বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
এগিয়ে চলেছে সমাজ। এগিয়ে চলেছে দেশ। অগ্ৰগতির মূল কান্ডারিই মেয়েরা। মায়েরা। তবু চারদিকে মেয়েদের এত লাঞ্ছনা, অপমান, অত্যাচার দেখে সেই এগিয়ে চলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেই। সত্যি কি আমরা এগচ্ছি? কিন্তু শিক্ষিত সমাজ মানেই নারীর অগ্ৰগতি। সেই সমাজের জন্য উপযুক্ত নাগরিক তৈরিতে মায়েদের ভূমিকা অনেক। শুধু সংসারের দেওয়াল বন্দি হয়ে নয়, কিংবা কাজের জগতের মূল কান্ডারি হয়েও নয়, সংসার ও চাকরি দুদিকের ভারসাম্য রেখেই চলছেন আজকের মায়েরা।
পরিবার আমাদের ঘর থেকে শুরু হয়ে অনেক বৃহত্তর ক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত । কেউ স্কুলকে বলেন সেকেন্ড হোম। আবার কারও কাছে কর্মজগৎটি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আসলে সবটাই নির্ভর করে আমরা কতটা সেই পরিবারে পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছি তার ওপর। সেই মানিয়ে নেওয়া একদিনে হয় না। আমাদের আচরণে যা ফুটে ওঠে তার মূলে রয়েছে কিছু সংস্কার আর শিক্ষা। সংস্কার আর শিক্ষার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা দরকার। আর সেই কাজটিই আমাদের জীবনে করেন মা। বহু মহাপুরুষ আমাদের জীবনে মায়ের ভূমিকা নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সন্তানের জীবনের প্রথম শিক্ষক তো একজন মা-ই। আমরা কথায় বলি শিক্ষিত মা পারেন সন্তানকে শিক্ষিত করতে। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষিত বিশেষণটির ভুল প্রয়োগ দেখা যায় বহু ক্ষেত্রেই।
সমাজে ঘটমান নানা ঘটনায় আমরা প্রতিনিয়ত খুব গভীরভাবে মর্মাহত। তর্ক-বিতর্কে, তাত্ত্বিক আলোচনায় ভুল বা ঠিকের হিসেব কষতে বসি। কিন্তু ওই যে বললাম আমাদের শরীরে রক্তমজ্জায় যা মিশেছে তা মিশেছেই। তার বহিঃপ্রকাশ তো ঘটবেই আচরণে। অন্ধকারের জটিল চোরাপথে এমন অনেকে হারিয়েছে যারা হয়তো শৈশবে অন্ধকারকে ভয় পেত। অথচ সেই অন্ধকারের পেছনে থাকা আলোর পথটি চেনানোর কাজটি কেউ করেননি তাদের জীবনে। শিশুর হাত ধরে অন্ধকার থেকে আলোয় আনার কাজটি করেন একজন মা। সঠিক সময়ে সঠিক শিক্ষায় তাই মায়ের ভূমিকা প্রচুর।
সমাজবিদ্যার অধ্যাপক অংশুমান সরকারের মতে সুনাগরিক হয়ে ওঠার প্রথম ধাপটিই হয় মায়ের হাত ধরে। আমরা পরিবারের মধ্যে বড় হই। জন্মসূত্রেই মায়ের সঙ্গে বায়োলজিক্যাল অ্যাটাচমেন্ট থাকে।
অনেকের বাবা হয়তো কর্মসূত্রে দূরে থাকেন বা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া মা সন্তানকে ছেড়ে গিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বাবাও নিঃসন্দেহে অনুভূতিপ্রবণ হন কিন্তু দেখা গিয়েছে তাঁর থেকেও মায়ের অনুভূতি অনেক গুণ বেশি়। মায়ের স্নেহ তাই তুলনাহীন। সন্তান বড় হয়ে সুনাগরিক হয়ে উঠুক, কোন পথে চললে তা সম্ভব হবে, ভুল বা ঠিকের হিসেব এই নিয়েই মায়ের চিন্তা চলতে থাকে সারাক্ষণ। উচিত-অনুচিতের বোধ তৈরি করাটাই মায়ের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। একেই বলে সুশিক্ষাদান। অনেকে অবশ্য ভালোবাসতে গিয়ে আদর দিয়ে বাঁদরও তৈরি করেন। সন্তানের স্নেহে অন্ধ হয়ে যান। কিন্তু তা খুবই কম।
