ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
সত্যিই কম ঝক্কি এই বিয়ে নামক বস্তুটিকে ঘিরে! নিন্দুকে বলবে, নেই কাজ তো খই ভাজ। এই যেমন হবু কনে টুপুর রানির মত হল, রেজিস্ট্রি ম্যারেজটাই আসল বিয়ে। একান্ত যদি বিয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে বৈদিক মতে বিয়েটা ভালো অপশন।
কিন্তু বেচারি টুপুর, বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের মুখের উপর যথেচ্ছ কালি ছিটিয়েও পূর্বসূরীদের কাছে এই একটা জায়গায় হেরে গিয়েছে। তাই ওর এখন দশকর্মা, বরণডালা, এয়ো, আইমুংলি সংক্রান্ত বিষয় আর তত্ত্বতালাশের চক্রব্যূহে পড়ে একেবারে প্রাণান্তকর অবস্থা।
উদ্ধারণ দত্ত পরিবারের সেজ তরফের মেজ গিন্নী মীরাদেবীর এখন বয়স প্রায় বিরানব্বই ছুঁই ছুঁই। মেয়ের ঘরে নাতি-নাতনিদের সব বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন সবেধন নীলমণি বলতে ওই একটিই, সে হল টুপুর, মানে একমাত্র ছেলের একটি মাত্র কন্যা শাল্মলী দত্ত। ছোট থেকে মিশনারি স্কুলে পড়েছে, তাই ওর বেড়ে ওঠা বেশ কিছুটা অ্যাংলো পরিবৃত। পূজাআচ্চা নিয়মকানুনের ধার ধারে না।
তবে, অন্তত বিয়ের ক্ষেত্রে বাঙালিদের এই মালাবদল, সিঁদুরদান, খই পোড়ানো, কড়ি খেলার রীতিনীতিগুলো ওর কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক, ইন্টারেস্টিং। তাই নিজের বিয়েতে করব না, মানব না গোছের মন্তব্যগুলো সাময়িকভাবে দেরাজে তুলে বাড়ির আধাবাধ্য হবু কনের মতো আচার-অনুষ্ঠানে খানিকটা মেতে উঠেছে। এমনকী পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের দিন সাতেক আগে থেকে রোজ স্নান করার আগে গায়ে হাতে পায়ে হলুদ বাটা লাগানো থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক কুলদেবতা প্রণাম ইত্যাদি কোনওটাই বাদ দেয়নি। একটু আগেই দুপুরে ঠাম্মি ওঁর পুত্রবধূর কাছে হিরে–পান্নার সেট নিয়ে এসেছিলেন দেখাতে। নাতনিকে দেবেন বলে। বিয়ের সময় নাকি বাড়ির ট্র্যাডিশন অনুযায়ী যে কোনও পুরনো পারিবারিক গয়না উপহার দেওয়ার রেওয়াজ আছে। এছাড়া সিঁদুর পরানোর আগে পর্যন্ত কনের মাথায় একটা হীরের মুকুট পরানো হয়ে থাকে। একবার সিঁদুর পরানো হয়ে গেলে ‘লজ্জাবস্ত্র’ নামের একটি নতুন লালপাড় টাঙ্গাইল শাড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলতে হয়। এসবই বাপের বাড়ি থেকে দেওয়ার রেওয়াজ। কারণ হিসেবে বলা যায় মেয়ে যখন অবধি অবিবাহিত তখন সে মুকুট পরে রাজকন্যা। পরে একমাথা সিঁদুর পরে সেই–ই আবার ঘরের বউ। এখানে সিঁদুর ব্যাপারটা যেন কুমারী থেকে বিবাহিতা হওয়ার একটা মস্ত সাঁকো।
