ব্যবসায় বাড়তি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত সাফল্য নাও দিতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি। শ্বাসকষ্ট ও বক্ষপীড়ায় শারীরিক ক্লেশ। ... বিশদ
যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর অবদান আজ নতুন নয়। সেই ১৮৫৮ সালেই তো ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। নিজের রাজ্যে নিজের অধিকার বজায় রাখতে তরোয়াল উঁচিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হয়েছিলেন। বীর যোদ্ধার মতো লড়াই করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ দেন তিনি। তবু লড়াইয়ের ভয়ে পিছপা হননি। ইংরেজ শাসকের কাছে মাথা নত করেননি। ঝাঁসির সেনাবাহিনীর প্রকৃত নেত্রী হিসেবে রানি লক্ষ্মীবাইয়ের ছবি আজও আমাদের মনে গেঁথে রয়েছে। এরপর বহু সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর উজ্জ্বল অস্তিত্ব ভারতের ইতিহাসের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে মেয়েদের সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে বারবার। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের মহিলা রেজিমেন্টের কথাই ধরুন না, সেখানেও ক্যাপটেন লক্ষ্মী সায়গল এক উজ্জ্বল নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার তাঁকে বর্মায় বন্দি করে। তবু হার মানেননি তিনি। তাহলে আজ এতদিন পর যুদ্ধে মেয়েদের নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন? সময়ের স্রোতে পা না মিলিয়ে আমরা কি তবে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম?
না, তা নয়। স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে মহিলাদের দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে প্রাথমিক স্তরে বাধা এলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলাদের উজ্জ্বল উপস্থিতির পক্ষেই রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কেন্দ্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও সম্প্রতি সেনাবাহিনীতে মহিলা কমান্ড বহাল করার রায় শুনিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। কমান্ডিং অফিসার পদে মহিলাদের বহাল করার দাবি নিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন ভারতীয় সেনার কয়েকজন মহিলা। কিন্তু পুরুষতন্ত্র ও লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। যুক্তিটা হল পুরুষের সমানে সমানে মহিলারা লড়াই করতে পারবে না। মেয়েদের নাকি মানসিক দৃঢ়তার অভাব! তাদের সংসার, সন্তান ইত্যাদি নানা হ্যাপা। আর মেটার্নিটি লিভের সময়? কে সামলাবে দায়িত্বে থাকা মহিলার পদ? তাছাড়া সেনাবাহিনীর জওয়ানরাও কোনও মহিলার নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। অতএব সেনাবাহিনীতে মেয়েদের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। দিল্লি হাইকোর্টে হেরে যাওয়ার পর সর্বোচ্চ আদালতে তাঁদের দাবি জানান সেনাবাহিনীর মহিলারা। কেন্দ্রের আপত্তি আর অজুহাত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কাছে ধোপে টেকেনি। সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রবীণ ও অভিজ্ঞ বিচারপতি জানান, ভারতীয় সেনায় মহিলারা কমান্ডিং অফিসার পদে থাকলে সেনাবাহিনীর উন্নতিই হবে। তাদের বিচার বিবেচনা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা বাড়বে। ফলে সেনার সার্বিক উন্নতির কথা ভেবেই মহিলাদের ভারতীয় সেনার কমান্ডিং অফিসারের পদ দেওয়া উচিত এবং এই রায় যেন তিন মাসের মধ্যেই লাগু করা হয়।
রায়ের প্রতি ভারতীয় সেনায় অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একদিকে যেমন খুশির জোয়ার অন্য দিকে আবার মেনে নিয়েও না মানার মনোভাব। খানিকটা হয়তো দ্বিধাও রয়েছে কারও মনে। তবে মনে যাই থাক মুখে কেউ রায়ের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করছেন না। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রাকেশ শর্মা বলেছেন, ‘মহিলাদের পক্ষে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় অবশ্যই খুব উল্লেখযোগ্য। আমি ব্যক্তিগতভাবেও সেনায় মহিলাদের স্থায়ী কমিশনের পক্ষে। তবে এই রায় কার্যকর করার কিছু সমস্যাও যে আছে তা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ব্যাটেলিয়নের কমান্ড নিতে হলে মহিলাদের কিছু ট্রেনিং নিতে হবে। আর তা যদি নিতে হয় তাহলে সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে বিভিন্ন গঠনগত পরিবর্তন আনা জরুরি। এতদিন যেহেতু কমান্ডিং অফিসার পদে শুধুমাত্র পুরুষরাই থাকতেন তাই ট্রেনিং স্টাফ কলেজের চরিত্রও পুরুষোচিত। সেই চরিত্রে এবার বদল আনতে হবে। আর সেই বদল কতটা সহজে আনা যাবে প্রশ্ন সেখানেই।’ অবশ্য জেনারেল শর্মা বলেছেন মহিলাদের জয়ে তিনি খুশি ।
দিল্লি হাইকোর্টে মহিলা সেনার আবেদনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন আইনজীবী মীনাক্ষী লেখি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এই বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। সংসার ও সন্তানের অধিকাংশ দায়িত্ব যে মহিলাদের ওপর বর্তায় তা কি শুধুই অকারণ পুলকে? না। স্ত্রী বা মা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ভালোবাসার সঙ্গে সংসার ও সন্তানকে আগলে রাখেন বলেই এই দায়িত্ব যুগ যুগ ধরে মহিলাদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই নিষ্ঠা নারী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আর সেই বৈশিষ্ট্যের বলেই মেয়েরা সেনাবাহিনীতেও কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করবে। ভারতীয় সেনার মহিলাদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পর তাঁদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন আইনজীবী লেখি। সেনাবাহিনীর মহিলা অফিসারদের কাছে বহু প্রতীক্ষা আর লড়াইয়ের পর এই জয়ের মূল্য যেন আরও অনেকগুণে বেড়ে গিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী একটা ক্ষেত্র মাত্র। কিন্তু এটা মহিলাদের সার্বিক ও সামাজিক জয়। সংসারের চার দেওয়াল ভেঙে মেয়েরা যেদিন কর্মজগতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিল সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বহুক্ষেত্রে শুধু বাধারই সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। সমাজ মেয়েদের শুধুই ‘রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা’ এই গণ্ডিতেই আবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু আজ সেই বাঁধন ছিঁড়ে মেয়েরা মুক্তির আনন্দ উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছে। মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় তাই শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতেই নয়, সার্বিক নারীজাতির মনেই এক আনন্দের হিল্লোল তুলেছে। পাশাপাশি তাদের মনে গড়ে তুলেছে এক প্রবল আত্মবিশ্বাস।