পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
মেঘা বিবাহিত। দু’টি সন্তান। স্বামী অনির্বাণ কর্পোরেট কর্মচারী। বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি, দুই কন্যা ও স্বামীর দেখভাল, পারিবারিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ— ব্যস্ত জীবনে নিজের প্রতি যত্নশীল ছিল না সে মোটেও। শরীর যে ভেঙে যাচ্ছিল সেদিকেও খেয়াল করেনি। যখন বুঝতে পারল তখন বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। ইউটেরাইন ক্যান্সার থার্ড স্টেজ। বছর চারেক প্রচণ্ড লড়াই। তারপর সব শেষ।
ঘটনাটির মোটামুটি বছর খানেক বাদে মেঘার মামাতো বোনের সঙ্গে অনির্বাণের দেখা। মামাতো বোনটি সমব্যথী হয়ে বলল, মেঘাকে ছাড়া গোটা সংসারের ভার সামলাতে অসুবিধে হচ্ছে নিশ্চয়ই। অনির্বাণের অবাক ও অনায়াস উত্তর, আলাদা করে অসুবিধে তেমন হচ্ছে না। কাজের লোকের টাকা বাড়িয়ে দিয়ে, বাবা মায়ের জন্য আলাদা আয়ার ব্যবস্থা করে এবং দুই কন্যাকে স্কুল বাসে যাতায়াতের বন্দোবস্ত করে দিব্যি চলে যাচ্ছে। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। এই তো জীবন!
দ্বিধা কেন?
আজও আমরা মেয়েরা নিজেদের দেখভালে সময় কাটাতে কুণ্ঠা বোধ করি। এযুগের শিক্ষিত মেয়েরাও এই নিজস্ব সময় নিয়ে ততটা মাথা ঘামান না। অনেকে হয়তো ওয়াকিবহালই নন। যাঁরা জানেন, তাঁরাও এই সময়টা কীভাবে কাটাবেন তাই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।
‘মি টাইম’ বা নিজস্ব সময় প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ‘আ রুম অব ওয়ান’স ওন’-কে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তিনি বলেছিলেন, প্রতিটি মহিলার জীবনেই এমন কিছু মুহূর্ত থাকে যা অন্য কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। বরং নিজের মধ্যে অনুভব করতে হয়। আর সেই যে মুহূর্ত অনুভব করার সময় সেটাও একান্ত ব্যক্তিগত। এযুগের পরিভাষায় ‘মি টাইম’ বা নিজস্ব সময়। এই ‘মি টাইম’ নিয়ে কথা হচ্ছিল মনস্তত্ত্ববিদ ডাঃ রীমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণে ‘স্পেস’ শব্দটা এখন প্রাচ্যেও বহুল প্রচলিত। আর সেই স্পেসই আমাদের জীবনের ‘মি টাইম’ বা নিজস্ব সময়। দুঃখের বিষয় হল সমাজ অনেক এগিয়ে গেলেও মেয়েরা আজও যেন ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’। তাই তাঁদের সব আচরণের কৈফিয়ত দিতে হয়। এবং সেই কৈফিয়তের ঠেলায় তাঁদের নিজস্ব সময় বের করে নেওয়া অপরাধে পরিণত। কিন্তু যুগ বদলাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে মেয়েদের জীবন যাপনের পদ্ধতি। তাই ব্যস্ত জীবনে সামান্য একটু ‘মি টাইম’ এখন প্রতিটি মহিলারই প্রয়োজন।’
সাধারণ ধারণা
সাহিত্যিক বিনতা রায়চৌধুরী বললেন, ‘নিজের সময় একটা অত্যন্ত সাধারণ জিনিস। এবং সেই সময় সমাজে সকলেরই দরকার। কিন্তু যত প্রশ্ন, মহিলাদের ক্ষেত্রে ওঠে। আর সামাজিক এই ভ্রূকুটির ফলে কিছু মহিলার মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। কিন্তু মহিলাদের এই অপরাধবোধের আবার তারতম্য রয়েছে। সামাজিক ধারণা অনুযায়ী আজও ধরেই নেওয়া হয় সংসার রমণীর গুণেই সুখের হয়। ফলে সংসারের যাবতীয় দায় মেয়েদের কাঁধে। এবার যে মহিলা সেই দায়িত্ব সামলে নিজের জন্য সময় বার করতে পারেন, তাঁর মনে কোনও অপরাধবোধ কাজ করে না। আর যদি সংসারের সময় থেকে ‘চুরি’ করে কোনও মহিলা নিজস্ব সময় বের করেন তাহলে তিনি একটু মানসিক দ্বন্দ্বে ভোগেন। অনেকে আবার সংসারে সময় না দিয়ে নিজের জন্য সময় বের করেন, তাঁদের অপরাধবোধের ধরনটা একেবারেই ভিন্ন। কিন্তু এই সংখ্যাটা খুবই সীমিত। তবে এই অপরাধবোধ কতটা হবে সেটা অনেকটাই আবার পারিপার্শ্বিকের উপরেও নির্ভর করে।’
