চাইছে মেয়ে! মনে একটু সংশয় ছিল বইকি! তবে মাস কয়েকের মধ্যে মেয়ের নেশা ও দক্ষতা দেখে মনে সংশয়ের মেঘ কাটছিল। শ্যুটিংয়ের ভূত ততদিনে মাথা ছাড়িয়ে মনেও পুরোপুরি গেঁথে বসল।
অর্জুনের লক্ষ্যভেদ
পড়াশোনা আর শ্যুটিং একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে শুরু করল মেহুলির। শ্রীরামপুরের ক্লাবের অনুশীলনে মন ভরছিল না। তাই কোচ বিবস্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের অধীনে ডানকুনিতে এয়ার রাইফেল শিখতে শুরু করল মেহুলি। আগে অভ্যাস করত ৫০ মিটার রাইফেল। এবার হাত পাকাতে শুরু করল ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে। প্রথম যেদিন ছাত্রীকে দেখেন, সেদিন থেকেই বুঝেছিলেন এই মেয়ে অন্যদের থেকে আলাদা। বলছিলেন মেয়েটির কোচ বিবস্বান গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘জেদ আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা ওকে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করেছিল। একবার ব্যর্থ হলে বারবার অভ্যাস, দমে না গিয়ে নিজের সেরাটা উজাড় করে দেওয়া আর সাফল্য ধরে রাখতে কঠিন অনুশীলন— এই তিনের যোগফল হয়েই বিশ্বসেরার মুকুট এসেছে ওর মাথায়। মাঝে চোটের কারণে মেহুলি ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম দশেও জায়গা ছিল না। সেখান থেকে লড়ে পরিশ্রম করে আজ ও বিশ্বসেরা। এই ফলই বলে দেয় ওর ভিতরে কী স্পার্ক আছে!’ মেহুলিকে নিয়ে আশাবাদী তাঁর আর এক কোচ জয়দীপ কর্মকারও। ডানকুনিতে শেখা সাঙ্গ হতে হতেই মেহুলির ভিতর খেলোয়াড় হয়ে ওঠার ইচ্ছে প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। ততদিনে ঝুলিতে এসে গিয়েছে রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপের সিলভার (২০১৪), জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের সিনিয়র ও জুনিয়র বিভাগে যথাক্রমে রৌপ্য ও স্বর্ণপদক (২০১৬)। বাড়ি ছেড়ে উঠে আসতে হয়েছে সল্টলেকে। নাতনির বন্দুক ছোড়ার পারদর্শিতা মুগ্ধ করেছে দাদু-দিদাকেও। তাই মা-বাবা-দাদু-দিদা মিলে মেহুলিকে তখন কিনে দিলেন একটি এয়ার রাইফেল। মধ্যবিত্ত বাড়িতে যা অনেক সাধ আর স্বপ্ন বন্ধক রেখে কিনতে হয়।
জীবনও এবার শুরু করল তার নিজস্ব পরীক্ষা। সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক, এদিকে কমনওয়েলথে নির্বাচিত মেহুলি। যে কোনও একটার জন্য ছাড়তেই হবে একটাকে। উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়ার কথা ওই সময় ভাবতে পারে না প্রায় কোনও স্কুলছাত্রীই। কিন্তু বন্দুকের নেশার বুঁদ মেহুলি ততদিনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ওলিম্পিকসের! কোচ বিবস্বান ও জয়দীপ কর্মকার দু’জনেই এই সময় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্রীর। কোচেদের নিরন্তর উৎসাহ ও নিজের মনের টানে কমনওয়েলথকেই বেছে নিল সে। ২০১৮-য় কমনওয়েলথে রুপো জয় মেহুলিকে এনে দিলে লাইমলাইটের একদম শিখরে। ঠিক তার পরের বছর ২০১৯-এ সাউথ এশিয়ান গেমসেও সিনিয়র বিভাগে এল সোনা। চার বছরের মাথায় ২০২২-এ বিশ্বকাপের আসরে তুষার শাহু মানের সঙ্গে জুটি বেঁধে ফের সোনা! নিজের