পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
‘পাঁচ জন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে এবার। পাঁচ জনই ফার্স্ট ডিভিশন। একজন পাঁচটা লেটার, একজন চারটে। বাকি দু’জন তিনটে করে। আর একজন একটা। মেয়েরা পাশ করলে সবাই খুশি হয়। আমিও খুশি। ভেবেছিলাম ফার্স্ট ডিভিশনে যাবে। কিন্তু এতটা আমি ভাবিনি...’ চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন তিনি। ‘আপ রানাঘাট লোকাল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে...’ ট্রেনের ঘোষণা, যাত্রীদের নিত্য ব্যস্ততার কোলাহলে জেগে রইল তাঁর কান্নাভেজা হাসিমুখ। এই চোখের জল আনন্দের। মেয়েরা ভালো রেজাল্ট করেছে মায়ের তো আনন্দ হবেই। না! জন্মদাত্রী মা তিনি নন। কিন্তু মায়ের মতোই ২০জন কন্যাসন্তানকে আগলে রেখেছেন ‘দিদিমণি’। ওদের কাছে এটাই ওঁর পরিচয়। তিনি কান্তা চক্রবর্তী।
দিদিমণি
‘ওরা আমাকে দিদিমণি বলে ডাকে। আবেগে কাজ করি না। মা ডাক হলেই অন্যরকম হতো। দিদিমণি বলতে বলতে এখন তো শুধুই ‘নি’ বলে ডাকে’, দমদমের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের উপর একচিলতে ঘরে বসে বলছিলেন কান্তা। এবছর উচ্চমাধ্যমিকে তাঁর কাছে থাকা পাঁচটি মেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। রিনা, প্রিয়াদের মধ্যে কেউ ভূগোল নিয়ে পড়তে চায়, কেউ বা অ্যাকাউন্টেন্সি। মেয়েদের কলেজে ভর্তি করানোর ব্যস্ততা চলছে এখন। ‘ওদের একটাই ইচ্ছে, এক কলেজে যেন ভর্তি হতে পারে। ছোট থেকে ওরা পাঁচজন একসঙ্গে বড় হয়েছে। কোথাও বেড়াতে গেলেও এক ঘরে থাকে। এক কলেজে ভর্তি হলে আমারও সুবিধা, এক জায়গায় নামাতে পারব,’ বললেন ২০ কন্যার দিদিমণি।
‘কে পড়াবে? তুমি?’
২০০৭-এ দু’টি মেয়েকে দমদম স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই পড়াতে শুরু করেন কান্তা। দমদমের বেদিয়াপাড়ার বাসিন্দা পেশায় শিক্ষিকা। স্কুলে যাওয়ার পথে শিশুদের ভিক্ষা করতে দেখতেন। এ তো নতুন নয়। চলার পথে সকলেরই চোখে পড়ে। কিন্তু কান্তা ওদের পাশে দাঁড়ালেন কেন? ‘টিকিট কাউন্টারে, স্টেশনে, রিকশার লাইনে ভিক্ষা করত ওরা। ওদের দেখতাম। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভিক্ষা করছিস কেন? পড়বি? ওরা বলেছিল, ‘কে পড়াবে? তুমি?’ সে-ই আমার বড়কন্যা প্রীতি, আজ একসঙ্গে এমকম পড়ছে, আবার ডব্লিউবিসিএস-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর একজন গুড়িয়া উওমেন’স কলেজে সেকেন্ড ইয়ার বাংলা অনার্স। দু’টি মেয়েকে নিয়ে শুরু হয়েছিল। ওরাই বলত, চল দিদিমণির কাছে পড়বি চল। ওরাই আমার বন্ধু। আজ ২০ জন কন্যা আমার। সবথেকে ছোট ময়না, ডাভ হাইস্কুল ফর গার্লস-এর ক্লাস ফাইভ।’
এই কর্মযজ্ঞে প্রথম দিন থেকে কান্তার পাশে স্বামী চন্দন চক্রবর্তী। ‘আমার স্বামী বলেছিলেন, ‘তুমি এত সহজে বলে দিলে পড়াব! এত সহজ নয় ব্যপারটা।’ ভিক্ষা করা মেয়ে মানে মর্মান্তিক অবস্থা। এক টাকা, দু’ টাকা, ১০ টাকা ফেলে দিয়ে চলে যায় লোকে। আমি বলেছিলাম, ‘তুমি একবার হ্যাঁ বলো। তারপর আমি লড়াই করব।’ ওই যে হ্যাঁ বললেন, তারপর থেকে শুরু হল লড়াই। এই ২০জন আমার সন্তানের থেকেও বেশি। ওদের ব্যাপারে কারও সঙ্গে কোনও আপস করি না’, লড়াইয়ের গল্প ভাগ করে নিচ্ছিলেন তিনি। সে সময় থেকেই শুরু করেছেন নীহারকণা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। ‘আমার ঠাকুরমা নীহারকণা। আমি বড়মা বলতাম। আমাকে বড় করেছেন’, সুখস্মৃতি ভাগ করতে করতে ভাঁড়ের চায়ে গলা ভেজালেন ৫৫-র প্রৌঢ়া।
নিয়ম-নীতি
