গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
হাসপাতাল, রোগী, অসুখ বা দুর্ভোগ তিনি প্রত্যক্ষ করেন ২০২০ সালে। সেইসময় তাঁর কাকা অসুস্থ হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। আর সেই থেকেই কোভিড আক্রান্তদের বাড়ির লোকের সেবায় মগ্ন হয়ে ওঠেন রচনা ধানধানিয়া। হঠাৎ রোগীর বাড়ির লোকের প্রতি এত দরদ কেন? আর কেমন সাহায্যই বা তিনি তাঁদের করেন? বিষয়গুলি নিয়ে বিস্তারিত জানালেন রচনা।
অসুখেই অনুপ্রেরণা
কাকা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি না হলে রোগের অসহায়তা হয়তো বা তেমনভাবে চোখেই পড়ত না কোনওদিন। তাই অসুখের মধ্যেই নিজের কাজের অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন রচনা। কাকা সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং রচনা তাঁর কাজের রসদ খুঁজে পেলেন। তাঁর কথায়, ‘কাকাকে ডিসচার্জ করাতে গিয়ে দেখি বহু লোক অসহায় অবস্থায় হাসপাতালের বাইরে বসে আছেন। তাঁদের বাড়ি-ঘরের ঠিকানা নেই, খাবারের জোগাড় নেই — উদভ্রান্তের মতো উশকোখুশকো চেহারায় রোগী-ডাক্তার করে যাচ্ছে।’ তখনই তিনি নিজের ড্রাইভারকে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরে চিত্রটা বোঝার চেষ্টা করেন। পিজি, বাঙুর, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল ঘুরে তিনি দেখেন রোগীদের চিকিৎসার কোনও গাফিলতি হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু রোগীর বাড়ির লোকের নাকাল অবস্থা। কোভিড ওয়ার্ডে ঢোকার কোনও অনুমতি নেই, এদিকে রোগীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও সকলের থাকে না। দূর-দূরান্ত থেকে যাঁরা আসেন তাঁদের থাকার কোনও ঠিকানা নেই, রাস্তায় রাত কাটাচ্ছেন কোনওমতে। আর খাওয়াদাওয়া কোনওদিন জুটছে, কোনওদিন জুটছে না। এমন অবস্থায় কে জানে কতদিন থাকছে রোগীর বাড়ির লোক। তার ওপর আবার মানসিক সংশয়। আদৌ কি বাড়ির মানুষটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে? এই ভয় আর আতঙ্কে নাওয়াখাওয়া তাঁদের মাথায় উঠেছে। তাই এঁদের অন্তত একবেলার খাদ্য সংস্থান করার চেষ্টায় লেগে পড়লেন রচনা।
ইচ্ছেই সম্বল
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রচনা। তাঁর পক্ষে যে অনেকের খাবারের জোগান দেওয়া খুব সহজ, তা নয়। তবে ইচ্ছেকে সম্বল করে কাজে নেমে পড়ার তাগিদ ছিল ষোলো আনা। প্রথম দিনটা কেটে গেল ১০০ জনের খাবারের রসদ জোগাড় করতে। তারপর বাড়ির রান্নাঘরেই ভাগে ভাগে তৈরি হল ভাত, ডাল তরকারি ইত্যাদি। সেই খাবার নিজের গাড়িতে তুলে প্রথম পিজি হাসপাতালে পৌঁছলেন রচনা। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন খাবারের জন্য অসংখ্য লোকের লাইন পড়েছে। তা প্রায় ৫০০ জন তো হবেই! এদিকে তিনি তো মাত্র একশো জনের মতো সংস্থান নিয়ে গিয়েছেন। ফলে খাবার দিতে না দিতেই শেষ। এবার চিন্তায় পড়লেন তিনি। রোজ পাঁচশো জনের অন্নসংস্থান কি একার পক্ষে সম্ভব হবে? তারপর বুঝলেন পাঁচশো জন মোটেও রোগীর পরিবারের নয়। খাবারের আয়োজন দেখে আশপাশের বস্তি থেকেও লোকজন জড়ো হয়েছে! কিন্তু রচনা নিরুপায়। সবাইকে খাওয়ানো তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাই পরেরবার একটা নিয়ম করলেন তিনি। শুধুমাত্র হাসপাতালের কার্ড দেখালে তবেই মিলবে খাবার। তাতে লোকসংখ্যা একধাক্কায় অনেকটা কমে গেল। এবং তিনি একাধিক হাসপাতালে খাবারের জোগান দিতে শুরু করলেন।
অর্থ জোগাড়
