খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
ক্যালেন্ডারের একটা দিন নারী দিবস হিসেবে পালন করেই কি নারী জাতিকে পরিপূর্ণ সম্মান দেওয়া হয়! প্রশ্ন সেখানেই। বৈদিক যুগের আগেও নারীকে পুরুষদের সমকক্ষ বলে মনে করা হতো। বৈদিক যুগের মেয়েরা যেমন শিক্ষা অর্জন করত ঠিক তেমনি নিজেদের স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নিজস্ব মত পোষণ করত। আর সে কারণে এসময় স্বয়ম্বর সভার প্রচলন ছিল। সে যুগের উল্লেখযোগ্য সুশিক্ষিত মহিলা ছিলেন গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ। কিন্তু মধ্যযুগ থেকে নারীদের অবস্থানগত অবনতি শুরু হয়। এই সময়কার বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে নারীদের উপর আরোপিত বিধিনিষেধের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময়ই বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, দেবদাসী প্রথাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর এগুলোই ছিল সে যুগে নারীকে দমন করে রাখার অস্ত্র। আমাদের সমাজে বিয়ের আগে বাবার অধীনে, বিয়ের পর স্বামীর অধীনে এবং বৃদ্ধা বয়েসে ছেলের অধীনে থাকে নারীদের অবস্থান।
তারপর যুগের পরিবর্তনে মেয়েরা আস্তে আস্তে চার দেওয়ালের গণ্ডির বাইরে পা রাখল। ঘরের বাইরের জগৎকে জানতে শিখল, বুঝতে শিখল। লেখাপড়া শিখে নিজেদের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে বিকশিত করল। আর বর্তমান যুগে তো নারীরা সর্বক্ষেত্রেই পারদর্শী। সমাজে নিজেদেরকে পুরুষদের সমকক্ষ করে তুলেছে তারা। প্লেন চালানো থেকে শুরু করে মহাকাশ অভিযানেও আজ আর মেয়েরা পিছিয়ে নেই। তবুও মেয়েরা আজও সমাজের চোখে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। পুরুষশাসিত এই সমাজ আজও মেয়েদের যোগ্য সম্মানটুকু দেয় না। আজও আমাদের সমাজে কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হয়। বাড়িতে মেয়ে জন্মালে আজও অনেকে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবুও ৮ মার্চ ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়।
নারী দিবসের সূচনা ১৯৫৭ সালে। নারী শ্রমিকদের প্রতিবাদকে সম্মান জানানোর জন্য জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন ক্লারা। এরপর থেকে এই দিনটি নারীর সমানাধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হলেও ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। কিন্তু নারী দিবস পালন করলেও সমাজ নারীদের এখনও তাদের উপযুক্ত সম্মান দেয় না। আজও বেশি রাতে একা একা রাস্তায় বের হতে ভয় পায় মেয়েরা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও পুরুষদের লালসার বলি হয় মেয়েরা। আজও শ্বশুরবাড়িতে পণের জন্য একটা মেয়েকে অত্যাচার সহ্য করতে হয়। এখনও আমাদের সমাজে ছেলেদের থেকে মেয়েদের নিচু নজরে দেখা হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস যে ইতিহাস বইতে পড়া একটা অধ্যায় মাত্র, সেটাই মনে করে এই প্রজন্মের মেয়ে বি.কম অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী শ্রেয়া চক্রবর্তী। শ্রেয়ার কথায়, এই দিনটি বিভিন্ন স্কুল কলেজে পালন করা হয়। কাগজে অথবা সোশাল মিডিয়াতে এই দিনটা নিয়ে প্রচুর চর্চা হয়। কিন্তু আদতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এই দুনিয়ায় মেয়েদের সেফটি বলে কিছুই নেই। এই তো যেদিন প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির ধর্ষণকাণ্ড ঘটল, তার ঠিক দু’দিন পরেই বিহারে একটি মেয়েকে অত্যাচার করে, তারপর টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে— বলল শ্রেয়া। এছাড়াও গ্রামের দিকে এখনও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জোর করে খাটানো হয়। আবার কন্যাসন্তান জন্মালেও তার উপর অত্যাচার চলে। শ্রেয়ার মতে নারী দিবস পালন করার আগে নারী সুরক্ষা নিয়ে ভাবা অন্তত জরুরি একটা বিষয়।
