বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
রেত সমাধি। সম্প্রতি বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত বইটির ইংরেজি অনুবাদ পড়তে পড়তে বিভিন্ন প্রশ্ন মনকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। বইটি একটা যাত্রার কথা বলে। একজন মহিলার জীবনের যাত্রা। ৮০ বছর বয়সি এক মহিলা যাঁর স্বামীর মৃত্যুতে তাঁর উপর অবসাদের ছায়া ঘনিয়ে আসে। কিন্তু সেই অবসাদকে তিনি পেয়ে বসতে দেন না। বরং তার বিরুদ্ধে এক অসম্ভব মানসিক লড়াই চালাতে থাকেন। সেই অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে নতুন জীবনের স্বপ্ন মনে মনে বুনতে শুরু করেন তিনি। এমন স্বপ্ন যা তাঁকে তাঁর জন্মভূমি পাকিস্তানে টেনে নিয়ে যায়। ৮০ বছরের বৃদ্ধা নিজেকে আবারও অল্পবয়সি তরুণী রূপে কল্পনা করতে শুরু করেন। সেই তরুণী যার জীবনে আশা ছিল, প্রেম ছিল। দেশভাগ, সংসার আর নানাবিধ দায়িত্বের মাঝে পড়ে সেই তারুণ্য ভরা কল্পনা হয়তো বা বাস্তবের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গিয়েছে বহু ক্ষেত্রে, কোথাও বা সেই ভালোলাগার রং ফিকে হয়েছে, মরচে ধরেছে স্বপ্নের টানে। তবু সেই তারুণ্যের হিল্লোল বয়স্ক জীবনকেও নাড়া দিয়ে যায়। আর সেই নাড়া খেয়ে বৃদ্ধার স্মৃতিতে মোচড় লাগে। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে বসেন সীমান্তের টান সে কি শুধুই কষ্টের? নাকি স্মৃতির মাধুর্যে তা মধুময়?
চরিত্র বৈচিত্র্য
‘কোনও চরিত্রই যেমন সম্পূর্ণ কল্পনার উপর দাঁড়িয়ে থাকে না, তার সঙ্গে বাস্তবের একটা মিল থাকে, তেমনই আবার কোনও একজন ব্যক্তিকে ঘিরে উপন্যাসের চরিত্র তৈরি করা যায় না। তাহলে সেই চরিত্র ঘিরে কল্পনার জাল বোনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। রেত সমাধির কেন্দ্রীয় চরিত্রকে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেও আমি বিভিন্ন ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাহায্য নিয়েছি। তবে এই চরিত্রটি কল্পনা করার পিছনে মূল অনুপ্রেরণা আমার মা।’ বইটির বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে একথা বললেন বুকারজয়ী লেখিকা গীতাঞ্জলি শ্রী। তাঁর কথায়, ‘মাকে দেখতাম কেমন অনায়াসে একই অঙ্গে এত রূপ ধরে রাখতেন। কখনও মা, কখনও স্ত্রী, কখনও বা কন্যার ভূমিকায় নিজেকে যেন সময়ভেদে ভরে দিতেন।’ তাঁর কথা শুনতে শুনতে বারবার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা ‘সেভেন এজেস অব ম্যান’-এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। যেখানে তিনি বলেছেন, মানুষের গোটা জীবনটাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়মাত্র। পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে এক এক বয়সে আমরা এক এক রকম অভিনয় করি। সেই সুরে সুর মিলিয়েছে গীতাঞ্জলির কেন্দ্রীয় চরিত্র চন্দ্রপ্রভা দেবী।
নতুনের টানে
অবসাদের বেড়া ডিঙিয়ে নিজের জীবনকে নতুনভাবে সাজাতে গিয়ে অন্যধরনের মানুষের সান্নিধ্য পেতে চান চন্দ্রপ্রভা। জীবনকে নতুন রূপে অনুভব করতে চান। গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে বাকি সময়টা উপভোগ করতে চান। আর সেই উপভোগের মধ্যেই নানারকম প্রশ্ন তাঁর মনে কড়া নাড়ে। তিনি সীমান্তের মাধুর্যভরা স্মৃতি মাখেন মনে মনে। আবার একই সঙ্গে দেশভাগের বিষাদেও আক্রান্ত হন। এইভাবেই বয়স্ক জীবনটাও নতুন একটা অর্থ খুঁজে পায়। সেই নতুনত্বের টানই তাঁকে অবসাদ থেকে মুক্তির সন্ধান জোগায়।
বিভিন্ন রূপ