দু’-তিনদিন এইভাবে চলার পর টাকায় টান পড়ল। নিজের সঞ্চিত অর্থ প্রায় শেষ, এদিকে লোকের মধ্যে একটা আশা তৈরি হয়েছে। তাঁরা খাবারের আশায় রচনার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। তখন রচনার এক বন্ধু সহায় হলেন। নিজের থেকে কিছু টাকা দিয়ে আরও কয়েকদিনের মতো চাল-ডাল ইত্যাদি কিনলেন। আবারও শুরু হল রান্নাবান্না। আরও কিছুদিন চলার পর সেই রসদও একসময় ফুরিয়ে গেল। আবারও সেই হতাশার মুখোমুখি রচনা। এমন সময় তাঁর ৯ বছরের শিশুকন্যাটি হঠাৎই বলে, ‘কাজটা তো ভালোবাসার তাগিদেই হচ্ছে, সেই ভালোবাসার ওপর ভরসা করেই আমরা লোকের কাছে হাত পাতি না কেন?’ রচনার খুব মনে ধরল কথাটা। সেই থেকেই মিশনের নাম ঠিক হল ‘স্প্রেড লাভ’। সেই শিরোনাম নিয়েই একটি ফান্ডিং সংস্থা ‘কেটো’-র কাছে আবেদন জানালেন রচনা। সঙ্গে নিজের কাজের কিছু ছবিও জুড়ে দিলেন। এরপর দশ ঘণ্টার প্রতীক্ষা। তারপর উত্তর এল কেটোর কাছ থেকে। এবার ফান্ড রেজার বা টাকা জোগাড়ের জন্য লেগে পড়লেন তাঁরা আবার। প্রথমে শুধুই নিজের বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে কাজ শুরু করলেন। নিজের অফিস অঞ্চলেই লোকদের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করলেন। বড়বাজার এলাকা থেকে রাঁধুনি জোগাড় হল, ভাড়া করা হল ম্যাটাডোর। এবং শুরু হল নতুন উদ্যমে কর্মকাণ্ড।
লাফিয়ে বাড়ল ফান্ড
প্রথম দিকে আড়াইশো লোকের খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন রচনা। কিন্তু প্রচার থামাননি। রোজকার কাজের ছবি তুলে তা দিয়ে বিজ্ঞাপন করতেন অর্থ আবেদনের জন্য। সেবার কাজে অনেকেই ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন এবং আড়াইশো লোকের খাবারের সংস্থান একলাফে বেড়ে সাতশোয় গিয়ে ঠেকল। এত লোকের খাবার নিয়ে পিজি হাসপাতালে পৌঁছে দেখলেন সেখানে আরও অনেকেই খাওয়াচ্ছেন। রচনা ভাবলেন, পিজির বদলে অন্য হাসপাতালে যাবেন। এবার তিনি এনআরএস হাসপাতালে গেলেন। প্রাথমিক পুলিসি অনুমতি নিয়ে সেখানকার কোভিড ওয়ার্ডের রোগীদের পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। রচনাকে পেয়ে যেন হাতে স্বর্গ পেলেন তাঁরা। কতদিন সামান্য খেয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ মানুষটার খবরের অপেক্ষায় বসেছিলেন। খাবারের সংস্থান দেখে আবেগে ভেঙে পড়লেন অনেকেই। মাত্র আধ ঘণ্টায় সাতশো লোকের খাবারের জোগান শেষ হয়ে গেল। রচনা ঠিক করলেন শুধু পিজি নয়, ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নিজের সেবা বিতরণ করবেন তিনি। এইভাবেই এনআরএস, পিজি ছাড়াও চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে গিয়েও রোগীর বাড়ির লোকদের খাওয়ান রচনা। নিজের ইচ্ছা, উদ্যোগ, মনোবল আর ভালোবাসার ওপর ভর করে অসহায় লোকের সেবায় লেগে রয়েছেন। লোকের সংখ্যা বেড়ে ৯০০ থেকে ১০০০ হয়েছে। তবু অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন রচনা। বললেন, ‘অনেকের মধ্যেই ইচ্ছে রয়েছে, কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে সঠিকভাবে তা প্রয়োগ করার ক্ষমতা নেই।’
রচনার নেতৃত্বে অনেকেই এগিয়ে আসছেন সাহায্য নিয়ে। কেউ হয়তো চিকেন স্পনসর করছেন, কেউ মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন, কেউ গাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন, কেউ বা বাজারে সাহায্য করছেন। এইভাবেই রচনার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় পঁচাত্তর দিন হয়ে গিয়েছে তাঁর কাজের। এখনও অনেক পথ চলা বাকি। লোকের আশীর্বাদ আর নিজের ইচ্ছের ওপর ভর করে এভাবেই সকলের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান তিনি।