চারুচন্দ্র কলেজের ইংরেজি অনার্সের ছাত্রী রিয়া দত্ত মনে করে যে, নারী দিবস পালন করাটা একটা লোক দেখানো বিষয়। আগে এই দিনটা সেভাবে পালন হতে দেখেনি রিয়া। তবে নারী দিবস বলতে রিয়ার মতে মেয়েদের স্বাধীনতা পাওয়া, মেয়েদের চাওয়া পাওয়াকে স্বীকৃতি দেওয়া। মেয়ে হয়ে জন্মানো মানেই বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া নয়। অথবা শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কাজের লোকের পজিশন পাওয়াও নয়। রিয়ার মতে এখনও গ্রামের দিকে কিছু কিছু জায়গায় মেয়েদের পড়াশোনা করতে দেওয়া হয় না। এখনও পরিবার একটা মেয়েকে দায়িত্ব, বোঝা বলে মনে করে। মেয়েদের যে কোনও চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে, সেটা তারা ভাবেই না। মেয়েদের যে প্রাপ্য সম্মান দিতে হয় সেটাই তারা ভুলে গিয়েছে।
তবে হুগলি মহসিন কলেজের ছাত্রী রূপসা চৌধুরি মনে করে যে একটা দিন অবশ্যই নারী দিবস হিসেবে পালন করা উচিত। আর এই দিনটার মাধ্যমে পুরুষজাতিকে বোঝানো দরকার যে নারীদেরও স্বাধীনতা আছে। বহুদিন ধরে নারীরা অত্যাচারিত হয়ে আসছে। তবে এখন সামান্য কমেছে। আর রূপসার মতে এই উদ্দেশ্যেই একটা দিন নারী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। রূপসা মনে করে যে সমাজে মেয়েরা এখনও সুরক্ষিত নয়। প্রতিনিয়ত তাদেরকে নানাভাবে অসম্মান করা হয়। একদিন নয়, প্রতিদিনই মেয়েদেরকে সম্মানের চোখে দেখা উচিত। নারী দিবসটাকে একটা আনুষ্ঠানিক দিন বলেই মনে করে এডুকেশনে মাস্টার ডিগ্রি পাঠরতা ছাত্রী পুষ্পিতা চন্দ্র। যেভাবে একটা দিন আমরা জন্মদিন হিসেবে পালন করি, ঠিক সেইভাবেই এই দিনটাকে পালন করা হয়। পুষ্পিতার মতে এই দিনটা পালন করা এ জন্যই উচিত, যাতে নারীরা একটা দিন অন্তত সম্মান পায়। পুষ্পিতার মতে, দিনে দিনে এই দিনটার চাকচিক্য বাড়ছে, সমাজ দেখাতে চাইছে তারা নারীদের কতটা সম্মান করে। কিন্তু আদতে নারীরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আছে।
অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটির ছাত্রী কৌশিকী চট্টোপাধ্যায় মনে করে, একদিন মেয়েদের সম্মান না দেখিয়ে রোজ রোজ ঘটে যাওয়া সমস্যাগুলো যদি একে একে সরিয়ে ফেলতে পারা যায়, তবেই নারীদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হবে। এখনও বহুক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা হয়। কাজের জায়গায় নারীদের গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। কৌশিকী মনে করে যে আমাদের সমাজে নারীর ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটা যতদিন না সমাজ বুঝবে, ততদিন নারী দিবসের কোনও মানে থাকবে না। একটা মহিলার উপর ঘটা নির্যাতনগুলো একে একে সরিয়ে ফেলে যেদিন সমাজ একজন মহিলাকে মহিলা নয় মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখবে, সেদিনই আমাদের সমাজে একদিন নয় প্রতিদিনই নারী দিবসে পরিণত হবে বলে মনে করে কৌশিকী। আগামীকাল ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই নারী দিবসের প্রাক্কালে কবি নজরুলের ভাষায় বলা যায়—
‘সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনও ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
কাকলি পালবিশ্বাস