পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
‘এখনও মেয়েদের অনেকটা পথ পেরতে হবে’
অনন্যা চৌধুরী
(ডিরেক্টর, অঞ্জলি জুয়েলার্স)
আমার কথাগুলো পড়তে হয়তো খারাপ লাগবে। কিন্তু আমি সত্যি মনে করি না যে, একদিন নারীদিবস পালন করলেই সব দায়-দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। আজ নারী দিবস পালন করেই কাল হয়তো সংবাদমাধ্যমে দেখব কোনও এক স্ত্রীকে তার স্বামী গলা টিপে ধরছে বা মারধর করছে আর সেই নারী মুখ বুজে তা সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে। আমার মনে হয় নারীদিবস পালনের থেকে অনেক বেশি জরুরি গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে কথা বলা। গ্রামে কিন্তু মেয়েদের অবস্থা শহরের মেয়েদের তুলনায় আরও শোচনীয়। কাজেই একদিন উদযাপন না করে বছরের বেশ কয়েকটা দিন নিয়মিতভাবে সেখানে গিয়ে প্রচার চালালে আমার ধারণা মেয়েরা অনেক বেশি উপকৃত হবে।
মহিলাদের সকলের আগে সাপোর্ট দেওয়াটা দরকার। মহিলারা কিন্তু কোনও অংশে কম নন। গ্রামে অনেকক্ষেত্রেই নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়া হয়। সেটা রোখার জন্য প্রচার চালাতে হবে। পুরাণের যুগ থেকেই মহিলারা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাজ্যশাসন থেকে কোনওকিছুই বাদ দেননি। চিত্রাঙ্গদার কথাই ভাবুন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তন হয়। একসময় সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল। আমরা সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এখনও মেয়েদের অনেকটা পথ পেরতে হবে।
‘এখনও বিস্তর ফারাক’
গুরু সঞ্চিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
(ওড়িশি নৃত্যশিল্পী)
আমার কাছে ‘নারীদিবস’ অবশ্যই খুব স্পেশাল। কারণ এখনও আমাদের দেশে ছেলে এবং মেয়েদের সমানভাবে দেখা হয় না। কিন্তু প্রাচীন ভারতের দিকে তাকালে দেখব সেখানে কিন্তু নারীদের সম্মান ছিল অনেক বেশি। যেমন এখন স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে অনেক আন্দোলন, প্রতিবাদ হওয়ার পরও একটি মেয়ে সবার সামনে দোকানে গিয়ে সেটি কিনতে পারে না, তার অস্বস্তি হয়। অথচ মহাভারতে দ্রৌপদীর সময়কালে তারা রজঃস্বলা অবস্থায় কোনও দ্বিধায় ভুগছে না। কারণ তারা জানে এটি স্বাভাবিক বিষয়। এতে মেয়েদের কোনও হাত নেই। আমি নৃত্য জগতের সঙ্গে ওঠাবসা করি। দেখেছি ছেলেদের নৃত্যজগতে আসা অনেক পরিবার মেনে নিতে পারে না। কিন্তু সেটা কেন হবে? নাচ হলেই বিষয়টাকে অনেকক্ষেত্রে ‘ওটা তো মেয়েদের’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ওড়িশি সহ নানা শাস্ত্রীয় নৃত্যে কিংবদন্তী গুরুরা ছিলেন পুরুষ। তাহলে কেন আমাদের বাড়ির ছেলেটিকেও আমরা সাহায্য করব না? দীর্ঘদিন ধরেই আমি এর বিরুদ্ধে লড়ছি। নারী-পুরুষ-ট্রান্সজেন্ডার সকলকে নিয়েই আমার ডান্স ট্রুপ। সবকিছুতেই সকলের অধিকার রয়েছে।
‘গ্রামের মেয়েদের অধিকার নিয়ে সচেতন করে তুলতে হবে’
রচিতা দে
(ডিরেক্টর, শ্রীলেদার্স )