‘তোমরা, মানে এখানকার মেয়েরা আর ছেলেরা সব নিয়মকানুনগুলো মানো না বটে, সেজন্যই বোধহয় বিয়েও ভাঙছে চটজলদি। নারায়ণ সাক্ষী করে সব নিয়মকানুন মেনে বিয়ে করার একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে। পান থেকে চুন খসলেই কিন্তু সব অনর্থ হয়ে যাবে।’ ওপাশের ঘর থেকে আদরের নাতনির বিবাহ সংক্রান্ত অ্যান্টি যুক্তি শুনতে পেয়ে কখন যেন তিতিরের শাশুড়ি মীরাদেবী গুটি পায়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন তা কেউই এতক্ষণ খেয়াল করেনি।
শাশুড়ির মুখ থেকে কথাগুলো প্রায় কেড়ে নিয়েই তিতির বলে উঠল, ‘ঠিক বলেছেন মা, সে যুগে বিয়েতে নিয়ম-কানুন মানার পিছনে একটা কারণ ছিল। এই যেমন কলাতলা বা ছাদনাতলায় মালাবদল হওয়ার পর বউ লুকিয়ে ফেলা আর তারপর হাত ধরে বর তার হবু বউকে সকলের মাঝখান থেকে উদ্ধার করে হাতে একটা হিরের আংটি পরিয়ে দেওয়ার যে রীতি প্রচলিত, তার মধ্যে কেমন যেন একটা রাক্ষস বিবাহ প্রথার প্রচ্ছন্ন প্রভাব আছে। তাই না?’
এবারে একটু নড়েচড়ে বসল টুপুর। বলে উঠলো, ‘মা রাক্ষস বিবাহ কী? জোর করে ধরে এনে বিয়ে করাকে কী রাক্ষস বিবাহ বলে?’
‘আমাদের বিয়ের ক্ষেত্রে যদিও জোর করার কথাটা সেভাবে খাটে না, সবই পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু একটা কথা সত্যি যে তোকে তোর হবু বর কিছু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কাছে পেল, তারপর যে সিঁদুর পরানোর ফিলিংটা ভাব— ব্যাপারটা কেমন রোম্যান্টিক তাই না?’
‘অবশ্যই রোমান্টিক মম, আর ভীষণ থ্রিলিং। আচ্ছা এরকম বাস্তবে কেন হয় না বলো তো?’ প্রতিপক্ষ হার মানছে বুঝে এবার মীরাদেবী স্বয়ং নাতনির সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ঢাল তলোয়ার নিয়ে নামলেন। ‘তাহলে চল যাই তোর দাদু আর আমার বিয়ের ছাদনাতলার সেসব দিনগুলোর কথায়। আমার বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে। বরের বয়স তখন ছাব্বিশ। খুব ভয় পাচ্ছি, পিঁড়ির ওপর বসে রোগা রোগা পা দুটো তখন আমার ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। শাড়ি সামলাব, গয়না সামলাব, নাকি নিজেকে সামলাব, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। এদিকে শুনতে পাচ্ছি ছাদনাতলা থেকে ভেসে আসছে হইহই আর হাসির আওয়াজ। ওদিকে একটানা সানাইয়ের সুর আর মানুষের কোলাহল ছাপিয়ে আমার মা, মানে যিনি পাঁচ এয়োর মধ্যে হেড এয়ো অর্থাৎ আইমুংলি হয়েছিলেন, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘হাতে দিলাম মাকু /একবার ভ্যাঁ করো তো বাপু...।’ আগে দেখা বিয়ের অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মরণ করে বুঝতে পারলুম আমার বরকে এখন ‘জামাইবরণ’ করার পালা চলছে। বেচারির হাতে তখন একটাই অস্ত্র তা হল একটা রুপোর যাঁতি। যেটা নিজের বাড়ি থেকে আসার সময় তার মা কড়ে আঙুল কামড়ে, থুতু ছিটিয়ে অস্ত্রটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো মনে মনে বলেওছিলেন, যাও পুত্র যুদ্ধক্ষেত্রে যাও। বিজয়ী হয়ে ফেরত এস।’
