কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
পৃথা মুখোপাধ্যায়, দেবারতি গোস্বামী, ঝুমা ভদ্র, সম্প্রীতা দাস ও বিদিশা দত্ত। এঁরা সকলেই সুদূর ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। তবু সকলেরই মন পড়ে আছে বাংলায়। আর সেই কারণেই বাংলার নানা ঐতিহ্য বিদেশে তুলে ধরছেন তাঁরা। তাঁদের এই দলটির নাম বেঙ্গল হেরিটেজ এবং তাঁদের এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের যে প্রকল্প তাঁর নাম লিভিং ব্রিজ। তাঁরাই বাংলা ও ইংল্যান্ডের মাঝে এক জীবন্ত সেতু গড়ে তুলছেন ক্রমশ। তবে এই সেতুবন্ধনের কাজে তাঁদের সঙ্গে কয়েকজন পুরুষও রয়েছেন। যাই হোক, এই যে সংরক্ষণ ও তার প্রদর্শন, এতে বিদেশে দীর্ঘদিন বসবাসকারী বাঙালিরা তো আগ্রহী হচ্ছেনই, বহু বিদেশিও কিন্তু বাংলার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে চাইছেন। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন লিভিং ব্রিজের অন্যতম সদস্য বিদিশা দত্ত। সংরক্ষণের এই বিষয়টি নিয়ে যে আদৌ কাজ করা যায় বা তা সুদূর ইংল্যান্ডে তুলে ধরা উচিত এমন চিন্তা মাথায় এল কেন? বিদিশা বললেন, ‘দুটো কারণ। প্রথমত বিদেশে থাকলেও বাংলার প্রতি একটা প্রচণ্ড টান মনে মনে অনুভব করতাম সবসময়। বাংলার এই বিপুল ঐশ্বর্যর সঙ্গে বিদেশিদের একটু পরিচয় ঘটাতে চেয়েছিলাম। সেই থেকেই একটা ছোট প্রয়াস শুরু করি। দ্বিতীয় কারণ, বিদেশিদের দেখে নিজেদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার লোভ হয়। ওদের দেখে শেখা উচিত কীভাবে নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাড়ি বা সৌধ বা স্মৃতিকেও ওরা প্রাণপণে সংরক্ষণ করে। সেটা দেখেই প্রথম মনে হয়েছিল আমাদেরও তো এত ঐশ্বর্য, আমরাই বা তাহলে সেগুলোকে বাঁচাতে পারব না কেন? ভাবনাটা এইভাবেই এসেছিল মনে।’
বাঙালি আর দুর্গাপুজো এই দুটো জিনিস যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই বিদিশাদের বিদেশে বাংলার ঐতিহ্যের প্রদর্শনও শুরু হয়েছিল সেই দুর্গাপুজো দিয়ে। ২০০৯ সালের শরতে ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যপূর্ণ ইলিংটন টাউন হলে বেঙ্গল হেরিটেজের প্রথম দুর্গাপুজোটি অনুষ্ঠিত হয়। আর দুর্গাপুজো মানেই মহিলাদের বিপুল সমাগম। দেবী বরণ থেকে বিসর্জন সব কাজেই মহিলাদের অংশগ্রহণ জরুরি। অতএব প্রথম থেকেই মহিলারা এই কাজে নিজেদের একশোভাগ ঢেলে দিয়েছিলেন। সেবার দুর্গাপুজো হওয়ার পর এবং লোকের অসম্ভব আনন্দে অংশগ্রহণ দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন যে বিদেশে এই ধরনের অনুষ্ঠান খুবই আদৃত। ফলে শুধু দুর্গাপুজোই নয়, বাঙালি অন্যান্য পার্বণেরও কদর কিছু কম হবে না। সেইসব পার্বণগুলো তুলে ধরতে গিয়েই পাশাপাশি আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক বিদেশিদের কাছে তুলে ধরেছেন বিদিশারা।
তাঁদের অন্যান্য কাজের মধ্যে টেরাকোটার মন্দির সংরক্ষণ, সেই মন্দিরের সূক্ষ্ম কারুকাজ বিষয়ে বিদেশিদের অবগত করা বা আমাদের মাদুর, গয়নাবড়ি, নকশিকাঁথার মতো ঐশ্বর্যকে বিদেশের মাটিতে তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে। এর জন্য নানা ধরনের মেলার আয়োজন করেন তাঁরা। বাংলার সেরা সম্পদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন তাঁরা পালন করেন একটু ভিন্নভাবে। ইংল্যান্ডের নেহরু সেন্টারে প্রতি বছর পঁচিশে বৈশাখ পালিত হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী। সেখানে নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক বা নৃত্যনাট্য তো অনুষ্ঠিত হয়ই, এছাড়াও দু’বছর আগে একটি ভিন্ন স্বাদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন বেঙ্গল হেরিটেজ গ্রুপেরই এক সদস্য। তিনি নিজেই নাটক এবং চিত্রনাট্য লেখেন। তিনি ‘প্রেরণা’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবনের এমন কয়েকজন নারীকে কেন্দ্র করে, যাঁরা বিভিন্ন সময় কবির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন।