দেশভাগের প্রসঙ্গ উঠে এল আলোচনায়। গীতাঞ্জলি জানালেন, তাঁর বইয়ের বিভিন্ন পরিচ্ছেদেই তিনি দেশভাগের প্রসঙ্গ নানাভাবে এনেছেন। দেশভাগের সঙ্গে দুঃখ-কষ্ট যেমন জড়িত তেমনই আবার বর্ডার বা সীমান্তের স্মৃতির সঙ্গে একটা মনকেমন করা ভালোলাগাও যুক্ত থাকে মানুষের মনে। একটা টান, যা নেশা ধরিয়ে দেয়। ‘আমার বইতে বিভিন্ন সম্পর্কের উপর বিশেষ জোর দিয়েছি। প্রায় আট বছরের প্রচেষ্টায় বইটি লিখেছিলাম। তারপর অনুবাদে আরও বেশ খানিকটা সময় যায়। তবে অনুবাদের কথায় পরে আসব। আগে ওই সম্পর্কের ব্যাপারটা একটু বলি। আমার নায়িকা যখন নিজের জীবনটাকে ফিরে দেখছেন তখন তিনি মা ও মেয়ের সম্পর্কের মাধ্যমেই নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হল, তিনি এই মা ও মেয়ের চরিত্রে দু’ভাবেই নিজেকে বসাচ্ছেন। কখনও কন্যা হচ্ছেন কখনও বা জননীর রূপ নিচ্ছেন। এবং এই যে একই অঙ্গে ভিন্ন রূপ সেটাই তাঁকে নতুন করে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করছে। মা ও মেয়ের সম্পর্কের পাশাপাশি আবার সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্কের রসায়ন নিয়েও নাড়াচাড়া করেছি আমার বইতে। সেখানে সময় বদলের পরিপ্রেক্ষিতে সেই রসায়ন কেমন করে বদলেছে তারও বিবরণ রয়েছে ঘটনার মাধ্যমে। শুধু যে সময় বা যুগের বদল তাও নয়, স্থান পরিবর্তন, প্রেক্ষাপটের বিভিন্নতা সবই এই সম্পর্কের রসায়নের উপর ছাপ ফেলেছে। দেশভাগ এক্ষেত্রেও একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। পরিচিত ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে যখন মানুষ জগৎটাকে নতুন করে চিনতে শুরু করে তখন তাঁদের আচরণগত পার্থক্য কতটা এবং কীভাবে প্রকট হয়ে ওঠে তাও আমার নায়িকা নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন।’ একইভাবে এই বইতে ভাই বোনের সম্পর্কও বিশ্লেষণ করেছেন গীতাঞ্জলি। তাঁর অনুভব অনুযায়ী সব সম্পর্কেরই উত্থান এবং পতন হয়। সমান্তরালে কোনও কিছুই চলে না। আর সম্পর্কের এই উত্থান পতনের মাধ্যমেই জীবনের নানা অধ্যায়ের মুখোমুখি হই আমরা। লেখক বললেন, বর্ডার বা সীমান্ত শব্দটা নিয়ে ‘ওয়ার্ড প্লে’ বা ‘পানিং’ করেছেন তিনি। বর্ডার এখানে শুধুই দেশের সীমান্ত নয়। বয়সের সীমা, বন্ধুত্বের পরিধি সবকিছুই ওই একটা শব্দের মধ্যে লেখক ধরে রেখেছেন।
দেশভাগের আতঙ্ক
তবে সম্পর্ক, চরিত্র ইত্যাদি ছাপিয়ে গিয়েছে বইটির অনুভূতি। গীতাঞ্জলি বলেন, ‘একই ঘটনা অথচ তার প্রভাব ভিন্ন। দেশভাগ সেই সময় প্রত্যেকের মনে আলাদা আলাদা প্রতিক্রিয়া রেখে গিয়েছিল। ছাপ ফেলেছিল অন্যরকম ভাবে। সেই অন্যরকমটা ঠিক কেমন তারই একটা ক্ষুদ্র বিশ্লেষণ উঠে এসেছে আমার সৃষ্টি করা কেন্দ্রীয় চরিত্রটির মাধ্যমে। দেশভাগের সময় তাঁর তারুণ্যে টইটম্বুর মনটা এক লহমায় বড় হয়ে গেল। শুধু দৃশ্যপটের বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই যে মানসিক পরিবর্তন, এটা ভয়ঙ্কর। তখনকার মতো মানিয়ে নিলেও মন কিন্তু পরে বদলা নেয়। আর সেই জন্যই আমার নায়িকার মনে মনে আতঙ্কের আগুন সারা জীবন ধরে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে। শেষ বয়সে এসে সেই আতঙ্কই আবার বৃহদাকার নেয়। জীবনের সেই ফেলে আশা মুহূর্তগুলো, ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলো মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। বর্ডার বা সীমান্ত আবার রূপ বদলায়, হয়ে ওঠে স্মৃতির জানালা। যার কপাট কখনও পিছন দিকে খোলে কখনও বা সমুখে। আর সেই সঙ্গে আমার নায়িকার মনটাও নিজের স্মৃতির সীমান্ত অতিক্রম করে অতীতের বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছয়, আবার বর্তমানে ফিরেও আসে।’
মাকে নিয়ে
