বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
নিজের জোরে
সমাজ এখনও মহিলাদের যে চোখে দেখে তাতে শিক্ষিত, চাকুরিজীবী হয়েও অনেক নারীই কোণঠাসা। বাস্তব অন্তত তাই বলে। তাহলে এমনিতেই যে নারী শিক্ষার আলো পাননি বা উপার্জনক্ষম নন, তাঁদের কী হবে? এমন প্রশ্নের মুখে দুর্গা খৈতান মনে করিয়ে দিলেন একটা জরুরি প্রসঙ্গ। তিনি বললেন, ‘নারী স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রের যে বাধার প্রাচীরটা রয়েছে, তা কিন্তু শিক্ষিত আর প্রান্তিকায়িত মহিলার মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করে না। আমার দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রান্তিক মহিলারা অনেকেই মুক্তচিন্তার অধিকারী। আবার তথাকথিত আধুনিক মহিলাদের মধ্যেও ভয়ঙ্কর পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব। তাই ওপর ওপর ‘আধুনিক’ হওয়ার সঙ্গে মানসিক গঠনের কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই। দুই স্তরের মহিলাকেই পিতৃতন্ত্রের শিকার হতে হচ্ছে। তার রূপটা শুধু পাল্টে যাচ্ছে।’
কী রকম? দুর্গা বোঝালেন, ‘খুব বড় চাকুরিরতা মহিলাও আমাদের কাছে এসে বলেছেন, তাঁর আয়ের সবটাই স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়। স্বামীও সমমর্যাদার পদে রয়েছেন। এমনটা আজকের দিনেই ঘটছে। বিয়ের ১০-১৫ বছর পরেও ওই মহিলা সেটা সহ্য করেই চলছিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাধা পেয়েছেন তিনি। এইভাবে চলতে চলতে এমন একটা পরিস্থিতি এল যখন, ওই মহিলার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল। তখন তিনি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলেন, আমাদের কাছে এলেন। তার আগে পর্যন্ত উনি মারাত্মক ইনসিকিউরিটিতে ভুগছিলেন। আমি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট, এই উপলব্ধি না থাকলে তাই মুশকিল। কেউ আমায় এসে বাঁচাবে, আমায় এগিয়ে নিয়ে যাবে বা ভালোবাসবে, তবে আমার জীবন চলবে, এই ভাবনা থেকে মেয়েদের বেরতে হবে। কোনও পুরুষের বিচারের যোগ্যতায় আমি বাঁচব না। এটাই আধুনিকতা।’
‘যিনি খুব সাধারণ কাজ করেন, তিনিও এই উপলব্ধিটা করতে পারেন। আমি বাড়িতে রান্নার পরিচারিকাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বলো তো তোমার জোরের জায়গাটা কী?’ তিনি বলেছিলেন, ‘নিজের বলটাই তো সব।’ স্বামী বা প্রেমিক বা অন্য কেউ সব নন, এই ভাবনা থেকে তিনি সহজেই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন আর নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন,’ কথাগুলো বলে দুর্গা জানালেন, তিনি নিজেও হয়তো এমন করে ভাবতে পারতেন না। তিনি হয়তো ওই প্রশ্নের মুখে পড়লে বলতেন, চাকরি বা শিক্ষার কথা। কিন্তু একজন পরিচারিকা যখন সহজেই আত্মবলের জায়গাটা অনুধাবন করেন, তাঁর থেকে সেটা শিক্ষণীয়। তাই জীবনের শিক্ষায় আধুনিকতা বা প্রথাগত পড়াশোনা কোনও মাপকাঠি নয় বলেই মনে করেন পেশায় বিচারক দুর্গা।
লড়াই কীভাবে
কিন্তু শুধু একা তো বাঁচা যাবে না। মেয়েদের বাঁচার রাস্তাটা তৈরি হবে কীভাবে? দুর্গার বক্তব্য, ‘স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে অনেকটা এগনো সম্ভব। একাকী মহিলাদের যেমন এমন গোষ্ঠী থাকতে পারে, তেমনই যৌন নির্যাতন বা হিংসার শিকার হয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরও গোষ্ঠী থাকতে পারে। এমন নানা গোষ্ঠীর মধ্যে যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার জায়গা তৈরি হবে।