‘মি টাইম’-এর ধরন
‘এই যে নিজের জন্য নিজস্ব সময় বের করে নেওয়া এটা অনেকগুলো জিনিসের উপর নির্ভর করে,’ বললেন রীমা। তাঁর মতে, ‘প্রথমত মেয়েটির মানসিকতা একটা বড় ফ্যাক্টর। সে আদৌ এই ‘মি টাইম’ পেতে চায় কি না, সেটা দেখা দরকার। সে যে পরিবারে থাকে, তার স্ট্রাকচারের উপরও এটা অনেকটা নির্ভর করে। অনেক সংসার এমনও রয়েছে যেখানে শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভালটা পুত্রবধূর কর্তব্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এই ধরনের খুঁটিনাটি কাজ সামলে মহিলারা নিজেদের জন্য সময় বের করতে পারছেন কি না, সেটাও বিবেচ্য। অনেক আধুনিক মেয়েরও মানসিকতা এমনভাবে তৈরি হয়ে যায় যে তার জীবনে এই নিজস্ব সময় ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। কিন্তু তাই বলে এই ধরনের মহিলাদেরও যে এই নিজস্ব সময়টার প্রয়োজন নেই তা কিন্তু নয়,’ বলছেন রীমা। সুযোগ ও সচেতনতার অভাব থেকে সারা জীবনে হয়তো এই ‘মি টাইম’-টা নেওয়া হয়নি কোনও মহিলার। তাই বুঝি জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে তাঁদের এত অবসাদ, এত অপূর্ণতা। এমন অনেক মহিলা রীমার কাছে আসেন যাঁরা মাঝবয়সে এসে উপলব্ধি করেন তাঁদের জীবনে কিছুই করা হল না। সারাটা জীবন অন্যর তরে ব্যয় না করে যদি টুকরো টুকরো মুহূর্ত নিজেদের জন্য তুলে রাখতে পারতেন তাহলে হয়তো এই হতাশা বা অবসাদ আসত না জীবনে।
সহযোগিতার অভাব
আমাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরাও মেয়েদের এই ‘মি টাইম’ বিষয়ে মোটেও সচেতন নন। তাই তো আজও গৃহবধূদের তাচ্ছিল্য করে তাদের স্বামীরা অনায়াসে বলতে পারে, ‘এটুকু কাজ করে রাখতে পারোনি! সারাদিন কী করো?’ আর এই ধরনের মন্তব্য শুনতে শুনতে বোধহয় মেয়েরাও অভ্যস্ত হয়ে যায়। নিজেদের বলে যে কিছু থাকতে পারে, তা তারা ভাবতেই পারে না। তাই এখনও ‘মি টাইম’-এর ধারণাটা আমাদের সমাজের অধিকাংশের কাছে অপরিচিত।
চাহিদা বদলায়
শ্রেণিভেদে নিজস্ব সময়ের চাহিদায় প্রচুর বদল হয় বলে জানালেন বিনতা রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘সমাজের নিচু শ্রেণির মহিলাদের তো কাজের শেষ থাকে না। তাদের ফুরসত নেই। এমনকী নিজেদের বাড়িতেও একটু জায়গা নেই। বাইরের জগতে জায়গার অভাবটাই তাদের জীবনের অঙ্গ হিসেবে মেনে ও মানিয়ে নিয়ে চলতেই তারা অভ্যস্ত। ফলে তাদের মধ্যে মানসিক ‘মি টাইম’-এর চাহিদাই তৈরি হয় না। তবু তারও মধ্যে এই নিম্নবিত্ত শ্রেণিতেও কিছু মহিলা থাকেন যাঁরা কাজের ফাঁকে ফাঁকেই নিজস্ব একটু সময় বের করে নিতে চান। তবে সেই সময়টা তাঁরা কোনও সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় করেন এমন হয়তো নয়। বরং ‘পরনিন্দা পরচর্চা’ করে কাটাতেই হয়তো তাঁদের ভালো লাগে। মধ্যবিত্তদের মধ্যেই এই ‘মি টাইম’-এর চাহিদা এবং না পাওয়ার হতাশা বা পেলেও তা নিয়ে অপরাধবোধ — এই সবকিছুই সবচেয়ে বেশি। কারণ তাঁদের জীবনের লড়াইটাই ভিন্ন। তাঁরা শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক। অথচ তাঁদের সামাজিক বিভিন্ন বাধানিষেধের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ফলে জীবনের টানাপোড়েনও তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হয়। তাঁরা চান, অথচ সব সময় যে পান তা নয়। আর সেই না পাওয়া থেকেই তৈরি হয় হতাশা, মন খারাপ।
মানসিক প্রয়োজন
