স্বপ্নটা সেই ছোটবেলার। লিঙ্গবৈষম্য পার করার স্বপ্ন। ছেলে বা মেয়ে নির্বিশেষে আমরা যে সবাই মানুষ, তা প্রমাণ করার স্বপ্ন। স্বপ্নটা দেখেছিলেন আমাদের দেশের প্রথম মহিলা দমকলকর্মী হর্ষিণী কনহেকর। তাঁর সঙ্গে ফোনালাপে উঠে এলো নানা অজানা কথা।
‘অন্য ধরনের কিছু করতে হবে, এই ভাবনাটা প্রথম মনে জেগেছিল শিবানী কুলকর্নিকে দেখে। ভারতীয় বায়ুসেনার তিনিই প্রথম মহিলা পাইলট। আমি তখন ছাত্রী। শিবানীর অনুপ্রেরণাই আমাকে অন্যরকম ভাবে ভাবতে শিখিয়েছিল।’ কনহেকর বললেন, ন্যাশনাল ফায়ার সার্ভিস কলেজ থেকে যখন প্রথম ভর্তি হওয়ার আবেদনপত্র মঞ্জুরের চিঠিটি আসে তখনও জানতেন না, যে একজনও মহিলা সহপাঠী তিনি পাবেন না! তাই প্রথম দিন কলেজে গিয়ে বেশ অবাকই হয়েছিলেন। তবে দমে যাননি। তাঁর কথায়, ‘ততদিনে অন্য ধরনের পেশায় আসার নেশাটা পেয়ে বসেছিল।’ তাই যে কোনও বাধার সম্মুখীন হতেই প্রস্তুত ছিলেন তিনি। প্রথম দিন তাঁকে ক্যাম্পাসে দেখে কলেজের এক কর্মকর্তা তো বলেই বসলেন, সেখানে তাঁর জায়গা হবে না। অন্য কোনও কলেজে ভর্তি হোন বরং।
দমকলে চাকরি বা ট্রেনিংয়ের পথটা যে সুগম ছিল না, তা তো বলাই বাহুল্য। চাকরির জন্য চাই বিশেষ প্রশিক্ষণ। কিন্তু সেখানে প্রার্থী হিসেবে যে একজন মহিলাকে বিবেচনা করা যেতে পারে, এই ধারণাটাই কারও মনে ছিল না। প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রথম স্তর ডিঙিয়ে যখন দ্বিতীয় স্তরে ঢুকলেন, তখন হর্ষিণী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সব বাধা অতিক্রম তিনি করবেনই। মেডিক্যাল পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হলেন।
তারপর এল ইন্টারভিউ পর্ব। ‘সে এক ঝকমারি ব্যাপারই বটে। সামনে গোমরা মুখে একদল লোক বসে আছেন। আমার ইন্টারভিউ নেবেন তাঁরা। মহিলা দেখে প্রথমেই ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হল। তারপর শুরু হল প্রশ্নবাণ। প্রশ্ন তো নয়, যেন অগ্নিপরীক্ষা! তবু আমি সিদ্ধান্তে অনড়। কোনও ভাবেই হেরে যাওয়া চলবে না। অবশেষে বরফ গলল। প্রথম মহিলা দমকলকর্মী হিসেবে নির্বাচিত হলাম।’ কিন্তু আসল লড়াই যে তখনও বাকি তা কে জানত?
প্রথম যেদিন ট্রেনিং-এ এলেন, সেদিন থেকেই নাকি শুরু হয়েছিল লড়াইটা। পুরুষ বনাম নারীর লড়াই। প্রতিপদে নারীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াই। ট্রেনিংয়ে তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা হামেশাই একটু দেরিতে আসতেন, তাই নিয়ে কেউ প্রশ্নও তুলত না। কিন্তু তাঁর দেরি হওয়ার জো নেই। তাহলেই নানা কথা। তাই তিনি কোনওদিন ট্রেনিংয়ে দেরি করে ঢোকেননি। দীর্ঘ ট্রেনিংয়ের পর কোনওদিন হাঁপিয়ে যাননি। জলভর্তি হোসপাইপ তুলেছেন হাসিমুখে। তার জন্য আলাদা করে প্র্যাকটিস করেছেন ট্রেনিং ক্লাসের আগে।
ট্রেনিং শেষে অবশ্য খাটনির দাম পেয়েছিলেন হর্ষিণী কনহেকর। গুজরাতের বৃহত্তর ফায়ার স্টেশনে পোস্টিং হয় তাঁর। সেখানে হাতেকলমে কাজ করার সময় টুকটাক ঝক্কি যে পোহাতে হয়নি তা নয়, জানালেন হর্ষিণী। কিন্তু মন যখন স্থির থাকে, লক্ষ্য থাকে স্পষ্ট। তখন কোনও বাধাই আর বাধা হয়ে
ওঠে না।
‘বাঁধা গৎ ভেঙে দেওয়ার একটা মজা আছে। আমি ভাগ্যবান যে বারবার সেই বাঁধা গৎ ভাঙতে পেরেছি নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে।’ দমকলকর্মী ছাড়াও হর্ষিণী একজন বাইকারও। নিজের বাইকবাহিনী আছে তাঁর। সেখানেও অবশ্য তিনি একাই মহিলা। বস্তুত, সেই বাইকবাহিনির বন্ধুদের মধ্যে থেকেই নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছেন হর্ষিণী। বললেন, স্বামীও অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসেন বলে আমার কোনও কাজে বাধা দেন না।’
প্রায় দু’দশক ধরে দমকলে কাজ করছেন হর্ষিণী। বললেন চেনা গৎটা ভাঙতে মহিলারা আজও প্রস্তুত নন। তাই আজও দমকলে মহিলার সংখ্যা এত কম।
আর সেজন্যই সমাজ মেয়েদের সম্পর্কে কিছু বাঁধাধরা চিন্তা পোষণ করে। মেয়েদের এগিয়ে এসে সেই চিন্তাগুলো ভাঙতে হবে। মেয়েমানুষের খোলস ছেড়ে মানুষ হয়ে ওঠার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই কাঁধে।