শ্যুটিংয়ের পথকে এভাবেই সোনা-রুপোয় মুড়িয়ে চলতে শুরু করেছেন মেহুলি। ‘প্রথমে তো ভেবেছিলাম কমনওয়েলথেও সোনা পেয়েছি। পরে আমাকে জানাল হল, আমার স্কোর টাই হয়েছে ও রুপো নিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু সোনাই আমার লক্ষ্য ছিল। তাই তখন থেকেই নিজেকে আরও নিয়মের নিগড়ে বাঁধি। আরও পরিশ্রম, আরও ত্যাগ আর আরও শক্তি বাড়ানোর দিকেই নজর ছিল আমার। পরের প্রতিযোগিতাগুলোয় সোনা ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি’, বলছিলেন মেহুলি।
নিয়মনীতির পাঠশালা
‘দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশ্বকাপের আসরে যাওয়ার আগে যা রুটিন ছিল মেহুলির, এখনও সেই রুটিনই রেখেছি। আগামী অক্টোবরেই মেহুলির শ্যুটিং ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ রয়েছে। এরপর রয়েছে প্যারিস ওলিম্পিকস। এই সময় শুধু আরও বেশি করে নজর দিচ্ছি ওর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফিনিশিংয়ের দিকে। টেকনিকের দিক থেকে আমাদের যা আয়ত্তে আনার তা শেখা শেষ হয়েছে, এখন সেই টেকনিককে কতরকমভাবে কাজে লাগানো যায়, তার ঝালাই চলছে’, কোচ বিবস্বানের গলাতেও ঝরে পড়ছে ছাত্রীকে নিয়ে গর্ব ও চিন্তার মিশ্র স্বর। এই মুহূর্তে এয়ার রাইফেলে দুনিয়ার এক নম্বর খেলোয়াড় ফরাসি কন্যা ওশিয়ানা মুলার। তাঁর সঙ্গেই ফেস অফ হবে আসন্ন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে। তাই মেহুলির রুটিনও এখন নিয়মনীতির নিগড়ে বাঁধা। ভোর থেকেই শুরু হয় অনুশীলন। দুপুর একটা-দেড়টা নাগাদ অনুশীলন সেরে স্নান খাওয়া, কিছুটা বিশ্রাম। ফের আড়াইটে-তিনটে নাগাদ ফের অনুশীলন শুরু। বিকেলে অনুশীলন সেরে জিম। তারপর ঘরে ফিরে স্বপাক খাওয়া ও ঘুম। কোচ বললেন, ‘এক একটা এয়ার রাইফেলের ওজন প্রায় ৫ কেজি করে। নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বন্দুকচালনার সময় ভারসাম্যে অসুবিধা হয়। তাই শ্যুটারদেরও চাই কড়া ডায়েট।’ একা একা থাকতে হয়, রেঁধে খেতে হয় এই বয়স থেকেই, অসুবিধা হয় না? প্রশ্ন শুনে একটুও ম্লান হল না ২২ –এর তরুণীর স্বর। বরং বললেন, ‘ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও সঠিক ডায়েট ফলো করতে হলে নিজে রেঁধে খাওয়াই ভালো।’ আর বাবা-মায়ের জন্য মনখারাপ? এবার অবশ্য কয়েক মুহূর্ত ফোনের ও প্রান্তে চুপ বঙ্গতনয়া। যেন বৈদ্যবাটির বাড়ির দাওয়া, উঠোন, মায়ের কোল আর বাবার দরাজ স্নেহকে চারিয়ে নিলেন মনে মনে। তারপর বলে উঠলেন,‘তা তো হয়ই। তবে সামনেই ফেস অফ। বাড়ির লোকজন এসময়ে এলে ফোকাস নষ্ট হতে পারে। তাই ফেস অফ শেষ হলেই বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করব। অনেকদিন দেখা হয়নি...।’
নিজামের শহরের একচিলতে মনকেমনিয়া মেঘ কি একবারও উড়ে আসবে না বৈদ্যবাটিতে নিমাই ঘোষের বাড়ির প্রাঙ্গণে?
মনকেমন ঝেড়ে জিমে যাওয়ার পথে পা বাড়ালেন মেহুলি। ফোনে জানিয়ে গেলেন, এখন তাঁর একটাই স্বপ্ন, প্যারিস ওলিম্পিকস।
মাত্র ২২-এর দৃঢ় স্বরপ্রত্যয়ে কোন সুদূরের ভিকট্রি ল্যাপে যেন উড়ান নিল ভারতীয় তেরঙ্গা, গোটা পোডিয়াম ঢেকে গেল জাতীয় সঙ্গীতের সুরমূর্ছনায়!