আজ কারও বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে বলে সে যদি লজ্জিত হয়, তাহলে চলবে না। আরও কেউ যদি সেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়ে থাকে, তাকেও সেটা বুঝতে হবে। তাহলেই সমব্যথী হয়ে সবটা ভাগ করে নেওয়া সম্ভব। যত এমন গোষ্ঠী থাকবে, পারস্পরিক কথাবার্তা হবে ততই মঙ্গল। কারণ আমাদের যাত্রাপথ কিন্তু অনেকটাই এক। এটা ভাবলে কাউকে আর অপরিচিত মনে হবে না।’ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত সংস্কারজনিত মানসিকতা পাল্টানোর ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে উভয়ের পড়াশোনার দিকেই জোর দিচ্ছেন দুর্গা। শুধু প্রথাগত শিক্ষা নয়, লিঙ্গসাম্যের বোধটা তৈরি করতে হবে, বলছেন তিনি। বাড়িতে ছোট থেকে ছেলেমেয়েরা জানবে, মা এবং বাবাকে একইভাবে সম্মান করতে হয়। মা সারাক্ষণ কাজ করবেন, বাবা বিশ্রাম করেন, এটা কোনও লিঙ্গসাম্যের ধারণা তৈরি করতে পারে না। মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠের কথাও মাথায় রাখতে বলছেন তিনি। মোবাইলে স্পিড ডায়ালে ১০০ রেখে দেওয়া, রাতে বেরোলে সঙ্গে টর্চ, লঙ্কাগুঁড়ো রাখা। জুডো ক্যারাটে জানা থাকলে তো কথাই নেই। ধর্ষণের শিকার হলে কীভাবে প্রমাণ রক্ষা করতে হয়, এই প্রাথমিক সচেতনতাও দরকার। পরের লড়াইতে সেটাই সাহায্য করতে পারে।
হাত বাড়ালেই
‘স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি’ মেয়েদের কীভাবে সাহায্য করে? ‘এই সংস্থার এগজিকিউটিভ চেয়ারম্যান, বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়া থেকেই বলেন, মহিলাদের শক্তি বাড়াতে তাঁদের সাহায্য করুন। তাঁদের বহুদিন কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। এটা চলতে দেবেন না। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করি। জেনে রাখুন, লিগাল সার্ভিস অথরিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনও মহিলা বিনামূল্যে আইনি সাহায্য পেতে পারেন। তিনি যত উপার্জনক্ষমই হোন না কেন, সাহায্য পেতে বাধা নেই,’ বলছেন দুর্গা। এই সংস্থার আরও অনেক ভূমিকা আছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো তারা যৌনকর্মীদের বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে তাঁদের পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক ছিল না। কারণ এই ধরনের কর্মীদের অধিকাংশই আসেন পাচারের শিকার হয়ে, বা বাড়ির অত্যাচার থেকে পালিয়ে গিয়ে বা কারও হাতে বিক্রি হয়ে। তাঁদের পিতৃপরিচয়, স্বামীর পরিচয় নেই। আধার কার্ড নেই। পরিচয়পত্র দেখাবেন কোথা থেকে? তাহলে তাঁরা কি রেশন পাবেন না? সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ তাঁদের কাছে আশীর্বাদের মতো। দুর্গা বলেন, ‘নির্দেশ পালন করতে বলা হয়েছিল আমাদের। গত ১৬ অক্টোবর, ওয়ার্ল্ড ফুড ডে-তে সেই কাজটা করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে মাত্র ২৫ শতাংশ যৌনকর্মী এই সুবিধা পেয়েছেন। বুঝতেই পারছেন, একটা বড় অংশ সেটা পাননি। জেলা স্তরে কাজ করতে গিয়ে ‘স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি’-র কর্মীদের শুনতে হয়েছে, রেজিস্ট্রেশন ছাড়া যৌনকর্মীদের কীভাবে রেশন দেওয়া হবে? বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় তখন স্পষ্ট বলেন, তাঁদের আমরা বৈধতা দিলে তবে তো রেজিস্ট্রেশন থাকবে। সে বৈধতা দেওয়ার সাহস তো এই সমাজের হয়নি।’ এক দিনে ৫ হাজার যৌনকর্মীকে সাহায্য করেছে এই সংস্থা। পাশাপাশি ফুড কুপনও বিতরণ করা হয়েছে। উমপুনের পরে এই সংস্থা পৌঁছে গিয়েছে মৌসুনি দ্বীপেও। কারণ দুর্গারা জানেন, যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে মহিলাদের ওপরেই।
নির্যাতন বা হিংসার মধ্যে একলা থাকাটাই সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা। স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি সেই সব মহিলাকে জানাতে চায়, কেউই আর একা নন। এই সংস্থা সর্বক্ষণ তাঁদের পাশে আছে। যে কোনও লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বিরুদ্ধে লড়তে এই সংস্থা মেয়েদের আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করে দিতে পারে। এ বছরের মে মাস পর্যন্ত তারা অন্তত ৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ক্ষতিপূরণে।