উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
ইউকে এসেছিলাম ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। এসেছিলাম স্বামী আর বছর চারেকের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে কাজের সূত্রে। এসে ঠিকমতো বাড়ি গুছিয়ে, স্বামীর চাকরি আর ছেলের স্কুল সামলে উঠতে উঠতেই দেখি পুজোর সময় এসে হাজির। সদ্য দেশ ছেড়ে এসে স্বাভাবিকভাবেই খুব মনখারাপ। কলকাতার পুজো মিস করছি। তখনই আমরা আশপাশের পুজোর ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছিলাম। আমার উৎসাহ ছিল সবথেকে বেশি। দুর্গাপুজো কিছুতেই মিস করা যাবে না। ইন্টারনেটে দেখে আর ছেলের স্কুলের আর এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হওয়ার সূত্রে জানতে পারি যে ইংল্যান্ডের রেডিং শহরে একটা বেশ বড় দুর্গাপুজো হয়, সেটাই বার্কশায়ার অঞ্চলের অন্যতম সেরা উৎসব। তারপর আর অপেক্ষা করতে হয়নি। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে ষষ্ঠীর দিন সকাল সকাল একদম পুজোর জায়গায় চলে গেলাম। পরিচয়পর্ব সেরে সবার সঙ্গে মণ্ডপসজ্জার কাজে হাত লাগিয়েছিলাম। রেডিংয়ে বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটির (বিসিএস) সঙ্গে আমার যোগসূত্রের এটাই ছিল প্রথম ধাপ।
এরপর আমার নিজের আগ্রহ আর বিসিএসের পুজো কমিটির সদস্যদের আন্তরিক ব্যবহার এই পুজোর সঙ্গে আমার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পারেনি। সবাইকে কাছে টেনে নেওয়া আন্তরিক এই পুজো কিন্তু বেশিদিনের নয়। ২০১৩ সালে রেডিংয়ে বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটির সদস্যরা প্রথম এই দুর্গাপুজো শুরু করেন। এই পুজোর প্রধান আকর্ষণ, বিরাট জনসমাগম। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী অন্তত ছ’হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন এই পুজোয়।
২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর আমার পুজো কেটেছে হইহই করে। বিসিএস-এর বন্ধুদের সঙ্গে শাড়ি, সাজগোজ, সেলফি, গল্প, ভুড়িভোজ, পুজোর জোগাড়ে হাত লাগানো, মালা গাঁথা, আর সবাই মিলে গোল করে বসে আড্ডা। সবচেয়ে ভালো লাগা ২০১৬ সালে আমার ছেলের বটুক পুজো ঘিরে। সাবেকি পুজোর রীতি মেনে অষ্টমী তিথিতে কুমারীরূপী চিন্ময়ী মা দুর্গার পুজো হয়। আর তার সঙ্গে বালকরূপী শিবশক্তিকে বটুক পুজো করা হয়। এই পুজো থেকে আর একটা দারুণ প্রাপ্তি আমার স্কুলের বান্ধবীকে ফিরে পাওয়া। এতগুলো বছর পরে বিদেশের ব্যস্ত জীবনে সারা বছর দেখা না হলেও পুজো উপলক্ষে দুই স্কুলফ্রেন্ডের দেখা আর আড্ডা হয় প্রতি বছরই।
এবার আসি এই পুজোর বিশেষত্বে। দেশের বাইরে থেকেও একদম শুদ্ধ দেশীয় মতে সন্ধিপুজো, অঞ্জলি, ধুনুচি নাচ, দেবীবরণ, সিঁদুর খেলা, প্রতি সন্ধ্যায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা, ট্যালেন্ট শো, ফ্যাশন শো সব মিলিয়ে কলকাতার যে কোনও বড় পুজোকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই পুজো। প্রতি বছর থাকে স্কুল এগজিবিশন ও নানা কেনাকাটার স্টল। ছোটদের জন্য নানারকম শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ও বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকে। আর থাকে বিভিন্ন