এই বছরের আন্তর্জাতিক নারীদিবসের থিম ‘ইচ ফর ইক্যুয়াল’ অর্থাৎ সকলের জন্য সমানাধিকার। আমার মতে, অবশ্যই এরকম একটি দিনের প্রয়োজনীয়তা আছে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। শহুরে মেয়েরা ইতিমধ্যেই নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে। এখানে নারীর ক্ষমতায়নের যতটা না দরকার তার থেকে গ্রামে অনেক বেশি জরুরি। কারণ শহরাঞ্চলে দিনবদল শুরু হয়েছে। মহিলা আর পুরষের মধ্যে এখানে অতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। তারা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। বাড়িতেও সেটা দেখেছি। আমার বাবা যেমন খুব গাম্ভীর্যপূর্ণ একজন মানুষ, তেমনই মা ঘর সামলানোর পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিজের একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। মানে আমি বলতে চাইছি অন্তত এখানে একটা ব্যালান্স আছে। ফলে এবারের থিমকে বাস্তবায়িত করতে গেলে গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের আরও বেশি সাহায্য করতে হবে, নিজের অধিকার সম্বন্ধে আরও সচেতন করে তুলতে হবে।
‘পরিবার থেকেই শুরু হোক নারী দিবস’
ইন্দ্রাণী রায়
(জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড)
একজন মহিলা হিসাবে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এ সমাজে নারীরা ‘সংখ্যালঘু’। এ পৃথিবীতে সবচেয়ে নিপীড়িত-বঞ্চিত এই নারীই। প্রত্যেক বছরই ৮ মার্চ আমরা খুব ঘটা করে নারীদিবস পালন করি। কিন্তু যেই ৮ থেকে ৯-এ পা দিই, অমনি সব আলোচনা, সব শপথ নিমেষে ভুলে যাই। কর্মক্ষেত্রে আমার এক সিনিয়র একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী দেখে বোঝা যায় একটা দেশ উন্নত না অবনত? কোন কোন পয়েন্টগুলো বলব ভাবছি। উনি বললেন, ‘মেয়েদের দেখে। যে দেশে মেয়েরা উন্নত, সেই দেশ ততটা উন্নত।’ আমাদের দেশে তো ভ্রণ অবস্থা থেকেই নারীরা অত্যাচারিত। তাই নারী দিবস সাড়ম্বরে পালন না করে প্রতিটি ঘরে ঘরে যে নারীরা রয়েছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান এবং সম্ভ্রম প্রদর্শন করতে হবে এবং তা ব্যক্তিগতস্তরেই করতে হবে। আর সেটাই হবে নারী দিবসের প্রকৃত সার্থকতা। কোনও গ্রুপ বা ফোরাম দিনবদল ঘটাতে পারবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত ব্যক্তি সচেতনতা বাড়ছে। তাই বলব, পরিবার থেকেই শুরু হোক নারী দিবস।
‘সাম্যের সূচনা ঘটছে’
প্রিয়াঙ্কা এম
( মাস্টারশেফ)
আমি এই দিনটা নিয়ে খুব আনন্দিত। কারণ এটা এমন একটা দিন যেদিন আমরা ভাবতে পারি – হ্যাঁ, কোথাও না কোথাও সাম্যের সূচনা হচ্ছে। এটা অবশ্যই ঠিক যে, সব দিন এই একই সমানাধিকার কাম্য। কিন্তু তার মধ্যেও এই দিনটা যেন পিছন ফিরে তাকাতে সাহায্য করে। ভাবতে সাহায্য করে সারা বছরে এই সাম্য আমরা ধরে রাখতে পারছি তো? এইজন্যই এই দিনটা আমাদের নারীদের কাছে বিশেষ দিন এবং খুব দরকারি দিনও বটে। আমি একজন মাস্টার শেফ এবং আমি হলফ করে বলতে পারি রান্নার দিক দিয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে এবং এগিয়ে থাকবেও। ওই জায়গাটি আমাদের থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। সঙ্গে আমরা অন্যান্য বিভাগেও পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাব।
‘পুরুষকে পাশে নিয়েই এগতে হবে’
পরমা বন্দ্যোপাধ্যায়
(সঙ্গীতশিল্পী এবং অভিনেত্রী)