তিতির মাঝখান থেকে ফুট কাটল শাশুড়ির কথায়, ‘ওহো ছাদনাতলায় সে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বটে, মনে আছে, আমার বোনরা জামাইবাবুর চোখটাই কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল। তারপর আপনার ছেলে সকলের মধ্যিখান থেকে কীভাবে যেন আমার হাতটাই ধরল। পরে অবশ্য ওঁর কাছ থেকে জেনেছিলাম বিয়ের দিন সকালে সম্বন্ধ করার সময় আপনারা যে সেটিং-এর পান্নার বড়সড় আংটিটা দিয়েছিলেন আমার আঙুলে, সেটা ছুঁয়ে দেখে ও বুঝতে পেরেছিল যে আমিই সেই।’
শাশুড়ি বললেন, ‘আর আমি তো ছিলাম ছোট্টটি, শুনেছি আমার মাথায় আটকে থাকা কাজললতার ডাঁটিটা দূর থেকে কীভাবে যেন তোমার শ্বশুরমশাই দেখতে পেয়েছিলেন।’
‘ওয়াও রোমান্টিক! ঠাম্মি, তারপর শুনেছি কী একটা ফুল নাকি দু’জনে শুঁকতে হয়। তারপর সেটা এক বছর রেখে দিতে হয়?’
‘বাহ্ টুপুর তুই তো বেশ এতদিনে আমাদের কাছ থেকে বিয়ের আচার অনুষ্ঠানগুলো শুনতে শুনতে গিন্নি হয়ে গেলি!’ বলতে বলতে নাতনির লজ্জায় রাঙা চিবুকটাকে অল্প তুলে মীরাদেবী বলে উঠলেন, ‘ঠিক ধরেছিস, একে বলে ছাউনি নাড়া ফুল। মালা বদলের পর বর কনে একে অপরকে এই ফুলটা শোঁকায়। এটাই বিয়ের তুক বলতে পারিস। অনেকটা মানুষের দেহের নাভির মতো প্রাণকেন্দ্র, যাকে বলে বিয়ের ভরকেন্দ্র, যা হারিয়ে গেলে খুবই অশুভ। তাইতো সেটা সযত্নে এক বছর রেখে দিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হয়।’
‘এ তো গেল সাধারণ নিয়মের কথা, কিন্তু স্ত্রী আচার যেগুলো আছে, সেগুলোও তো মানতে হয় ঠাম্মি!’
‘হয় বইকি নাতনি। বিয়ের দিন আর বাসি বিয়ের দিন সকালে কড়ি খেলার কথাই ধর না— নিছক খেলা বটে কিন্তু এর মন্ত্রটা শোন। বর–বউ দু’জনকেই এয়োদের সঙ্গে খেলা করার সময় বলতে হয়, ‘লজ্জাশরম ঢাকি...’ আমি বলেছিলুম, বীরেন্দ্রবাবুর লজ্জা-শরম ঢাকি। আবার আমার ঠাম্মা আমাকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘বীরেন্দ্রর কোলে / মীরা রানি দোলে’। এরকম আরও কত কী...।
‘এগুলো বলতে পারিস স্ত্রী আচারকে সামনে রেখে বর–বউয়ের মনে ধীরে ধীরে ভালোবাসার বীজ রোপণ করা। মনে আছে মা, যখন এ বাড়িতে প্রথম আপনার ছেলের হাত ধরে এলাম, বাসি বিয়ের দিন রান্নাঘরে দুধ ওথলানো দেখলাম। তার আগে আলতা পায়ে থালার মধ্যে দাঁড়িয়েছিলাম যখন, তখন আপনারা আমাকে আদর করে কীরকম বরণ করে নিলেন। তারপর সদর দরজা থেকে আমার শোওয়ার ঘর অবধি একটা সাদা চাদরের ওপর পায়ের আলতার ছাপ ফেলে ফেলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। নিজেকে কিরকম যেন রানি মনে হচ্ছিল সেদিন।’
‘তুমি তো আমার সংসারের রানীই মা।’
‘বাসি বিয়ের দিন দু’জনের হাতের আঙুলে কাঁটা ফুটিয়ে রক্ত মিশিয়ে দেওয়ার সময় মনে আছে আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন যাতে আমার কষ্ট না হয়, একটুও না লাগে। এইসব কি ভুলে যাব মা?’
