উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
একটা পুজো স্রেফ হারিয়ে গেল। সদ্য অঘটনে শোকসন্তপ্ত কোনও পাড়ার পুজোমণ্ডপে যেমন হয়। একলাটি চোখের জল ফেলে প্রতিমার শূন্য বেদি। এয়োতির জোকার নেই, শঙ্খ নেই, মন্ত্র নেই। শুধু একটা আরতিহীন প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে টিকে থাকে!
একমনে ফুলের মালা গেঁথে চলেছে কাজলাদিদি। কয়েকজন বালিকা চরম উৎসাহে সূচে সুতো পরিয়ে দিচ্ছে, কিংবা ফুলের ডাঁটিগুলো কেটে খানিক ছোট করে দিচ্ছে। ওরা সব স্কুল-ফেরত সোজা পুজোমণ্ডপে, মা-বাবার সঙ্গে। বৃহস্পতিবার তো! মার্কিন মুলুকের হপ্তাহান্তের পুজোয় সেটাই মহাপঞ্চমী! কাজলাদিদির কাজ বসে বসে, কিন্তু বসার ফুরসত নেই ঝুলনের। হাতে মণ্ডপসজ্জার খসড়াচিত্র নিয়ে সে এধার ওধার ছুটে বেড়াচ্ছে। রঙিন কাগজের শিকলে শরতের কাশফুলের মতো দোল খাচ্ছে শারদোৎসব। থার্মোকলের কারুকাজে ভোরের শিউলির মতো বিকশিত হচ্ছে আগমনী। কাঠের বাক্সের দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসছেন মুক্তিদায়িনী!
কিন্তু এসবই এক বছর আগের চিত্র। এবার পুজো নেই। ভার্চুয়াল পুজোয় দেবী এবার তাই বাক্সবন্দিনী। পুজোমণ্ডপ যেন ‘খণ্ডহর’!
পুজোর ক’দিন আরতিবৌদির নির্জলা উপবাস। আবাহন থেকে সন্ধ্যারতি অবধি পুজোর বেদিমূলে ঠায় বসে থাকে সে, বিশ্বস্ত সখীদের নিয়ে। এই মহোৎসবের অর্ধেক সময়টাই সে খাওয়ার সুযোগ পায় না বলে, আমরা ঠাট্টা করে আরতিবৌদির নাম দিয়েছি ‘স্ট্যাচু অব পভারটি’! এই স্ট্যাচু আর তার ‘থালিগার্ল’-দের সবার নতুন তাঁতের শাড়ি, পুষ্পমালিকায় নিবিড় কবরীবন্ধন, দুই হাত জুড়ে সুবর্ণ কঙ্কনের রিনিঝিনি! পুজো ভুলে পূজারিণীদের পানে চেয়ে থাকে পুরোহিত স্বয়ং, ঘন ঘন ঝলসে ওঠে পরপুরুষদের ক্যামেরা। পুজোয় অবশ্য কোনও খামতি নেই, আচার উপচারে নিখুঁত ‘পুরোহিত দর্পণ’! আমাদের শ্যামামাসি বলে, ‘প্রেম না থাকলে কি আর পুজো হয় রে বাপু’।
তবু এবার এসব নেই। ঢাকের বাদ্যি নেই, চণ্ডীপাঠ নেই, বাচ্চাগুলোর সেই আধো আধো বাংলায় ‘ইয়া ডেবি সারবাবুটেসু’ নেই। আকাশ প্রদীপের মতো একলা রাত জাগে শুধু একটা মঙ্গলঘট। এই কালো আকাশে তার আলো আর কতটুকু!