‘আমাদের মানসিক সুস্থতার জন্য ‘মি টাইম’ ভীষণ জরুরি,’ বললেন রীমা। তিনি মনে করেন, নিজস্ব সময় যদি প্রথম থেকে নেওয়া যায় তাহলে মানসিক অবসাদ আসে না। মনে মনে একটা উৎফুল্ল ভাব থাকে। কিন্তু অনেক পরিবারেই মনে করা হয় চাকরিরত মহিলারা প্রিভিলেজড। তারা নিজেদের জন্য দিনের সিংহভাগ কাটানোর সুযোগ পান। অতএব তার পরেও আবার ‘মি টাইম’ কেন? এটা কিন্তু চূড়ান্ত ভুল ধারণা। চাকরির সময়ের সঙ্গে কখনওই ‘মি টাইম’-কে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। একজন পুরুষের যদি চাকরির পর দিনের শেষে পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেওয়ার অধিকার থাকে তাহলে মহিলারও ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এটা সমাজকে মেনে নিতে হবে। সবসময় যে বন্ধুবান্ধব নিয়ে সময় কাটাতে হবে তাও নয়। নিজের চাহিদামতো সময় কাটানোর অধিকার একজন মহিলার আছে। সমাজ ও মেয়েরা এই সহজ সত্যটা মানতে পারলেই মঙ্গল।
কী করবেন?
অনেক মহিলা ভাবেন নিজের জন্য সময় পেলেই বা তা দিয়ে কী করবেন? নিজের যা ভালো লাগে তাই করবেন। বাগান করুন, গান শুনুন, বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, রূপচর্চা করুন, যোগাসন করুন, ভালো মন্দ রান্না করুন। বা কিচ্ছু না করে শুধু প্রকৃতির শোভা দেখুন। বন্ধুদের সঙ্গে কফি ডেটে বেরন। সিদ্ধান্ত আপনার। এই সময়টা নিজেকে ভালো রাখার জন্য।
ক্রমশ বাড়ছে সচেতনতা
সুসংবাদ এই যে এ যুগের মহিলারা নিজস্ব অধিকারগুলোর প্রতি ক্রমশ ওয়াকিবহাল হচ্ছেন। এবং এটা অনেকটাই মহিলাদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার ফল। শিক্ষার সঙ্গেই এসেছে সচেতনতা। আর নিজের অধিকারের কথা জোর গলায় বলার সাহস জুগিয়েছে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। ফলে এযুগের শিক্ষিত মহিলারা নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়েছেন এবং সেই সচেতনতা থেকেই নিজের জন্য খানিকটা সময়ের দাবি তাঁরা জানাতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্যের প্রভাবও একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে এই ‘মি টাইম’-এর ক্ষেত্রে। গোটা পৃথিবীটাই যখন একটা গ্লোবাল ভিলেজ তখন তার আনাচেকানাচে কোথায় কী ঘটছে সবই আমরা দেখছি, জানছি। বিদেশি জীবনযাত্রা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করছি। এবং সেই জীবন অনুকরণের চেষ্টাও করছি। আর সেই চেষ্টার ফলস্বরূপ নিজেদের জন্য সামান্য একটু সময়ের দাবিতে সরব হয়ে উঠছি।
লড়াইটা তবুও চিরন্তন
বিনতা কিন্তু বললেন, ‘যুগ বদলের পরেও মেয়েরা আজও সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণিতেই রয়ে গিয়েছেন। ফলে তাঁদের লড়াই চিরন্তন। এই কারণেই মেয়েদের আরও বেশি মাত্রায় নিজস্ব ব্যক্তিত্বকে পালিশ করা দরকার। মেয়েরা নিজেদের ব্যক্তিত্বে অটল থেকে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই একমাত্র তাদের গুরুত্ব স্থাপন করা সম্ভব হবে।’ আশার কথা এই যে, যুগ বদল ও সচেতনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই মহিলাদের আচরণও অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। এবং সেই পরিবর্তিত আচরণের ভরসাতেই মেয়েরা হয়তো নিজেদের যোগ্য সম্মান পাওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
সম্পূর্ণ স্বাদ
নিজস্ব সময় মেয়েদের অধিকার। নারী স্বাধীনতা বা ক্ষমতায়নের মতোই এটাও খুব দরকারি। এর জন্য কীসের অপরাধবোধ? বরং সমাজকে বোঝানোর সময় এসেছে যে এই নিজস্ব সময় মহিলাদের ভালো থাকার রসদ। আর সকলে ভালো থাকলে তবেই তো সংসার সুখের হবে। ‘মি টাইম’-এর সম্পূর্ণ স্বাদ নিন। জীবনটা যাপন করুন তারিয়ে তারিয়ে।