কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
নমো সরস্বতী মহাভাগ্যে
বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোঽস্তুতে।।
বৈদিক যুগে সরস্বতীর কল্পনা করা হয়েছিল সৃষ্টির প্রথম আলোক রশ্মি জ্যোতিঃস্বরূপা তেজোময়ী এক শক্তি রূপে যাকে হোমাগ্নি-যজ্ঞদেবী বলে সম্বোধন করা হতো।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে দুর্গার আর এক রূপ দেবী সরস্বতী, তিনি অসুর দমনকারিণী। শ্রীশ্রী চণ্ডীর উত্তর লীলায় শুম্ভ, নিশুম্ভ অসুর দু’জনকে মহা সরস্বতী রূপে তিনি বিনাশ করেন।
বায়ু পুরাণে বলা হয়েছে, সমগ্র বিশ্ব বিনাশের পর ব্রহ্মা নতুন প্রজা সৃষ্টির জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন। তখন তিনি নিজের মধ্যে থেকে বিশ্বধারিণী দেবী সরস্বতীর সৃষ্টি করলেন। তারপর তাঁকে আশ্রয় করে আরম্ভ করেন নতুন প্রজা সৃষ্টি।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে সৃষ্টির শুরুতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, নারায়ণ ব্রহ্মা ও ধর্মকে সৃষ্টি করার পর নিজের মুখ থেকে দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। একই পুরাণে সরস্বতী, লক্ষ্মী ও গঙ্গা বিষ্ণুর পত্নী বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
বেদে সরস্বতীকে দেবীতমে, অম্বিকাতমে, নদীতমে বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এইরকম মনে হওয়া স্বাভাবিক কারণ ভারতবর্ষের মাটিতে তাঁর আবির্ভাব, যার ভৌগোলিক প্রভাব আর্য তথা ভারতীয় সংস্কৃতিতে রয়েছে। তিনি শুধু আধ্যাত্মিক দিক দিয়েই নয়, জাগতিক দিক দিয়েও মানব জীবনের সঙ্গে সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন।
মনে হওয়া স্বাভাবিক, সরস্বতী নদীর তীরে বসবাসকারী আর্যরা সরস্বতী নদীর মধ্যে সরস্বতীর গুণ ও কর্মের প্রতিফলন লক্ষ করে নদী সরস্বতীকে দেবী সরস্বতী রূপে মেনে নিয়েছেন। তাঁরা যখন ভারতবর্ষের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েন তখন সরস্বতী নদীকে দর্শন করা সম্ভব হয়নি। তখন সাধক, ভক্ত ও শিল্পীদের মনের মাধুরীর সঙ্গে কল্পনাশক্তির সংমিশ্রণে আজকের দিনের পূজিতা সরস্বতীর রূপের ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক। তাই নানা পুরাণে নানাভাবে সরস্বতীর বর্ণনা করা হয়েছে। সরস্বতীর মধ্যে নদীর প্রভাব বেশি চোখে পড়ে।
সরস্বতী নদীর জলে ফুটন্ত পদ্ম, শ্বেত হংস দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত। সরস্বতী নদীর জল ছিল টলটলায়মান। তাই দেবী সরস্বতী শ্বেত পদ্মাসীনা, হংসবাহিনী, শ্বেতবর্ণা, শ্বেতবসনা, শুভ্রবর্ণের মধ্যে শুদ্ধজ্ঞানময়ী ও জ্যোতিঃস্বরূপা ভাবটিও ফুটে উঠেছে।
ভারতের আদি দেবী সরস্বতীর বাহন ছিল সিংহ ও অস্ত্র ছিল বর্শা বা শূল। পশ্চিম ভারতের গিরনার অঞ্চলে এবং বারাণসীতে সিংহবান সরস্বতীর পুজো হয়। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে সিংহবাহন সরস্বতীর মূর্তি এখনও রয়েছে।
দেবী সরস্বতীর পুজো শুধু ভারতেই নয়, ভারতের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও যে দেবী পূজিতা হন তার প্রমাণ পাওয়া যায় জাপানে। সেখানে বেনতেন নামধারিণী সর্পাসনা দ্বিভূজা বীণাপাণি, অষ্টভুজা হপ্পিবেনতেনের মূর্তির আরাধণা করা হয়। জাপানে সাতজন সৌভাগ্যের দেবতা আছেন। তাঁদের মধ্যে একমাত্র দেবী ‘বেনতেন সামা’। তিনি সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রেরণাদাত্রী এবং সুখ ও ঐশ্বর্যশালিনী। তিনি সমুদ্রজা, সাগরনিলয়, ড্রাগনবাহন, ড্রাগন বা সাপ তাঁর পতি, শ্বেতবর্ণ তাঁর দূত। তিনি অষ্টভুজা, বিউআ (বাদ্যযন্ত্র) তাঁর প্রিয়, তিনি কোথাও পদ্মাসনা আবার কোথাও সর্পাসনা।
জাপানে বিদ্যা-সৌভাগ্য প্রভৃতির কামনায় দ্বিভুজা এবং রণজয় কামনায় অষ্টভুজা বেনতেন মূর্তি পুজো করা হয়। দ্বিভুজা বেনতেন মূর্তি বিউআ বা বীণাবাদনরতা, অষ্টভুজার হাতে আছে— ধনু-তরবারি, কুঠার, পাশ, বাণ, বর্শা, দীর্ঘদণ্ড ও লোহার চাকা। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বেনতেন সৌভাগ্য-বিদ্যার দেবী সরস্বতী, বিনাশের দেবী দুর্গা ও সর্প— বিষহরি মনসার যুগল মূর্তি।
সে যাই হোক, দেবী সরস্বতী প্রধানত ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকেই পুজো পেয়ে থাকেন সব থেকে বেশি। তাই বাড়িতে, বিদ্যালয়ে, শিক্ষা-সংস্কৃতি নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলিতে এই পুজো বেশি সংখ্যায় হতে দেখা যায়। সরস্বতী পুজো মাত্র একদিনের পুজো। তাই পুজোর আনন্দ একদিনেই শেষ হয়ে যায়। পরদিন সকালে পুজোর পর দেবীর প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
দেবী সরস্বতীর পুজোয় অঞ্জলি দিয়ে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর প্রতিজ্ঞা করা উচিত, তারা যেন ভালোভাবে মন দিয়ে পড়াশোনা করে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও দশের সেবায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে পারে। আর এই আদর্শের মধ্যেই নিহিত আছে সরস্বতী পুজোর পরম সার্থকতা।