জিনিয়া আর তার বান্ধবীরা নাচের মেয়ে, ভরতনাট্যম। অন্যবার এই নর্তকীদের মুদ্রা বিভঙ্গে তন্ময় থাকে পুজোর মঞ্চ। আলোর সোহাগে, বাতাসি ওড়নার আদরে, ঘুঙুরের তালে জীবন্ত হয়ে ওঠে দেবীবন্দনা। এবার আর সেই তা তা থই থই নেই। নেই সেই ‘কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি’! জলিদিদিও তো নেই, শূন্য পাকশালা। তার হাতা খুন্তির ছন্দরন্ধনে প্রতিবার উপাদেয় হয়ে ওঠে পুজোর ভোগপ্রসাদ। আমরা তাই জলিদিদিকে বলি ‘খুন্তিরুপেনসংস্থিতা’! এবার সে আর আসবে না। পাকশালায় ঢুকে, শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে, মুখে এক খিলি পান দিয়ে, ‘বাঙাল’ জলিদিদি আর বলবে না, ‘তোরা যে কী করস! মহাষ্টমীর দিনটায় মায়ের একটু শুক্তো না হইলে চলে!’
পুজোমণ্ডপে ঢুকলেই সবাই যাঁর সেই প্রাণখোলা হাসিমুখটা দেখতে পায়, সে আমাদের মিতাকাকিমা। একমাত্র ছেলে কানাডায় থাকে। ফি বছর পুজোয় বউ-ছেলেকে নিয়ে সে আসে মাকে দেখতে। বছর দশেকের নাতিটা মিতাকাকিমার খুব ন্যাওটা। এই তো, গত বছরও সে বেশ বড়াই করে গপ্প করেছে, ‘ঠাম্মা, দিস টাইম আই হার্ড দ্য হোল মা-হা-লা-য়া’! শুনে কী অনাবিল আনন্দ মিতাকাকিমার! এবছর ছেলে হোয়াটসঅ্যাপ করেছে, ‘এবার আর যাচ্ছি না মা, পুজোই তো হচ্ছে না’! এখানকার নতুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে মোহিনীকে খুব ভালোবাসে মিতাকাকিমা। পুজোমণ্ডপের ভিতরে ক’দিন অহোরাত্রি তুমুল আড্ডা দেয় আমেরিকায় পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা। একবার শাড়ি-পরা মোহিনীকে দেখে অনিকেত বলেছিল, ‘আমি পাগল হয়ে যাব।’ তারপর থেকে ওদের মধ্যে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’! সেবার অনিকেতকে দেখে মোহিনী বলেছিল, ‘আবার সেই সাত পুরনো জিনসটা পরেছিস!’ অনিকেত বলেছিল, ‘একটা গান শোনা, তাহলে বিকেলে ধুতিপাঞ্জাবি পরে আসব!’ মোহিনী গেয়েছিল, ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে কেউ তা জানে না’! ওরা কি জানে, প্রেম আর পুজো শেষ হয় না কখনও! এবার প্রবাসের পুজো যেন সেই হারানো প্রেমের মতো, ‘সে যে এসেছিল বাতাস তো বলেনি, হায়, সেই রাতে দীপ মোর জ্বলেনি’!
আমার দিদি তখন এইটুকুনি। অষ্টমীর সকালে মা নতুন শাড়ি পরিয়ে দিত দিদিকে। তারপর আমরা তিন ভাইবোন মা-বাবার হাত ধরে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো দেখতে যেতাম। দৃশ্যটা চিত্তচিত্র হয়ে আমার বুকের ভিতরে রয়ে গিয়েছে অমলিন, এখনও। এই পরবাসেও, সেই ছোট্টটি থেকে আমার মেয়েকেও অষ্টমীতে শাড়ি পরিয়ে দেয় ওর মা। পুজোয় শাড়ি পরাটা এভাবেই ‘দুর্গোৎসব’ হয়ে থেকে গিয়েছে আমার ছিন্নমূল মেয়েটার মনের ভিতরে। মাতৃভাষার মতোই, সংস্কৃতিও কখনও হারায় না। গোপন ফল্গু হয়ে সে বয়ে যায় মানুষের রক্তের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। এবার পুজোর নেই। আমার মেয়ে বলছিল, ‘এবার তাহলে শাড়ি পরা হবে না, বাবা’! ওর মুখ জুড়ে তখন নিভু নিভু দীপের আলো!
সেই বিষাদই তো বিসর্জন, নাকি?