কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
শাঁখা, সিঁদুর লোকাচার মাত্র
বিবাহিত মানেই শাঁখা-সিঁদুরে ভূষিত! কে বলল এমন কথা? আইনে তো কোথাও বিবাহের এমন সংজ্ঞা নেই। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, দু’জন বিচারপতি সম্প্রতি এমনই বিস্ফোরক একটি রায় দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, যে নারী বিয়ের পরে শাঁখা-সিঁদুর পরতে অস্বীকার করেন, তিনি আসলে নিজেকে অবিবাহিত মনে করেন। কিন্তু শাঁখা-পলা-লোহা-সিঁদুর ইত্যাদি বিবাহের লোকাচার। যা এলাকাভিত্তিক। তাছাড়া পুরাণকে যদি মান্যতা দিই, তাহলে এই যে বিয়ের ক্ষেত্রে শাঁখা-সিঁদুরের এত গুরুত্ব দেওয়া হল, সেই গুরুত্ব তো পুরাণে কোথাও পাওয়া যায় না! সীতা বা দ্রৌপদীর হাতে শাঁখা বা কপালে সিঁদুরের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তাহলে হঠাৎ আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই বাহ্যিক লোকাচারগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? আর এর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের সম্পর্কই বা কী? এই প্রশ্নগুলো বারবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিবাহ দু’জন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্মানের একটি বন্ধন। সেই ভালোবাসা বা সম্মান যতদিন অটুট থাকে, বিবাহও ততদিনই টিকে থাকে। নয়তো তা বিচ্ছেদের পর্যায়ে পৌঁছয়। ঠিক যেমন হয়েছিল অসমের দম্পতি ভাস্কর দাস ও তাঁর স্ত্রী রেণু দাসের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে হঠাৎ কিছু লোকাচারকে টেনে এনে গোটা ব্যাপারটা খুব লঘু করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিবাহের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে গিয়েছে।
বিবাহের চিহ্ন কি শুধুই মেয়েরা বহন করবেন?
চিহ্ন বহন করার কথাই যদি ওঠে, তাহলে তা স্ত্রী-ই বা একা তা বহন করবেন কেন? স্বামীর কি কোনও দায়িত্বই নেই নিজেকে বিবাহিত দেখানোর? কই তাঁর বেলা তো কোনও চিহ্নের প্রসঙ্গ ওঠে না! আমরা মেয়েরা অনেক সংগ্রামের পর পুরুষের সমমর্যাদা পেয়েছি। হঠাৎ সেই মর্যাদা মেয়েদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকারই বা বিচারপতি মহাশয় পেলেন কী করে? আর আইনের কথা যদি ওঠে, তাহলে বলি, আইন তো শুধুই রেজিস্ট্রি করা বিয়েকে স্বীকৃত বলে মানে। হিন্দুমতে অগ্নিদেবকে সাক্ষী করে বিয়ের তো আইনি স্বীকৃতি নেই। বিচারপতি মহাশয় কি রায় দেওয়ার সময় এই কথাগুলো ভুলে গিয়েছিলেন? বিয়ে দেখানোর জিনিস নয়, অনুভবের জিনিস। একটি পবিত্র বন্ধন। কিন্তু তাকে কিছু লোকাচারের বেড়াজালে আটকে ফেললে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা নষ্ট হয়।
অপ্রাসঙ্গিক, তবু উদ্দেশ্যবিহীন নয়
বিবাহিত হলে শাঁখা-সিঁদুরে তার প্রমাণ দিতে হবে এমন মন্তব্য বিবাহবিচ্ছেদের একটা মামলার ক্ষেত্রে নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। তাই বলে এই মন্তব্যকে ফালতু বলে উড়িয়ে দেবেন না। অপ্রাসঙ্গিক হলেও এই মন্তব্য কিন্তু একটুও উদ্দেশ্যবিহীন নয়। এর নেপথ্যে গুরুতর উদ্দেশ্য রয়েছে। মেয়েদের পিছনে টেনে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য। মেয়েদের খারাপ প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য। নতুনভাবে মেয়েদের সমাজে হেনস্থা করার উদ্দেশ্য। তাঁদের গায়ে ‘খারাপ মেয়ে’-র তকমা লাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য। মেয়েরা যে লড়াই করে সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার চেষ্টা করেন, সেই মর্যাদা খর্ব করার উদ্দেশ্য। আর এই উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যেই এক অশুভ ইঙ্গিত আমি দেখতে পাচ্ছি। আইনের কাজ আমাদের সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু এমন আইন যদি কায়েম হয়, তাহলে মেয়েদের সুরক্ষার মাথায় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলবে অচিরেই। তাছাড়া এই শাঁখা-সিঁদুরের মাধ্যমে যদি বিচারপতি মহাশয় কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শকে সমর্থন করে থাকেন, তাহলে বলি,শাঁখা-সিঁদুর পরার মধ্যে কিন্তু হিন্দুত্বের নিদর্শন স্পষ্ট নয়। কারণ রাজস্থান, গুজরাত সহ উত্তর ভারতে বা গোটা দক্ষিণ ভারতে কোথাও বিবাহের চিহ্ন হিসেবে শাঁখা বা সিঁদুরের স্বীকৃতি নেই। অথচ তাঁরা সবাই হিন্দু। অতএব শাঁখা-সিঁদুর নিতান্তই কিছু লোকাচার যা হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত।
