আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
‘দিদি একটু দেখো!’
‘স্যাচুরেশন কত?’
‘অক্সিজেন নিয়ে ৯৫।’
‘সরকারি না বেসরকারি?’
‘কথা বলে নিই...।’
‘ঠিক আছে তুই সরকারি রেজিস্ট্রেশনটা কর। আমি মডারেট ও ভালো ট্রিটমেন্ট হয়, এমন নার্সিংহোম দেখছি।’
‘ওকে দিদি।’
পিং পিং করে শব্দের পর শব্দ ভেসে উঠছে ল্যাপটপ ও মোবাইলের স্ক্রিনে। নেলপলিশ করা আঙুলগুলো বিরামহীন কি-বোর্ডের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাওড়ার সালকিয়ার সদ্য কলেজ পেরনো মনোনীতা কাঁড়ার এক কোভিড আক্রান্তের বেডের ব্যবস্থা করার জন্য আপ্রাণ লড়াই করছে। ওপাশে সুপর্ণা ঘোষ রায় সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট। কেউ কাউকে চেনে না। শুধু ওই দলগত হোয়াটসঅ্যাপে মুখটা চেনা। সালকিয়ায় বসে মনোনীতা যুক্ত হয়ে পড়েছে দাদা-দিদিদের হাত ধরে মানুষের হাত ধরার এক অজানা যজ্ঞে। বারাসতে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ফাঁকে ফাঁকে সুপর্ণা সারাদিন বিভিন্ন প্রান্তে কোভিড আক্রান্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বেডের কথা, অক্সিজেনের সংবাদ, খাবার, ওষুধ।
‘অদিতিদি একটু দেখবে!’
‘হ্যাঁ, বল।’
‘ব্যারাকপুরে বৃদ্ধ দম্পতিকে...।’
‘যোগাযোগ কর। নম্বর দে ওঁদের...।’
‘Anybody from Barrackpore, need help for elderly...’ পোস্ট করল আর এক গ্রুপে।
কিছুক্ষণ বাদেই স্ক্রিনে ‘হ্যাঁ বলুন!’
‘এক দম্পতিকে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিতে হবে দিদি। তুমি পারবে! তোমার এলাকায়।’
‘আমি রান্না করে দেব, কেউ একজন নিয়ে পৌঁছে দিক। আমি তো পারব না ভাই...।’
‘না না, দিদি তুমি এটুকু যে করলে সেটাই অনেক। একটি ছেলে তোমাকে ফোন করে নিয়ে আসবে, ওইই পৌঁছে দেবে। একা থাকো, সাবধানে দিদি।’
খড়দহের শিক্ষিকা অদিতি বন্দ্যোপাধ্যায় কবে যে কীভাবে ডোমজুড়ে অ্যানিমেশনের ছাত্রী তনিমা মণ্ডলের প্রিয় দিদি হয়ে উঠল, আবার ব্যারাকপুরের কাজরীদি কবে যে যুক্ত হয়ে গেল অদিতিদের সঙ্গে, কেউ জানে না। বারাসতের দেবযানী ভট্টাচার্য এখন শুধু তাকিয়ে দেখে টালিগঞ্জের দেবলীনার গোল লাবণ্যমাখা ছবিটির নীচে সবুজ ফুটকি আলোটা জ্বলছে কি না। ওই আলোটা জ্বলা মানেই ভরসার খবর। শুশ্রূষার বার্তা চলে যাবে বঙ্গের কোণে কোণে। কারও কাছে অক্সিজেনের ফোন নম্বর। শুধু ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়াই নয়। সেই ফোন আদৌ চালু কি না, আদৌ সেই ফোন নম্বর থেকে আর্ত কোনও সাহায্য পাবে কি না, ফোন করে দেখে নিচ্ছে সেটাও। সঠিক সাহায্য পাওয়ার পরেই তনিমা স্টেটাস দিল, ‘resolved’ বা ‘done’। তার সঙ্গে লাভ সাইন। তারপরেই ‘thank u aditidi’ ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। কেউ ধন্যবাদ দিলেই ‘ধুসস্’ লিখে দেওয়া তার অভ্যাস। টের পাওয়া যায় গালে খুশির টোল গড়িয়ে পড়ছে। কার জন্য খুশি? সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা একটি মানুষ হয়তো একটা বেড পেলেন, হয়তো একটু অক্সিজেন পেলেন, হয়তো বাড়িতে শুয়ে শুয়ে খাবার পেলেন, ওষুধ পেলেন। তার জন্যই খুশি ছড়িয়ে পড়ে। তৃপ্তির হাওয়া টুংটাং করে বার্তা বয়ে চলে যায় চন্দননগর, বর্ধমান, ডানকুনি, শ্রীরামপুর, হাওড়ার বিভিন্ন প্রান্তে।
এক একটা দল তৈরি করে রিসোর্স পুলের ডেটাবেস তৈরি করেছে এরা। শামিল হয়েছেন ডাক্তারবাবুদের একটি বিশাল দল। পুলে রয়েছেন তাঁরাও। টেলি-কনসালটেন্সি করানো হচ্ছে আক্রান্তদের। কিছু আঙুল কি-বোর্ডে খুঁজে চলেছে অবিরাম সঞ্জীবনী। বুলিয়ে দিতে চাইছে অসহায় আতঙ্কগ্রস্ত সারি সারি মুখের উপর আশ্বাসের পরশ।
