মাঝে মাত্র চারটে দিন। তারপরেই দুর্গাষষ্ঠী। কুমোরটুলির পোটো পাড়ায় এখন ব্যস্ততা অনেকটাই। কোনও প্রতিমার গায়ে রঙের শেষ প্রলেপ পড়ছে, কেউ বা শাড়ি গয়না পরে মণ্ডপের পথে রওনা দেওয়ার জন্য রেডি। চলুন আজ এমন কয়েকজন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে আলাপ করা যাক, যাঁরা প্রথা ভেঙে প্রবেশ করেছিলেন এই পেশায়। হ্যাঁ, আমাদের গন্তব্য আজ কুমোরটুলির মহিলা মৃৎশিল্পীদের ওয়ার্কশপ।
চার দিনের পুজোর প্রস্তুতি কিন্তু সারা বছরই লেগে থাকে, জানালেন বর্ষীয়ান মৃৎশিল্পী চায়না পাল। তবে এ বছর তো গোড়াতেই গলদ। অতিমারীর কারণে দেশজুড়ে লকডাউন। কলকারখানা বন্ধ, কত মানুষ বেরোজগার। এমন পরিস্থিতিতে ঠাকুরের অর্ডারও পাচ্ছিলেন না কেউ। যাও বা কিছু অর্ডার এসেছিল, তা-ও বাতিল হল অধিকাংশই। আর বিদেশি পুজো? সে তো পুরোপুরি ভার্চুয়াল। অতএব বিদেশে প্রতিমা পাঠানোর আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তাঁরা।
চায়না পালের কথায়, একেই তো কুমোরটুলির পোটোপাড়ায় মহিলা মৃৎশিল্পীদের বরাবরই একটু বাঁকা চোখে দেখেন পুরুষ সহকর্মীরা, তার ওপর আবার এ বছরের পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম। ঠাকুর গড়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। তাই থিমের প্রতিমার দিকে নজর না দিয়ে লড়াই চালিয়েছেন বেঁচে থাকার জন্য।
প্রায় কুড়ি বছর ধরে কুমোরটুলিতে ঠাকুর গড়ছেন চায়না পাল। জানালেন, মহিলা মৃৎশিল্পীদের পরিস্থিতির খুব একটা যে পরিবর্তন হয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। সমাজের বাদ বাকি ক্ষেত্রে মহিলারা যতই উন্নতি করুক না কেন, কুমোরপাড়ার মেয়েরা কিন্তু খুব একটা এগতে পারেনি। সেখানকার পুরুষতন্ত্র তাঁদের এগতে দেয়নি।
বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথম ঠাকুর গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন চায়না। বললেন, ‘আমার বাবাও চাইতেন না মেয়ে এই পেশায় আসুক। বলতেন ঠাকুর গড়ার মতো ভারী কাজে মেয়েদের নাকি মানায় না। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁরই স্টুডিওয় ঢুকলাম। আমার পুরুষ সহকর্মীদের কথায় কান না দিয়ে ঠাকুরের মুখ, ঠাকুরের রং ইত্যাদিতে হাত লাগালাম। কেউ আমার সঙ্গে সহায়তা করেননি। বরং কোনও প্রতিমা গড়ার পর তা স্টুডিওর বাইরে শুকোতে দিলে দেখেছি তা নষ্ট করে দিয়েছেন কেউ।’ তবু হার মানেননি চায়না। বরং ঠেকতে ঠেকতে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত মৃৎশিল্পী। দেশে বিদেশে বিখ্যাতও বটে। তাঁর হাতে গড়া প্রতিমার কদর সর্বত্র।
কুমোরটুলির আরও দু’জন মহিলা মৃৎশিল্পী মালা পাল আর কাকলি পালের বক্তব্যও চায়নার সঙ্গে অনেকটাই এক। মালা জানালেন, চিরকালই তাঁর ঠাকুর গড়তে ভালো লাগত। সেই মতো বাবার স্টুডিওয় যাতায়াত করতেন নিয়মমতো। অন্যান্য শিল্পীর কাজ দেখতেন এক মনে। কিন্তু বাবা তাঁকে কখনও মাটিতে হাতও দিতে দেননি। খালি বলতেন, ঠাকুর গড়া ছেলেদেরই মানায়। মেয়েদের আবার সব কাজে হাত দেওয়া কেন? মালার সৌভাগ্য তাঁর বড়দা বোনের এই শখের কথা জেনে গিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর তাই দাদার উৎসাহেই ঠাকুর তৈরির কাজ শিখেছেন মালা। আজ তিনিও প্রতিষ্ঠিত। প্রায় প্রতি বছরই বিদেশের অর্ডার পান।
কাকলি পাল অবশ্য স্বামীর মৃত্যুর পরেই এই পেশায় আসতে বাধ্য হন। ছেলেমেয়ের দেখভালের জন্যই তাঁর এই পেশায় আসা। তখন ঠাকুর তৈরির কিছুই জানতেন না। তাঁর স্বামীর সহকর্মীদের সাহায্যেই তিনি কাজ শিখেছেন। বললেন, প্রথম দিকে বড় ঠাকুর গড়ার সাহস পেতেন না। তাই একচালার ছোট ঠাকুর তৈরিতেই হাত পাকাতে শুরু করলেন। ক্রমশ সাহস বাড়তে লাগল। এখন তিনি বিশাল বিশাল প্রতিমা তৈরি করেন অনায়াসে। কাকলির ঠাকুরের বৈশিষ্ট্য মুখে। কোমল মূর্তি গড়তে ভালোবাসেন তিনি। তাছাড়া তাঁর প্রতিমা মাতৃরূপেণ। মায়ের হাসি এবং স্নিগ্ধ দৃষ্টি প্রতিমার চোখে মুখে। মূর্তির হাত পা সুডোল।
চায়না পালের মূর্তির মুখ আবার টানা টানা। তিনি মায়ের মুখে লাবণ্যের চেয়ে বেশি ঠাকুরে আদল পছন্দ করেন। মায়ের মৃন্ময়ী রূপে দর্শককে মুগ্ধ করতে চান। ইংল্যান্ডে এক বাঙালি সম্প্রদায়ের মুখপাত্র শুভমিত লাহা জানালেন, প্রতি বছর তিনি চায়না পালের কােছই ঠাকুর অর্ডার দেন। ওঁর প্রতিমার মুখই তাঁদের সবচেয়ে পছন্দ।
বছরটা গোলমেলে ঠিকই, তবু পুরোটাই যে নিরাশার তাও নয়, বললেন মৃৎশিল্পী কাঞ্চি পাল। এই দুঃসময়ের মধ্যেও দেশে তো বটেই, এমনকী বিদেশেও ঠাকুর পাঠাচ্ছেন তিনি। লকডাউনের সময় যখন কুমোরটুলি মনমরা, তখনই একটা ফোন কলে অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি কমিউনিটি পুজোয় ঠাকুর তৈরির বরাত পান কাঞ্চি। ব্যস, শুরু হয়ে যায় ভাবনা চিন্তা। ঠাকুরের মুখ চোখ হাত পায়ের গড়ন থেকে পোশাক, সব নিয়েই পরিকল্পনা ছকতে শুরু করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘আর যেই মুখ ফেরাক না কেন, মা কি কখনও নিজের মেয়েদের দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারেন? মেয়ের মন খারাপ দূর করার দায়িত্ব তো মায়েরই ওপর।’