খাবারের স্টল। এখানকার স্টলগুলোয় নর্থ ইন্ডিয়ান, সাউথ ইন্ডিয়ান, স্ট্রিট ফুড, খাঁটি বাঙালি খানা, মোগলাই, কলকাতা স্টাইলে রোল, চপ, কাবাব, বিরিয়ানি, মিষ্টি ও আরও নানা ধরনের জিভে জল আনা খাবার থাকে। তাই আমাদের রসনাতৃপ্তিতে কোনও অসুবিধেই নেই। বিগত ছ’বছর ধরে রেডিং শারদোৎসব বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে উৎসবের আনন্দে মাতিয়ে রেখেছে। ফি বছর প্রধান অতিথি হিসেবে নানা বিশিষ্টজন যেমন, পার্লামেন্ট মেম্বার বা লোকাল অথরিটির প্রতিনিধিরা এই পুজোয় যোগ দেন। এছাড়া আছে মায়ের ভোগ বিতরণ ও দু’বেলা পাত পেতে ভুড়িভোজ।
এত কিছুর মধ্যেও আমার দুর্গাপুজো শুধু রেডিংয়ে সীমাবদ্ধ নয়। কলকাতার মতো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার সুবিধা এই দেশে নাই থাকুক, কিন্তু আশপাশের আরও কিছু পুজো বেশ জমজমাট করে দেয় আমার পুজোর রুটিন। কীরকম? ২০১৯-এর হিসেব অনুযায়ী শুধু লন্ডন ও তার আশপাশের পুজোর সংখ্যা প্রায় ২৫ (গোটা ইউনাইটেড কিংডমে দুর্গাপুজোর সংখ্যা ছড়িয়েছিটিয়ে প্রায় ৬১)। এর মধ্যে কিছু পুজো কমিটি উইকেন্ড দেখে পুজো করে, কিছু আবার একদম দেশের সময় অনুযায়ী। এরকম একবার বিসিএসের পুজো হইহই করে কাটানোর পরে সপ্তাহাম্তে আমরা লন্ডন পুজোপরিক্রমায় গিয়েছিলাম। ভীষণ মজা হয়েছিল। সে বছর আমার মা-বাবাও কলকাতা থেকে এসেছিলেন। সবাই মিলে প্রায় দু’সপ্তাহ পুজোর আনন্দে মেতেছিলাম। আমাদের সেবারের তালিকায় ছিল রয়্যাল বার্কশায়ার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজো, হন্সলো প্রবাসী পুজো, লন্ডন শারদোৎসব— এমন নানা পুজো। এছাড়া প্রায় ৩০ মাইলের মধ্যে স্লাওয়ের নতুন পুজো আমার খুব পছন্দের।
তবে এবার বিশ্বব্যাপী অতিমারীর প্রকোপে আমরা সবাই গৃহবন্দি। নিত্যনতুন নিয়মের সৌজন্যে ইউকে-তে প্রায় সবরকম জনসমাগম বন্ধ। শেষবেলায় এল নতুন রেগুলেশন। কোনও জায়গায় ছ’জনের বেশি জমায়েত কোনওভাবেই করা যাবে না।
দুর্গাপুজো তো জনসমাগম ছাড়া সম্ভবই নয়। তাহলে কী উপায়?
আমাদের বিসিএসের পুজো আরও কিছু ইউকে পুজোকমিটির সঙ্গে একমত হয়ে জনসমাবেশের নতুন আইন মেনে পুজো না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনস্বার্থে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে নিউ নর্মাল অনুযায়ী আমাদের পুজো হবে ভার্চুয়াল ফোরামে। এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।
কিন্তু তাতে কী? প্রবাসীদের উৎসাহ অবশ্য কিছু কমেনি। রেডিং শারদোৎসবের পুজো হবে ২১ থেকে ২৫ অক্টোবর, ২০২০। নিয়ম মেনে আমাদের পুরোহিতেরা পুজো করবেন নিজ নিজ বাড়িতেই। পুজো অনলাইনে লাইভস্ট্রিম করা হবে সদস্যদের জন্য। আর হ্যাঁ, মায়ের ভোগও পাওয়া যাবে অগ্রিম বুকিং করে!
জোর কদমে কালচারাল প্রোগ্রামের মহড়া চলছে, সেটাও লাইভস্ট্রিম করেই দেখানো হবে। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমার মতো অগুনতি প্রবাসী বাঙালি অধীর আগ্রহে পুজোর দিন গুনছে। দেশের পুজোর খবর ও আপডেটের দিকেও তাকিয়ে আছি আমরা। প্রার্থনা করব, আনন্দময়ীর আগমনে পৃথিবীর সব রোগ, দুঃখ, ভয়, গ্লানি যেন দূর হয়। আসছে বছর আবার এসো মা, এক সুন্দর করোনামুক্ত পৃথিবীতে।
অনুলিখন: অন্বেষা দত্ত
(দুর্গার ছবি: অরিজিৎকমল মান্না)