যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
সুন্দরবনের শিশুদের নিরাপত্তা ও দেখভালের কাজে মগ্ন তিনি। শিশুকন্যাদের সহজ ও সুন্দর শৈশব দিতে চান। আপাতত সেটাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তিনি নন্দনা সেন। নবনীতা দেবসেনের কন্যা তো বটেই, তা ছাড়াও হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট, অভিনেত্রী, শিশু সাহিত্যিক, চিত্রনাট্যকার, শিশু অধিকার রক্ষায় আন্দোলনরত— পরিচয়ের শেষ নেই তাঁর। অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তবু তথাকথিত ঝকঝকে শহুরে জীবনের গ্ল্যামার ছেড়ে তিনি গ্রামের পথে শিশুদের কল্যাণ কার্যে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। সে কারণেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর ‘চাইল্ড প্রোটেকশন অ্যাম্বাসাডর’ তিনি। সম্প্রতি সংস্থার কাজে ও নিজের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে কলকাতা এসেছিলেন নন্দনা। শিশু ও শিশুকন্যাদের নিয়ে তাঁর কাজ ও ভাবনা বিষয়ে বিস্তারিত কথা হল তাঁর সঙ্গে।
পথশিশুদের দেখভালের কাজে নিজেকে সঁপে দেওয়ার পিছনে মূল কারণ কী?
প্রথম ও প্রধান কারণ শিশুকন্যাদের দেখভাল ও নিরাপত্তা। শুরুতেই বলা ভালো, এটাই কিন্তু আমার প্রথম সমাজসেবামূলক কাজ নয়। শিশুদের নিয়ে আরও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীর সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছি এর আগেও। সেভ দ্য চিলড্রেন-এর প্রজেক্টের কথা শুনে এবং তাদের কাজ দেখে ভালো লাগে। তাই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হতে রাজি হয়ে যাই। এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা শিশুদের উপর হওয়া নানাধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করছি। তাছাড়া শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্যও লড়াই করছি। আমার মনে হয় শিশুদের উপর এই অন্যায়গুলো বন্ধ হলে তবেই তারা একটা সঠিক সহজ ও উপভোগ্য শৈশব পেতে পারে। এর পাশাপাশি আবার বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখানোর কাজটাও করে চলেছি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের শিশুকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো নিয়ে অলোচনা করছি। সেভ দ্য চিলড্রেন-এর সঙ্গে আমার এই যোগাযোগ দুঃস্থ শিশুদের উন্নত শৈশব দিতে পারবে।
আপনি সক্রিয়ভাবে ‘সেফ টুমরো’ ক্যাম্পেনের সঙ্গেও যুক্ত। এই ক্যাম্পেনের মূল বক্তব্য কী?
এই ক্যাম্পেন পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের দেখভালের কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন এলাকার বাচ্চাদের দেখলে কষ্ট হয়। এদের অনেকেই বাবা মা দু’জনকেই হারিয়েছে মহামারী ও ইয়াসের কারণে। বিপর্যস্ত এই শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের একটু উন্নত শৈশব দিতে চাই আমরা। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বাচ্চাদের জন্য একটা এক বছরের স্পনসরশিপ প্রোগ্রাম চালু করেছি। এই এক বছরের মধ্যে তাদের বিভিন্ন ধরনের সরকারি সাহায্য ও অনুদানের ব্যবস্থা করব। আমরা মোটামুটি ২০০ জন শিশুর দায়িত্ব নেওয়া দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন তা বেড়ে ৩১৫ জনে পৌঁছেছে। আশার কথা এই যে ইতিমধ্যেই ১০০ জন ইচ্ছুক দাতা শিশুদের দেখভালের প্রকল্পে যুক্ত হতে রাজি হয়েছেন। এই বিপুল ইচ্ছুক দাতাদের আমরা আমাদের প্রকল্পে স্বাগত জানাই।
সুন্দরবনের শিশুরা কোভিড ও ইয়াসের ধাক্কা কীভাবে সামলাচ্ছে?