দিদিমণিকে ভয় পাও? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল সদ্য উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরনো রিনা। ‘অন্যায় করলে তো বকবেই’ জবাব দিল অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্সের স্বপ্নে বিভোর প্রীতি। তা কীরকম অন্যায়? বই অগোছালো রাখা যাবে না। জামাকাপড় গুছিয়ে রাখতে হবে। আর পেট ভরে খেতে হবে। এখানকার নিয়ম, কাঁদতে পারবে না, দুঃখ করতে পারবে না। বাবা, মায়ের কথা মনে পড়ে কি? এই কন্যাদের বাবা, মা আদৌ আছেন? কান্তা বললেন, ‘অনেকের বাবা, মা আছেন। অনেকের নেই। কিন্তু কেউ খোঁজ করে না। আমার কাছেই বড় হয়ে যাচ্ছে। এটা করতে পারছি ওদেরই জন্য, ওরা বাধ্য, নিয়মানুবর্তী আর খুব একাগ্র। ছোটদের এখনও নিজে হাতে খাইয়ে দিই আমি। পড়ার কথা কোনওদিন বলতে হয় না ওদের। শুধু আট থেকে ন’ঘণ্টা ঘুম হয়েছে কি না, খাওয়া হল কি না, আর কী পড়ছে, লক্ষ্য রাখি। প্রথম পাঁচ বছর খুব কষ্ট হয়েছে। জানেন, সবার বয়েজ কাট চুল ছিল। কারণ চুল বেঁধে দিতে পারব না। ওদের বলেছি, যখন নিজেরা বাঁধতে পারবে তখন চুল বড় রাখবে। চুল অগোছালো দেখলেই আমি কেটে দেব। এটা ওরা জানে।’
অতীত স্মৃতি
এই কন্যাদের অতীত অন্যরকম। স্কুল, কলেজে অন্যান্য পড়ুয়ার সঙ্গে মিশতে সমস্যা হয়নি? হয়েছে, সেখানেও ঢাল সেই কান্তাই। বললেন, ‘প্রথম দিকে স্কুলে অন্য মেয়েরা ওদের নানাভাবে অসুবিধের মধ্যে ফেলেছিল। বলত, রাস্তার মেয়ে। আমি নিজে ছুটি নিয়ে বসে থেকে কাউন্সেলিং করেছি। এখন স্কুলে ওরাই রাজা। ওদের খুব ভালোবাসে সকলে।’
এই কর্মযজ্ঞে বহু মানুষ কান্তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের কাউকে ভোলেননি এই শিক্ষিকা। ‘হকার দাদারা সাপোর্ট করেছেন প্রচুর। ওঁদের কাছে ওরা সন্তানের মতো। জিআরপি, আরপিএফ সাপোর্ট দিয়েছে। আমি তো এখানেই শতরঞ্চি পেতে পর্দা টাঙিয়ে পড়াতাম। আরপিএফ রাউন্ড দিয়ে যায়। সিঁথি থানার দাদারা গার্ড দেয়। মেট্রোদাদারাও দেখভাল করে। সবাই ওদের রক্ষা করে।’
নিরাপত্তা
দুই থেকে আজ ২০ হয়েছে। কিন্তু কান্তারও তো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কতজনের আশ্রয় হয়ে উঠতে পারবেন তিনি? ‘প্রতিদিন ২-৩ জন করে আমার এখানে আসতে চাইছে। নিতে পারছি না। ফিরিয়ে দিচ্ছি। কারণ ওরা বঞ্চিত হবে। প্রীতি চাকরি পেলে একজনকে নেব। ওর টাকায় আর একজন বড় হবে’, বললেন মেয়েদের গর্বে গর্বিত দিদিমণি। আর নিরাপত্তা? মেয়েরা বড় হচ্ছে। ভয় করে না? নির্ভীক কান্তার সপাট জবাব, ‘এখানেই তো বড় হল। একদিনও কেউ চুল ছুঁতে পেরেছে? আমার কোনও ভয় নেই। কারণ সমাজ ভালো। সেজন্যই আমি পারছি। ওরা তো এখানে রাতেও থাকত। আমরা বাইরে পাহারা দিতাম। কোনও গার্ড রাখতে পারিনি তো। বেশিরভাগ রাতে আমি ঘুমোতাম না। সমাজ ভালো না হলে আমি প্ল্যাটফর্মে এভাবে রাখতে পারতাম? ১৬ বছরে কেউ আমাকে বিরক্ত করেনি।’
মাদার্স ডে তে কাগজ দিয়ে মায়ের কোলে শিশুর মোটিফ তৈরি করে দিদিমণিকে উপহার দিয়েছিল মেয়েরা। সে কথা বলতে গিয়ে আজও শিশুর মতো খুশি হয়ে ওঠেন কান্তা। পরীক্ষার আগে জগন্নাথদেবের কাছে মেয়েদের জন্য মানত করেন দিদিমণি। যে পরীক্ষা দিচ্ছে তার উচ্চতায় সরস্বতী ঠাকুর এনে পুজোর ব্যবস্থা করেন প্ল্যাটফর্ম চত্বরেই। অবসরে কখনও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কখনও বা সত্যজিৎ রায়ের লেখায় ডুবে থাকা মেয়েদের মন্ত্র পেট ভরে খাওয়া, মন দিয়ে পড়া আর আনন্দে থাকা।
বাধা এসেছে, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে দেননি কান্তা। মেয়েদেরও লড়াকু মনোভাব নিয়েই তৈরি করছেন। ‘ওরা তৈরি। আমার কোনও চিন্তা নেই। আমার মেয়েরা বলে তুমি চিরকাল সর্বশক্তিমান। কোনও বিপদে পড়লে নিজেরাই সামলে নেবে। আমি নিশ্চিত’, শান্তির হাসি খেলে গেল কান্তার মুখে।
সাধারণ সুতির শাড়ি, শাঁখা সিঁদুরের কান্তা এবার মিশে যাবেন ভিড়ে। সে ভিড়ে তাঁকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ওই ২০জনের একজনের সঙ্গেও যদি কথা হয় কখনও, ঠিক বুঝতে পারবেন ওরা কান্তার ‘সন্তান’।