মায়ের আর ঠাম্মির সঙ্গে নানা কথোপকথনের মাঝে টুপুরের চোখ দুটো কেমন যেন ভারী আর ঝাপসা হয়ে উঠল। কাল বাদে পরশু ওর আইবুড়ো ভাত। নিতকনেকে পাশে বসিয়ে অতিথিদের সঙ্গে এক আসনে বসে মাথায় ফুলের ঝাড়া পরে ও মধ্যাহ্নভোজ সারবে।
বিয়ের দিন সকালে কলাতলায় ও দাঁড়াবে শিলের উপর। চারিদিকে সুতো দিয়ে বাঁধা থাকবে চারকোণে চারটে তীরকাঠি। চারিদিকে বসা পাঁচ এয়োকে ডিঙিয়ে পায়ের চাপে চার কোণে মাটির খুড়ি ওকে ভাঙতে হবে। এভাবেই আইবুড়ো নামটা সাঙ্গ হবে অধ্যাপক অনুরূপ সেনের স্ত্রী টুপুর ওরফে দেবাদ্রিতা সেনের।
কথাগুলো ভাবতেই বুকটা কেমন যেন তিরতির করে কেঁপে উঠল। মা, ঠাম্মা তখনও কত কথা নিজেদের মধ্যে বলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু টুপুরের আর ওসব শুনতে ভালো লাগছিল না। ওর এখন কিছুটা সময় একলা থাকার ইচ্ছে। চুপচাপ, নিজের মনে।
এতক্ষণ শোনা স্ত্রী আচার বা বিয়ের তথাকথিত নিয়মকানুনের সাজানো যুক্তিগুলো এখনও ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সত্যি, বিশ্বায়নের যুগে এগুলোর আর কি প্রয়োজনীয়তা আছে? নাকি সবই ভুল! তাই কি ওগুলো কালের নিয়মে বিলুপ্তির পথে?
হয়তো বা। বুক থেকে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল টুপুরের। আশেপাশে অনেক ধোঁয়াশা, অনেক বুদ্ধির হাতছানি, কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটাই লক্ষ্য বোধহয়— ভালো থাকার চেষ্টা। তাই ‘ছাউনি নাড়া ফুল’ নয়। সৎ ভাবে সহাবস্থানটাই সুখী দাম্পত্যের আসল চাবিকাঠি।
দূর থেকে শাঁখের ডাক ভেসে আসছে, বেশ লাগছে আওয়াজটা। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী যেন শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে মোবাইলও ঘন ঘন বেজে চলেছে স্ক্রিনে অনুরূপের ছবি।
‘হ্যাঁ বলো অনুরূপ।’
আচ্ছা অনুরূপকে কী ওর মনের অনুভূতির কথাগুলো জানাবে?
না থাক ওর মেয়ে–মনের ফ্যান্টাসি ওর কাছেই থাক। আর কারও সঙ্গে ও এই ভাবনাগুলো শেয়ার করবে না। আপাতত ও নিজের মনেই ডুব দেবে অতলে। হ্যাঁ পাবেই পাবে ঝিনুকের সন্ধান। স্ত্রী আচার বা নিয়মকানুনের সত্যিই কোনও গুরুত্ব আছে কি নেই তার বিচার করবে সময়। ফলাফলটা না হয় তার উপরেই ছাড়া রইল। টুপুর আরও কী কী সব ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা আরও শক্ত করে কানের কাছে ধরল...।