এরপর বাংলার বিভিন্ন শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন বিদিশারা। প্রথমটা ছিল বালুচরি শাড়ি। বিদিশা বললেন বালুচরি শাড়ির সুতোর কাজের মধ্যে দিয়ে কীভাবে বাংলার ইতিহাসের টুকরো টুকরো গল্প বলা হয় সেটা বোঝানোর জন্য দলের সব মহিলা সদস্য প্রথমে বিষ্ণুপুর থেকে নিজেদের জন্য বালুচরি শাড়ি কিনে আনেন। তারপর সেই শাড়ি পরে নিজেরাই র্যাম্পে হেঁটে ফ্যাশন শো করেন। এবং প্রতিবার হাঁটার সঙ্গে বাজনার বদলে বালুচরির সামান্য ইতিহাস বর্ণিত হয়। বিদেশের মহিলারা তা দেখে এই শাড়ি তো বটেই, এমনকী এই শিল্পের প্রতিও আগ্রহী হন। এবং এইভাবেই বালুচরি শিল্পকে বিদেশে জনপ্রিয় করার একটা চেষ্টা করে বেঙ্গল হেরিটেজ। এরপর এই ফ্যাশন শো-টাই দুর্গাপুজোর একটা ট্র্যাডিশন হয়ে ওঠে। পুজোর মধ্যে একটা দিন বাংলার বিভিন্ন ফ্যাব্রিক এবং টেক্সটাইল পরে ফ্যাশন শো-এর আয়োজন করেন লিভিং ব্রিজের সদস্যরা। এবং প্রতিবারই শাড়িটা সম্পর্কে, শাড়ির বুনন শিল্প সম্পর্কে এবং কাপড়ের গুণগত মান সম্পর্কে বর্ণনা থাকে সেই ফ্যাশন শো-তে। গল্পের মতো বর্ণনা করে বলা হয় যাতে দেশি বিদেশি সকলেরই সেটার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
এরপর এল পটচিত্রের কাজ। কালীঘাট থেকে পটচিত্র শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে পটচিত্রের মেলার আয়োজন করা হয়। সেগুলো বাঁধিয়ে সাজানো হয়, কেনার সুযোগ দেওয়া হয় এবং বেশ কিছু শিল্পীকে ইংল্যান্ডে নিয়েও যাওয়া হয় যাতে তাঁরা নিজেদের কাজ ও সেই কাজের সঙ্গে জড়িত ঐতিহ্যের গল্প সুদূর বিলেতে পৌঁছে দিতে পারেন। অনেক পটচিত্র শিল্পী এই প্রয়াসের মাধ্যমে লাভবানও হন। তাঁদের কাজ বিক্রি হয়, পরিচিতি বাড়ে, কেউ বা বিদেশি অর্ডারও পান। এইভাবেই মাদুর শিল্প নিয়েও কাজ করেছে বেঙ্গল হেরিটেজ গ্রুপ। দু’বছর আগে একইভাবে বাংলার কাঁথা শিল্পকেও তুলে ধরেন তাঁরা বিদেশের মাটিতে। আফরোজা খাতুন নামে এক কাঁথা শিল্পীকে বাংলা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে এবং তিনি তাঁর হাতের কাজ প্রদর্শন করেন, সেই কাজের সম্বন্ধে লন্ডনবাসীকে জানান এবং সেই মতো লোকে তা দেখে যাচাই করে কিনে নিয়ে যান।
এছাড়াও সারা বছরের একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন বিদিশারা। সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শরতে দুর্গাপুজো, গ্রীষ্মে রবীন্দ্রজয়ন্তীর পাশাপাশি বসন্তে ফাগুন ফেস্টও আয়োজিত হয়। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য বাংলার লোকসংস্কৃতিকে ইংল্যান্ডে তুলে ধরা। যেমন একবার বাউল শিল্পীদের নিয়ে গিয়ে তাঁদের দিয়ে অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন বিদিশারা। আবার কখনও ছৌ নৃত্যের আয়োজনও করেছেন । গ্রীষ্ম, শরৎ, বসন্ত সবই যখন হল তখন শীতই বা বাদ যায় কেন? শীতের অনুষ্ঠান হিসেবে পৌষমেলার আয়োজন করেন বিদিশারা। পৌষ মানেই পিঠে। কিন্তু নারকেল, গুড় আর চালের গুঁড়োর এই মিষ্টিমধুর কম্বিনেশন ক্রমশ কেন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সেই পিঠেকেই তুলে ধরার জন্য দলের মহিলারা নানা ধরনের পিঠে বানান। পিঠের অতুলনীয় স্বাদের প্রতি বাঙালি ছাড়া বিদেশিরাও যে আকৃষ্ট হন তা তো বলাই বাহুল্য।
এইভাবেই বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্যকে সাংস্কৃতিক মোড়কে মুড়ে ইংল্যান্ডে প্রদর্শন করেন বেঙ্গল হেরিটেজের সদস্যরা। বাংলার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এই উল্লেখযোগ্য প্রয়াসে অবশ্য অনেক সংস্থাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে এইচএসবিসি ব্যাঙ্ক, ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান উল্লেখযোগ্য। বিদিশা জানালেন, কিছুটা পথ এগিয়েছেন। কিন্তু এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। তবে বাঙালির ঐতিহ্যকে জগৎ সভায় তুলে ধরার অদম্য প্রয়াস তাঁরা সফল করবেনই। ক্রমশ বিদেশে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মও এই কাজে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এবং এটাই আশার কথা।