পদবী বদল ও চিহ্ন বহন
বিয়ের পর স্ত্রী যে স্বামীর পদবী ধারণ করেন, তারও কিন্তু কোনও আইন নেই। আইনে কোথাও বলা নেই বিয়ের পর মেয়েদের পদবী বদলাতে হবে। একইভাবে বিয়ের পর কোনও চিহ্নকে বহনের কথাও আইনে কোথাও বলা হয়নি। ফলে বিয়ের প্রসঙ্গে শাঁখা-সিঁদুরের উল্লেখ নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। মহিলাদের অধিকার সুরক্ষায় গত চল্লিশ বছর ধরে বিভিন্ন আইন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মাধ্যমে মেয়েরা সেই অধিকারগুলো পেয়েছেন। লড়াই করে পাওয়া সেই অধিকার আইনের মাধ্যমেই তাঁদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে অশনিসঙ্কেত লক্ষ করা যায়। আইনের চোখে নারী এবং পুরুষ সমমর্যাদা সম্পন্ন। কিন্তু এমন একটা রায়ের মাধ্যমে নারীকে যে বহু বছর পিছিয়ে দেওয়া হল, সে খেয়াল বিচারপতির আছে কি? তাঁর একটা বেপরোয়া মন্তব্যের ফল কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে সে কথা তিনি একবারও ভাবলেন না!
জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত
এই রায়ের মাধ্যমে জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত। ফলে আদালতের উচিত অবিলম্বে এই রায়ের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া। না হলে মেয়েদের উপর অত্যাচার আরও বেড়ে যাবে। যাঁরা পুরুষতন্ত্রের ধ্বজা ওড়াতে চান, তাঁরা আরও নির্লজ্জভাবে তা ওড়াতে সক্ষম হবেন। যাঁরা পুরুষতন্ত্রের দোহাই দিয়ে নারীকে অবদমন করতে চান, তাঁরা এবার আইনের সমর্থন পেয়ে অবদমনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবেন। আইনি পরিভাষায় ‘জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজম’ বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ জনস্বার্থ রক্ষায় আইনের নতুন পদক্ষেপ। অনেক সময় এমন কিছু মামলা আদালতে ওঠে যার পক্ষে কোনও দৃঢ় আইন থাকে না। তখন আইনের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার অধিকার বিচারপতির থাকে। তবে আইনের এমন ব্যাখ্যা জনস্বার্থ রক্ষার জন্যই তিনি করতে পারেন। এটাকে বলা হয় প্রগতিশীল আইন। এক্ষেত্রে কিন্তু ঘটনাটা উল্টো হয়ে গেল। অর্থাৎ বিচারক এমন আইন জারি করে বসলেন, যাতে জনস্বার্থ রক্ষার বদলে তা ক্ষতিগ্রস্ত হল। ফলে ‘প্রগতি’-র বদলে ‘প্রতিক্রিয়া’ তৈরি হল। মেয়েদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাঁদের আবার সেই মধ্যযুগে ঠেলে দেওয়া হল। এমন পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত। এবং তা আইনের মাধ্যমেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মেয়েরা কি আজও পুরুষের সম্পত্তি?
ভাবতে খারাপ লাগে এত উন্নতি সত্ত্বেও আজও মেয়েদের গুণের বিচার হয় না। বিয়ের পর তিনি শাঁখা না পরলে, ঘোমটা না টানলে প্রশ্ন ওঠে। কই নারীর কর্মকৃতিত্বের কথা তো কেউ বলে না! আসলে পুরুষ এখনও মেয়েদের ‘সম্পত্তি’ হিসেবে ভাবতে বা দেখতেই অভ্যস্ত। সেখানে বিবাহের চিহ্ন থাকার মানে এই সম্পত্তির ওপর কোনও নির্দিষ্ট পুরুষের অধিকার রয়েছে। অতএব তাকে ছুঁতে গেলে বিপদ হতে পারে। আর বিবাহের চিহ্ন না থাকলে সে সম্পত্তি বারোয়ারি। অতএব তা একটু ভক্ষণ করতে দ্বিধা নেই। হয়তো নারী অপেক্ষা পুরুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করার ইচ্ছা বা ‘সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ মূলত একটা হীনম্মন্যতা থেকেই তৈরি হয়। নারীকে বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে বেঁধে রাখতে না পারলে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে ফেলবেন অনায়াসে, মনে মনে এই ভয়টাই বোধহয় পুরুষ পান। কিন্তু তাই বলে নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। এই রায়ের বিরুদ্ধেই জনস্বার্থ মামলা হওয়া উচিত।