সন্তানকে যথার্থ মানুষ তৈরি করাই যদি একজন মায়ের উদ্দেশ্য হয় তাহলে তাঁকে কিন্তু সন্তানের শুধু দৈহিক বৃদ্ধি বা বড় বড় ডিগ্রি লাভের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। প্রথম ধাপটিই হবে যাতে সন্তান দৈহিক সুস্থতার সঙ্গে মানসিকভাবেও সুস্থ হয়। যাতে সে পরিবারে, সমাজে সবার সঙ্গে সুন্দরভাবে মিশতে পারে, সবাইকে আপন করে নিতে পারে এবং সমাজও যেন তাকে আপন করে নিতে পারে। জীবনে যেন সে অসামাজিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে একাকিত্বে না ভোগে। সবাই সন্তানকে হেয় করবে, অবহেলা করবে কিংবা অতিশাসন করবে এটা কোনও মা সহ্য করতে পারেন না। তাই স্কুলের শিক্ষকদের শাসন-তিরস্কারও অনেক ক্ষেত্রে মায়েদের অপছন্দের কারণ হয়। অথচ ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এই শাসন শিক্ষার্থীদের জন্য গঠনমূলক হয়ে উঠতে পারে। যদিও সেটা শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব এবং মানসিকতার উপর নির্ভর করে। শুধু সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়ে বড় করে তোলাই নয়, তাকে সমাজে কাঙ্ক্ষিত করে তোলাও মায়ের দায়িত্ব।
আজকের দিনে যখন সিঙ্গেল পেরেন্টহুড স্বীকৃতি পেয়েছে তখন মায়ের এই দায়িত্বও বেড়েছে বলেই মনে হয়। আগেকার দিনে বৃহত্তর পরিবারে যৌথ সংসারে সন্তান মানুষ করা যতটা সহজ ছিল এখন অণু পরিবারে সেই সুযোগ কমেছে সত্যি। বাবা-মা সন্তানের ছোট্ট বলয়ে তাই মায়ের দায়িত্ব বেড়েছে বললে ভুল হয় না। বাস্তব চিত্র এবং পরিসংখ্যান বলছে কর্মসূত্রে বাবারা যেমনভাবে বাইরে অনেক বেশি থাকেন যেমন কর্মরতা মায়েরাও ঘরে বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকেন। উপরে রয়েছে সাংসারিক দায়িত্ব। তাই সন্তান পালনে বাবার ভূমিকা, দায়িত্ব কি তাহলে কমে গেল নাকি? সমাজরক্ষার দায় মেয়েদের উপর চাপিয়ে দিয়েই খালাস হব আমরা। বহু ঘটনা বলছে মুদ্রার এক পিঠ না দেখে অপর পিঠটিও দেখতে। বিপত্নীক বা ডিভোর্সি বাবাও সুদক্ষভাবে সন্তান মানুষ করছেন। তখন বাবাকেই মায়ের ভূমিকাও পালন করতে হয়। আসলে সব সময় সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। এভাবেই তো সমাজ চলছে। আমরা টিঁকে আছি। এসব তাত্ত্বিক কথা উঠবে। জানি এই আলোচনার শেষ নেই। তবু যিনি গর্ভে ধরেছেন তার ব্যাকুলতা একটু হলেও যদি বেশি বলে ধরে নেওয়া হয় খুব কি ভুল হবে? সন্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে তাই তাকে শৃঙ্খলা মেনে চলতে শেখান যা তার জীবনকে পরিপাটি করে তুলবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন যা দেখে আপনার সন্তানও নীতিগত শিক্ষা পাবে। আপনার সন্তান পৃথিবীতে একা আদরের নয়— এটাই বাস্তব। তাই অতি আবেগে ভুলে যাবেন না। তার জীবন তাকেই উপভোগ করতে দিন, সঙ্গে দিন মায়ের সঠিক গাইডেন্স। প্রতিটি দিনের শেষে যাতে ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকিয়ে মায়ের পাশাপাশি নিশ্চিন্ত বাবারাও এই স্বপ্নই দেখেন যে, তার সন্তান আগামী পৃথিবীতে নতুন দিকচিহ্ণ তৈরি করতে সক্ষম হবে।