ভাবনার উত্থান-পতন লেখক মনে চিরন্তন অঙ্গ, বললেন গীতাঞ্জলি। কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর মনকে ‘মা’ চরিত্রটি যতটা নাড়া দেয় অন্য কিছু ততটা দেয় না। বললেন, লেখার বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই চিন্তাধারা ঘুরে ফিরে মা-তে গিয়ে ঠেকে। লেখিকার কথায়, ‘আমার এই হিন্দি লেখার প্রতি যে টান, তার সূত্রপাতই ঘটেছিল মায়ের মাধ্যমে। আমি তখন পড়াশোনার জন্য রাজ্যের বাইরে ছিলাম। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের মূল মাধ্যম হয়ে উঠল চিঠি। হিন্দিতে মাকে লম্বা লম্বা চিঠি লিখতাম। চিঠি লিখতে লিখতে যে আমার হিন্দি ভাষাটার প্রতি, তাতে ব্যবহৃত শব্দের প্রতি একটা টান তৈরি হচ্ছিল তা বুঝতে পারছিলাম। এছাড়া মুন্সী প্রেমচাঁদের সাহিত্যও আমার অন্যতম অনুপ্রেরণা। হিন্দি ভাষার যতটুকু আয়ত্ত করতে পেরেছি তার অনেকটাই প্রেমচাঁদের লেখা পড়ে।’
গীতাঞ্জলির প্রথম উপন্যাসের নাম ‘মাই’ অর্থাৎ মা। সেখানেও তিনি একটি মা ও মেয়ের সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন। বইটি অল্পবয়সি মেয়ের বয়ানে লেখা। মায়ের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের বহুকৌণিকতা বিশ্লেষণ করতে যে বারবার ভয় পাচ্ছে। অজানা একটা আতঙ্কে ভুগছে, এই বুঝি বয়সকালে সেও মায়েরই মতো হয়ে যাবে! কিন্তু মায়ের মতো হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক কীসে? মেয়েটির উপলব্ধি মায়ের যুগটা তো ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাহলে মায়ের মতো হয়ে গেলে সেও তো পুরনো হয়ে যাবে। আশ্চর্য ভাবনা, অদ্ভুত তার বিশ্লেষণ। তবে এরও অনেক আগে থেকেই নাকি গীতাঞ্জলি লেখক হওয়ার স্বপ্নই দেখতেন। ছোটবেলায় রহস্য গল্প লেখার নেশা ছিল তাঁর।
প্রসঙ্গ বুকার
বুকার পুরস্কার পাবেন একথা স্বপ্নেও ভাবেননি গীতাঞ্জলি। সম্মান পেয়ে তিনি অভিভূত। তবে একই সঙ্গে অন্য ধরনের একটা আনন্দও অনুভব করছেন। বললেন, এই স্বীকৃতি শুধু তাঁর নয়, একই সঙ্গে ভারত তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সম্মান এটা। বইটির ইংরেজি অনুবাদক ডেইজি রকওয়েলের কাজের প্রশংসা করে গীতাঞ্জলি বলেন, ‘ডেইজি এর আগেও ভারতীয় ভাষার বহু অনুবাদ করেছেন। হিন্দি এবং উর্দু অনুবাদে খুবই দক্ষ তিনি। তবে এক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর গভীরে ঢুকে তাদের বৈচিত্র্য সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে প্রতিটি চরিত্রকে ইংরেজিতে প্রতিস্থাপন করেছেন। তাঁর অনুবাদের মাধ্যমে সেই চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাদের মনের টানাপোড়েন এক উচ্চ তারে বেঁধে রেখেছেন অনুবাদক। এবং একই সঙ্গে গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
গীতাঞ্জলি বলেন, ‘এক একটা ভাষার এক এক ধরন থাকে। ভিন্ন সংস্কৃতি দিয়ে তা বোনা হয়। ডেইজি রকওয়েল আমাদের সংস্কৃতির ঘেরাটোপেই ইংরেজি চরিত্রগুলোকে বসিয়েছেন। এবং তা এতই দক্ষ হাতে করেছেন যে পড়তে পড়তে পাঠকের নানারকম অনুভূতি হবে। জীবন নামক এই যে যাত্রা তার মধ্যে উত্থান ও পতন অবশ্যম্ভাবী। আশা আর হতাশার দোলাচল আমাদের ঘিরে থাকে সর্বক্ষণ। আর এই ওঠাপড়াই জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। আমি সেই স্বাদই পাঠককে দিতে চেয়েছিলাম বইটির মাধ্যমে। এটা কোনও একজন ব্যক্তির গল্প নয়। বরং একটা সর্বজনীন অনুভূতি। যা আমি, আপনি আমরা সবাই জীবনের কোনও এক পর্যায়ে এসে অনুভব করি। বুকারের স্বীকৃতি সেই অনুভূতির গণ্ডিটা আন্তর্জাতিক করে তুলেছে। এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দ।’