ব্যবসায়ে যুক্ত হলে এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো যাবে না। প্রেম প্রণয়ে বাধা। কারও সাথে ... বিশদ
নারীকে অবনমিত, অপমানিত, অবহেলিত করে রাখার চিত্র কি কেবলই আমাদের দেশের ঘটনা? বোধ হয় না। ইতিহাস আলোচনা করলেই জানা যায় যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই তো নারী অবহেলিত ও লাঞ্ছিত হয়ে আসছে। তবু বারবার নারী সেই অবনমনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের তেজ ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সকল বাধা ও সব অত্যাচারকে জয় করেছে। আপন গরিমাবলে মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে।
আজ তাই অনেকের মধ্যে এমনই কয়েকজন মুষ্টিমেয় নারীর কথা বলি, যাঁদের আপন ভাগ্যকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস আমাদের জীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
রানি রাসমণি ছিলেন সামান্য ঘরের মেয়ে। বাল্যকালেই এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। কন্যাসন্তানদের জন্মের পরেই অকালে তিনি বিধবা হন। সেই সময়ে এদেশে ব্রিটিশরাজ। নারীদের তথা ভারতীয়দের ওপর অকথ্য অত্যাচার চলছিল অবাধে। এ দেশের জমিদারদের ব্রিটিশরাজ থেকে নিজ নিজ সম্মান ও সম্মতি রক্ষার জন্য বহু খেসারত দিতে হচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে যুবতী বিধবা রানি রাসমণি কন্যাসন্তানদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ও দাপটের সঙ্গে অত্যাচারী ব্রিটিশরাজকে অবনমিত করে, নিজ ঐতিহ্য ও সম্মান রক্ষা করেছিলেন।
মুন্নি বেগম ছিলেন সেকেন্দ্রার এক হতদরিদ্র পরিবারের কন্যা। বিধবা মাতা দারিদ্র্যের চাপে বিন্দু নামে এক নর্তকীর কাছে তাঁকে বিক্রি করে দেন। বিন্দু তাঁকে নৃত্য প্রশিক্ষণ দিয়ে এক নর্তকী দলের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। এই নর্তকী দলের সঙ্গেই মুর্শিদাবাদে এসে নবাব আলিবর্দি খানের সেনাবাহিনীর জেনারেল মীরজাফরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মীরজাফর তাঁকে নিজ হারেমে গ্রহণ করেন এবং তাঁর দুই পুত্রের জন্ম হয়।
মুন্নি বেগমের নিজেকে তুলে ধরার অদম্য উৎসাহ ছিল। নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ব্যক্তিত্বের জোরে তিনি মীরজাফরের প্রধান মহিষী হয়ে ওঠেন। মীরজাফরের মৃত্যুর পরে নবাব পরিবারের নানান বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েই গদিনাসীন বেগম হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
মুন্নি বেগম যেমন তাঁর বুদ্ধিমত্তার জোরে নবাব পরিবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তেমনি ব্রিটিশের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’-র সঙ্গে মধুর ব্যবহার বজায় রেখে ‘মাদার অব কোম্পানি’র মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে ফোর্ট উইলিয়ামে পতাকা অর্ধনমিত রেখে, ৯০টি তোপধ্বনি করা হয়েছিল।
মহারানি স্বর্ণময়ী দেবী নারী হয়েও অত্যাচারী ব্রিটিশরাজের থেকে ‘ক্রাউন অব অনার’ উপাধি লাভ করেছিলেন। বর্ধমান জেলার এক দরিদ্র পরিবারে স্বর্ণময়ীর জন্ম হয়। পিতা অপারগ হয়ে মাত্র এগারো বছরের অপরূপ সুন্দরী মেয়েকে কাশিমবাজারের রাজবাড়ির কুমারের সঙ্গে বিবাহ দেন। স্বামীর নাম কৃষ্ণনাথ। তিনি ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাশিমবাজারের মহারাজা ছিলেন।
স্বর্ণময়ীর কোনও প্রথাগত শিক্ষালাভ করার সুযোগ হয়নি। স্বামী কৃষ্ণনাথ তাঁকে নিজে বাংলা ও অঙ্ক শিক্ষা দিয়েছিলেন। স্বর্ণময়ীর বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র সতেরো বছর বয়সে দুটি কন্যাসহ তিনি বিধবা হন।
মহারাজ কৃষ্ণনাথের মৃত্যুর পর স্বর্ণময়ী মহারানি হন। মহারানি হিসেবে সমস্ত কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করেও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