পরপর দুটো বিপর্যয়ের পরিণতি সত্যিই ভয়াবহ। এর প্রভাব অনাথ ও দুঃস্থ শিশুদের উপর সবচেয়ে বেশি পড়েছে। আমাদের রাজ্যে এর ফলে শিশুশ্রম ও শিশুকন্যাদের নিরাপত্তার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। এছাড়াও শিশুকন্যা পাচারও খুবই বেড়ে গিয়েছে। প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। এটা বন্ধ করার কাজটাই আমরা করছি। শুধু তাই নয়, পাচার হওয়া বাচ্চাদের উদ্ধার করার কাজেও আমরা নেমে পড়েছি। অনেক শিশুকে উদ্ধার করার পর দেখা যাচ্ছে যে তারা একটা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। একটা মানসিক ট্রমা যার ফলে কারও কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কারও বা ‘পোস্ট ট্রমা জিটারস’ হচ্ছে। এগুলো যাতে বন্ধ করা যায় সেই জন্য আমরা একটা মেডিক্যাল টিমও গঠন করেছি। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য আমরা অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছি। আর শুধু চিকিৎসাই বা বলছি কেন? বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়া, পোশাক সবকিছুর ব্যবস্থাই আমরা করছি। কিন্তু এদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারছি শুধুই বাইরে থেকে বাহ্যিক সাহায্য যথেষ্ট নয়। এদের সুস্থ জীবন দিতে হলে আরও অনেক বেশি কাজ করতে হবে। এদের মনে একটা বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে। সেই বিশ্বাস তৈরির কাজই আমার লক্ষ্য। তবে তার আগে আপাত
সংকট কাটাতে হবে। সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
অনাথ ও দুঃস্থ শিশুদের জন্য বিশেষ এই প্রকল্প বিষয়ে আপনার মতামত কী?
অসম্ভব একটা আবেগ কাজ করছে আমার মনের মধ্যে। একটা অসম্ভব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা সবাই চলেছি। ধাক্কা খাচ্ছি আবার যথাসাধ্য সামলেও নিচ্ছি। কিন্তু সমাজের গরিব পরিবারগুলোর উপর, সেইসব পরিবারের বাচ্চাদের উপর এই সময়ের প্রভাব খুবই গুরুতর হয়ে উঠছে। আমি যদি সক্রিয়ভাবে এই কাজটা না করতাম তাহলে কিছুই বোঝা হতো না। খবর দেখে বা পড়ে হিমশৈলের চূড়াটুকুর আন্দাজ পাওয়া যায় মাত্র। কত গভীরে যে সমস্যার শিকড় তার ডালপালা মেলে রেখেছে, তার আন্দাজ করা যায় না। আর এক্ষেত্রে তো আমরা সরকারি নথিতেই দেখলাম দেড় লক্ষ শিশু অনাথ হয়েছে, কেউ বা ঘরছাড়া হয়েছে। তাদের পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বাধ্য হয়ে শ্রমিকের কাজ করছে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাওয়ার আশায়। কিন্তু সরকারি নথিভুক্ত এই বীভৎস চিত্রই সব নয়। এর পরেও আরও লক্ষ লক্ষ শিশু রয়েছে যাদের খবর কেউ রাখতে পারেনি। তারা অনাথ হয়েছে, পাচার হয়েছে, খেতে পাচ্ছে না। আমরা তাদের খবরই পাইনি। সেইসব শিশু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আবেগের তাড়না তো হবেই। এ যেন একটা বিপুল সমুদ্রে কেউ আমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। হাবুডুবু খেতে খেতে সাঁতরানোর মতো অনুভূতি। সাঁতরাচ্ছি, তবু কূলকিনারা পাচ্ছি না। তো এই যখন পরিস্থিতি তখন সেভ দ্য চিলড্রেন একটা অসাধ্য সাধনের কাজে নেমেছে। আমি তাদের সঙ্গে থাকতে পেরে, সক্রিয়ভাবে এই প্রকল্পে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সেফ টুমরো প্রকল্পে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে নিজের মধ্যে একটা উপলদ্ধি হচ্ছে। আমরা কতটা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’ সেটা এদের জীবনের নিরিখে নিজেদের দেখে আবারও বুঝতে পারছি। কিন্তু সব কালোর মধ্যেই একটা আলো থাকে। আর সেই আলোর সন্ধানই আমরা করছি। সুন্দরবনের শিশু ও মহিলাদের মুখের অন্ধকারের মধ্যে যখন সামান্য একটু হাসির ঝিলিক দেখতে পাই, তখন নিজেদের জীবন সার্থক মনে হয়। তাঁদের অসহায়ত্ব দূর করা হয়তো সম্ভব নয়, তবু সাহায্যের সামান্য হাতও যে বাড়িয়ে দিতে পেরেছি সেটাই আমার কাছে বিশাল একটা অনুভূতি। এইসব কাজ করতে গিয়ে বারবার মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
সেই অনুভূতির কথা একটু বলুন...