অবিবাহিত চাকরিরত মেয়েদের সঙ্গে এই কাজে নেমে পড়েন গৃহবধূও! নৈহাটির তমালিকা পাত্র বললেন, ‘আমি রোজ ছ’জনের রান্না করে দিই। পাড়ার ছেলেরা দিয়ে আসে দু’টি পরিবারের জন্য। সেখানে সবার কোভিড!’ চন্দননগরের সমাদৃতা দত্ত পেশাগতভাবে সঙ্গীতশিল্পী। এখন খুঁজে চলেছেন মোবাইল স্ক্রিনে কোথায় কার আর্তির পোস্ট! যদি কিছু করা যায়! গৃহবধূ তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় আপ্রাণ খুঁজে চলেছেন একটা ফোন নম্বর। একটা হাত, যে পৌঁছে দেবে বিদেশে থাকা বন্ধুর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধ। মোবাইলে প্রেসক্রিপশনের ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে নিরুপায় চোখে। স্বাগতার এক বছরের ছেলে আর্য আবার বারবার হাত বোলাচ্ছে ল্যাপটপের উপর। ওকে সামলে স্বাগতা কোন্নগরের একজনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে অক্সিজেনের ফোন নম্বর।
মা যে তারাই। ‘মা’ শব্দটি আসলে একটি বোধ। এই বোধ কখনও জাগ্রত হয় আধুনিকা তরুণীর মনে কখনও বা বৃদ্ধা মহিলার মস্তিষ্কে। মায়েরা হাত বাড়িয়ে দিলেই অন্য একটা হাত এসে তা ধরে ফেলে। না বাড়ালে তো শুধু নিজের দু’টি হাতই পড়ে থাকে! আর মায়েরা হাত বাড়িয়ে দিলে অযুত-নিযুত হাত এগিয়ে এসে তৈরি করে এক অনন্য মানববন্ধন । মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানবতার মহোৎসব মায়ের ডাকেই থাকে। দেশমাতৃকা যে আজ হাঁপাচ্ছে শুদ্ধ বাতাসের জন্য। তাই মানব-মায়েরা নেমে পড়েছে আন্তঃসম্পর্কিত অন্তর্জালে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, হোয়াটসঅ্যাপে। সুস্থ হোক দেশমাতা। সকল মায়ের হৃদয়ে আজ এইটুকুই চাহিদা।
তাই তো সকালে উঠেই ঘুম চোখে ল্যাপটপ খুলে বসে তনিমা। ফোন চেক করে। হোয়াটসঅ্যাপে: no need of bed... he is no more...। গুম হয়ে যায়। ‘অথচ কালই যে আন্টির সঙ্গে কথা বলে সরকারি-বেসরকারি সব জায়গায় অনেক রাত অবধি চেষ্টা করে গিয়েছি একটা ভেন্টিলেশন সহ বেডের জন্য। আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল, জুনিয়র ডাক্তার সাম্যর কাছ থেকে। বলল, কাল সকালে ফাঁকা হবে। আন্টিকে চিনি না। শুধু হোয়াটসঅ্যাপে ফর্সা হাসিমুখ...।’
গুম হয়ে বসেই থাকে তনিমা। জানলায় একটি শালিক ডাকাডাকি করছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, I’ve failed. I’ve failed.
সায়নদা ফোন করে, ‘আমরা সবটা পারব না তনি, আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে চেষ্টা করতে পারি মাত্র। ওরকম গভীরভাবে জড়িয়ে গেলে হবে না। আমাদের টিম বসে গেলে যে
ক’জন যেটুকু সাহায্য পাচ্ছেন, তাও পাবেন না।’
‘টিম’। কত কত টিম কাজ করছে। এঁরা সংঘবদ্ধ হয়েছেন সংবেদ নামে একটি ছাতার তলায়। সেখানে কেউ কাউকে চিনতেন না, চেনেনও না পুরোপুরি। তবু অচেনা মুখগুলো একটাই মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ— উই শ্যাল ওভারকাম। মনখারাপ ঝেড়ে তাই উঠে পড়ে তনিমা। যোগাযোগ করে বারাসতের দেবযানীর সঙ্গে। সেখান থেকে তরঙ্গে তরঙ্গে শুশ্রূষার খবর পৌঁছে যায় দিকে দিকে।
পিং পিং। মনোনীতা আবার ক্লান্ত হাতে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা তুলে নেয় হাতে। মেসেজ— ‘আপনাকে আমি চিনি না। কিন্তু আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, অক্সিজেন চালু হয়েছে, অনেকটা সুস্থ...। আপনারা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আপনারাই তো আমাদের অক্সিজেন।’
চোখের কোণ দিয়ে তৃপ্তির নোনা জল গালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। সেই জলে নিশ্চিত বসুন্ধরা সুস্থ সুন্দর সবুজ হয়ে উঠবে। এই আশায় বুক বেঁধেছি আমরা সবাই। সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করতে চাইলে ফেসবুকে টাইপ করুন: #সংবেদ।