তিনি পরিশোধিত জল সরবরাহের জন্য, সুচিকিৎসার জন্য, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য, শিক্ষার্থীদের বসবাসের জন্য নিজ ভাণ্ডার থেকে বহু অর্থ দান করেছিলেন। তাঁর সেই দানশীলতার ফলেই অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার, নারী হওয়া সত্যেও, তাঁকে কুর্নিশ করতে বাধ্য হয়েছিল। তাঁকে ভারতের ‘ক্রাউন অব অনার’ উপাধিতেও ভূষিত করেছিলেন।
চামেলী বসু ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র ভারত তথা এশিয়ায় প্রথম মহিলা ছাত্রীরূপে পদার্থবিদ্যায় এম.এসসি-তে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পুরুষশাসিত সমাজের, এমনকী অতি আপনজনদের থেকেও তাঁকে বিদ্যালাভের জন্য বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং ইতিহাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
আরতি সাহা ঊনবিংশ শতাব্দীরই মেয়ে। তিনি প্রথম ভারতীয় মেয়ে হিসেবে ‘ইংলিশ চ্যানেল’ পার হওয়ার মতো দুরূহ কাজটি করেছিলেন। তখনকার দিনে মহিলা হিসেবে বাইরে বেরিয়ে সাঁতার দিতে তিনি কখনও পিছপা হননি। সে সময়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। প্রথম স্থান অধিকারও করেন। হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ১৯৫২ সালে আরতি সাহা ও ডলি নাজির ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
নির্মলাবালা সোম ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে প্রথম ডবল এমএ পাশ করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। মাতা সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় পড়ে কন্যাকে এক অনাথ আশ্রমে দেন। নির্মলাবালা সেখানে যথেষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেই কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশুনো চালিয়ে যান ও স্কলারশিপ নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। পরে যথাক্রমে ইংরাজি ও ফিলোজফিতে এমএ পাশ করেন।
সমসাময়িক বিষয় দিয়ে প্রতিবেদনটা আরম্ভ করেছিলাম, সেই সমসাময়িক বিষয়ে ফিরেই বলি, আমাদের দেশ আজ সামাজিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে জর্জরিত। কিন্তু তার মধ্যেই নারীরা যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কাজ করে চলেছেন।
মাত্র ২৪ বছর বয়সে ডিয়েন ডি মেনেজিস ‘কুইনস ইয়ং লিডারস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন। তাঁর অনন্য উদ্যোগ ‘রেড ইজ দ্য নিউ গ্রিন’-এর জন্য। তাঁর এই উদ্যোগের লক্ষ্য হল ঋতুস্রাবের সঙ্গে যুক্ত থাকা সামাজিক কলঙ্ক দূরীভূত করা। যে লিঙ্গবৈষম্য এই কলঙ্ককে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা বিনষ্ট করা।
চেতনা সিনহা মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য মন দেশি’ ব্যাঙ্ক। এখনও পর্যন্ত এই ব্যাঙ্ক ও তার আটটি শাখা ক্ষেত্র সহায়কের মাধ্যমে তিন লক্ষ মহিলাকে ক্ষমতাশালী ও স্বনির্ভর করেছে।
সোনল কাপুর শিশুপাচারের বিরুদ্ধে নিরলসভাবে কাজ করে আসছেন। তিনি শিশুনিগ্রহ নির্মূল করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রোৎসাহন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’। বিপন্ন ও উদ্ধার হওয়া শিশুদের অন্তরের শান্তি, সাহায্য ও নিরাপত্তা প্রদান করাই এই সংস্থার উদ্দেশ্য ।
অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয় নারী প্রতিবাদী হয়ে উঠুক। কিন্তু শুধু প্রতিবাদের জন্য প্রতিবাদ করা বোকামি। বরং মেয়েরা যে শিক্ষা ও স্বাধীনতা পেয়েছে তা যদি তারা সঠিক কাজে লাগায় তাহলেই একমাত্র তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা আসবে।
নারীবাদ একটা মানসিক সচেতনতা। সেই সচেতনতার মাধ্যমে মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়া উচিত। আর স্বনির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে উন্নত করাই নারীর কর্তব্য।