এটাকে অনুভূতি না বলে বরং ব্যাকুলতা বলা ভালো। আমার মা, সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন, সবসময় অন্যের কথা ভাবতেন। তাঁর শিক্ষায় আমার বেড়ে ওঠা। আমার আগে অন্যকে বসাতে আমি ছোট থেকেই শিখেছি। মায়ের বন্ধুদের একটা দল ছিল, নাম সই। সেই দলের সব সদস্যের সুখে দুঃখে মাকে সবসময় উপস্থিত থাকতে দেখেছি। আমিও সেই মায়ের মেয়ে হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। মায়ের মতো দরদ আমার আছে কি না জানি না, তবু মনে হয় মা তো আমারই মধ্যে রয়েছে। আমার কাজের মাধ্যমেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব। এই বাচ্চাগুলোকে দেখে, সর্বহারা গ্রাম্যবধূদের দিকে তাকিয়ে বারবার মায়ের কথা মনে পড়ে। ভাবতে চেষ্টা করি, এই পরিস্থিতিতে মা কী করতেন? সবসময় যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজ করাই সাহায্যের শ্রেষ্ঠ উপায় তা কিন্তু নয়। মা বলতেন, কারও পাশে থাকাই যথেষ্ট। আমিও সেই চেষ্টাই করছি। সর্বহারা এই গ্রাম্য মায়েদের পাশে থাকছি, তাদের ভরসা দিচ্ছি উন্নততর জীবনের একটা আশা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। ঘোর বাস্তবের নিরাশা কাটিয়ে তাদের আলোর সন্ধান দেওয়ার কাজ করছি।
আপনি বলেছেন এই বাচ্চাদের অতিরিক্ত যত্ন এবং সহমর্মিতা দরকার। সেটা কীভাবে দেওয়া সম্ভব?
বাবা বা মাকে হারানোর দুঃখ যে কতটা গাঢ় হতে পারে সেটা তো আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি। মা চলে যাওয়ার পর সেই একাকিত্ব সামলাতে হিমসিম খাচ্ছি এখনও। তবু আমি প্রাপ্তবয়স্ক। পরিণত মনের মানুষ। তাতেই আমার কষ্ট এত মারাত্মক। তাহলে শৈশবে যেসব বাচ্চা বাবা বা মা বা দু’জনকেই হারিয়েছে, তাদের মনের উপর কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা ভাবুন। কোমল হৃদয় এই কষ্ট সহ্য করতে পারে না সবসময়। তাদের তাই অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন। আমি সেই চেষ্টাই করি। আমাদের সংস্থার তরফে এই সর্বহারা বাচ্চাদের মনোরঞ্জন ও শিক্ষাপ্রদানের জন্য একটা মাল্টি অ্যাক্টিভিটি সেন্টার খোলা হয়েছে। সেখানে গিয়ে এইসব শিশুদের সঙ্গে সময় কাটালে নিজের একটা মানসিক শান্তি আসে। আমি এদের সঙ্গে গান করি, নাচি, গল্প বলি, বই পড়ে শোনাই, এমন আরও নানারকম কাজকর্মে লিপ্ত থাকি। এদের জীবনে একটা উদ্দেশ্য খুঁজে দিতে চাই। আমার কাজের মাধ্যমে এরা যদি অল্প অল্প করে বাবা মা-কে হারানোর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কাটিয়ে উঠে জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পারে তাহলেই মনে করব আমার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে।
কীভাবে বাচ্চাদের জীবন উন্নত করার চেষ্টা করছেন?
বাচ্চাদের কিছু সাধারণ চাহিদা থাকে। সেগুলো থেকে যাতে তারা বঞ্চিত না হয় সেই দিকেই আমরা লক্ষ রাখি। দু’বেলা পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা, ন্যূনতম শিক্ষা প্রদান, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা— এইসবই আমরা করছি। এছাড়া তাদের মানসিক বাড়বৃদ্ধির জন্যও কিছু প্রকল্প নিয়েছি, যেমন সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং, তাদের মন ভালো রাখার জন্য আলাদা করে খেলাধুলোর ব্যবস্থা ইত্যাদি। এরপর বাচ্চারা কতটা লাভবান হচ্ছে সেই মনিটরিংটাও করছি। তাদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলছি, গল্পের ছলে তাদের দুঃখ ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। অনেক শিশুই আমাদের এই প্রকল্পে সাড়া দিচ্ছে। আর বাচ্চাদের হাসিমুখগুলোই আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে থাকছে।