পশ্চিমের দেশগুলিতে প্রথম এই দিনটি সেলিব্রেট করা শুরু হয়। কিন্তু সেখানে এখন সাম্য অনেকটাই, তাই আলাদা করে হয়তো সেই সব দেশে নারীদিবস পালনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রাচ্যের দেশগুলিতে মানে আমাদের ভারতের মতো দেশগুলিতে নারীদিবস পালনের দরকার আছে। দিনটা কোথাও গিয়ে একটা চেতনা জাগিয়ে তোলে মানুষের মধ্যে এবং ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, প্রতিটা পরিবারে এই চেতনা জেগে ওঠা খুবই দরকারি। পরিবার আমাদের সমাজের ‘স্মল ইউনিট’, সেখান থেকেই মানুষের শিক্ষার শুরু। তাই সেই পরিবারেই নারী পুরুষের সাম্যের চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে। শুধু মেয়েরা নয়, মেয়েদের জেগে উঠতে গেলে পাশে পুরুষদের স্তম্ভের মতো দাঁড়াতে হবে। পুরুষকে পাশে নিয়েই এগতে হবে। কারণ একা কোনও গোষ্ঠীর পক্ষে এগিয়ে চলা সম্ভব নয়, মিলিত ভাবেই সেটা করতে হবে। সিনেমার জগতে ‘থাপ্পড়’-এর মতো ছবিগুলি কিছু ক্ষেত্রে চেতনা জাগাতে সাহায্য করছে।
‘রোজকার দিনে লুকিয়ে থাকা লড়াই’
ঈলীনা
(চিত্রশিল্পী)
একজন চিত্রশিল্পী আমার একমাত্র পরিচয় নয়। আমি একজন সিঙ্গল মাদারও। তাই নানা কাজের মাঝে আমার সন্তানের বড় হয়ে ওঠায় আমি প্রধান সঙ্গী। সন্তান জন্মানোর পর প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে আমার মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স হয়। আমি সেই বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসি এবং একা সবটা সামলাতে শুরু করি। আমার মা বাড়িতে ভীষণ অসুস্থ। আমি আজ জানি না কাল ওঁর কী হবে। প্রতিটা দিন কাটে অনিশ্চয়তায়। মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে মেয়ের স্কুলে যাওয়া হয় না, আমি কাজ করতে পারি না। অন্য দিনগুলিতে মেয়েকে আমি স্কুলে ছেড়ে দিয়ে আসি। তারপর ফেরার সময় স্কুলের কাছের পলাশ গাছটির দিকে তাকাই। সেখানে লাল পলাশের ঝাঁক আমায় মনে করায় বিশ্বভারতীর দিনগুলির কথা। মনে করায় আমার পরিবার চায়নি আমাকে আর্ট কলেজে পাঠাতে। কিন্তু সাফল্যের পরে সেই পরিবারকেই আমি পাশে পেয়েছি। আমার কাছে নারীদিবস আমার রোজকার দিনে লুকিয়ে থাকা লড়াই। মেয়েকে মানুষ করে তোলা, মাকে সুস্থ রাখা আর সারাদিনের মাঝে আমার আঁকার জন্য একটু সময় বার করে নেওয়া।
‘আমার গানে রাধা ফেরে না আয়ান ঘোষের কাছে’
দীপান্বিতা আচার্য
(লোকসঙ্গীত শিল্পী)
আলাদা করে একটা দিন সেলিব্রেট করা যেতেই পারে। কিন্তু আমার সেলিব্রেশনটা প্রতি মূহূর্তে। ছোটবেলায় আমার লড়াই ছিল বাড়ির সঙ্গে। আমার বাবা চায়নি আমি সঙ্গীতজগতে থাকি। কিন্তু আজ খুব ভালো লাগে যখন বাবাকে পাশে পাই। লোকসঙ্গীতের জন্য নানা গ্রামে যেতে হয়, সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে দেখি মেয়েরা গানের জগতে এগিয়ে আসছে। পুরুষদের পাশে বা পুরুষদের থেকেও এগিয়ে থাকছে। মনে হয় নারী ক্ষমতায়নকে এর থেকে অন্য আর কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়! এটাই তো কাম্য। আমার গানেও তাই রাধা ফিরে যায় না আয়ান ঘোষের কাছে। রাধা তার চার দেওয়ালের বাইরে গিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। রাধার হাত ধরে গোটা নারী সমাজ মাথা তুলে দাঁড়ায়।